শাহাগীর বখত ফারুক-ষাট দশকে সুনামগঞ্জে অগ্রজদের মধ্যে যারা ছিলেন আমার রোল মডেল, আইকন বা অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তিত্ব তাদের মধ্যে আব্দুল হাই ভাই সাহেব ছিলেন অন্যতম। অন্যদের কাছে হয়তো তিনি ছিলেন একজন শিক্ষক, অধ্যাপক, সাংবাদিক, সম্পাদক, ব্যবসায়ী, রাজনীতিক, আর্টিস্ট, মুক্তিযোদ্ধা, কিংবা লেখক। কিন্ত আমার কাছে তিনি ছিলেন একজন বলিষ্ঠ মানুষ।  ভদ্র, নম্র, মার্জিত, জনদরদি, সহকর্মী, উপদেষ্টা, সাহস দানকারী এবং সর্বপরি একজন ঘনিষ্ট আত্মীয়। আব্দুল হাই ভাই সাহেবের কাছ থেকে আমি ছোটবেলা যা শিখেছি বা জেনেছি তা আজো আমার প্রাত্যহিক জীবনের পাথেয় হয়ে রয়েছে। ছোটবেলা তিনি আমাকে সাহস দিয়েছেন। শক্তি যোগিয়েছেন, উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। সে সব কথা আমার স্মৃতিতে এখনও আয়নার মত স্পষ্ট হয়ে আছে।

১৯৬১ সাল। সুনামগঞ্জ গভর্ণমেন্ট জুবিলী হাইস্কুলের ছাত্র। কতো না বয়স। হয়তো ১৩ কিংবা ১৪। কালাদ্দা আমাদের স্কুল সহকারী। ছুটি আর ক্লাশ শুরুর ঘন্টা বাজান। তার ঘন্টার সাথে বাধা আমাদের জীবন। ঘণ্টার সাথে দৌড়াই। ঘন্টার সাথে ছুটি। ঘণ্টার সাথে আবার সুবোধের মতো ক্লাশে গিয়ে বসি। একদিনের কথা খুব মনে হয়। ক্লাশ বসার আগে ক্লাশমেইটদের সঙ্গে আনন্দ উচ্ছ্বাস, দৌড়াদৌড়ি, ছুটাছুটি করে সবাই ক্লান্ত। কালাদ্দার ঘন্টা সংকেত। সবাই চুপচাপ। এসেম্বলি শেষে ক্লাসে মাত্র বসেছি। নাম ডাক শেষ। আবার সেই কালাদ্দা। কালাদ্দার অসময়ে আগমন মানে একটা কিছু। হয় সুসংবাদ। না হয় দুঃসংবাদ। কালাদ্দার হাতে নোটিশের খাতা। ক্লাশ টিচার স্যার নোটিশটা পড়লেন। স্যারের বিষন্ন মন। স্যারের মুখ দেখে বুঝলাম কিছু একটা হয়েছে। নোটিশটা যখন পড়ে শুনালেন বুঝতে আর বাকী থাকলো না। স্কুল ছুটি। আজ ক্লাশ হবে না। স্কুলের আমাদের এক ছোট ভাই পুকুরে গোসল করার সময় পানিতে ডুবে মারা গেছে। তার নামটি আজ আমার আর মনে নেই। শহরের পুরাতন বাসষ্টেশনের আমাদের ক্লাশমেইট অজিত নাগ (বর্তমানে কানাডায় বসবাসরত) এর ছোট ভাই। বইখাতা নিয়ে দল বেধে আমরা অজুর বাসায় দৌড়ালাম। অজুর মৃত ছোট ভাই। আমাদের স্কুলের ছাত্র। কম বয়সে হারিয়ে গেলো। লাশ দেখে হতভম্ভ সবাই।

বিকালে স্কুলের সিনিয়র ছাত্রদের উদ্দোগে স্থানীয় পাবলিক লাইব্রেরীতে শোক সভার আয়োজন করা হয়েছে। মরহুম আব্দুল হাই সাহেব এর মূল উদ্দোগতা। স্কুলের ছাত্র, শিক্ষক ও শহরের বিশিষ্টজন এতে উপস্থিত থাকবেন। ভাইসাহেব আমাকে বললেন তোমাকে কিছু বলতে হবে। এই বয়সে আমাকে এতোএতো জনের সামনে কিছু বলতে হবে শুনে বলার আগেই যেনো গলা শুকিয়ে গেলো। শিক্ষক ও মুরুব্বীদের সামনে দাঁড়িয়ে কিছু বলা চাট্টিখানি কথা না। ছাত্রদের সামনে হলে সাহস করে হয়তো বলেই দিতাম। অসম্ভব আমি পারবো না। উনার হাত থেকে বাচার নানা ফন্দি ফিকির করতে লাগলাম। ভয়েভয়ে ভাই সাহেবকে আমার অক্ষমতার কথা জানালাম। নাছোড়বান্দা। তিনি আমাকে ছাড়বেন না। মহা সংকটে পড়ে আমি এক মহাবিপদের চিত্র দেখছিলাম। ভাইসাহেবকে বারবার অনুরোধ করলাম। আমাকে এবারের মতো মাফ করা যায় কিনা ভাবতে বললাম। না। উনার এক কথা। আমাকে কিছু একটা বলতেই হবে।

জীবনে এই প্রথম দোয়া দুরুধ পড়ে বুকে সাহস সঞ্চয় করার চেষ্টা করলাম। ভুল শুদ্ধ যা পারি কিছু একটা বলেই দেবো। মনে মনে মনটাকে শক্ত করলাম। ভাইসাহেব আমাকে সাহস দিতে লাগলেন। তার উৎসাহে পাবলিক লাইব্রেরীর শোক সভায় সেদিন আমি জীবনের প্রথম বক্তব্য রাখি। সভাটা যতোই ছোট হোক। কিংবা হোক মৌনতার সভা। আমার জীবনের সে দিনটি ছিলো স্মরনীয় দিন। অজুর ছোট ভাইয়ের অকাল মৃত্যু আমকে সেদিন ব্যথিত করেছে। ভাইসাবের হুকুম পালন করতে গিয়ে সে ব্যথাটা কিছুটা হলেও ব্যক্ত করতে পেরেছি। নিজেকে কিছুটা হলেও দায় মুক্ত মনে হয়েছে। আজ পর্য্যন্ত সেই ছোট্ট পরিসরের শোক সভার স্মৃতি ভুলতে পারিনি। আব্দুল হাই ভাই সাহেবের সাহস, উৎসাহ এবং আশ্বাসে সেদিন একমাত্র এটা সম্ভব হয়েছিল। এ ক্ষুদ্র জীবনে অনেক সভা সমাবেশে কথা বলার সুযোগ পেয়েছি। কবে কোথায় কি বলেছি মনে করতে না পারলেও সে দিনের সে সভার কথা এখনো ভুলতে পারিনি। সভা সেমিনারে বসলেই স্কুল জীবনের সেই ছবিটা এখনো চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে যেনো জ্বলে উঠে,

আরেকটা ঘটনা। ১৯৬৭ সাল। সিলেট এম.সি কলেজ থেকে বি.এস.সি দিয়ে বাড়ীতে ছুটি কাটাতে এসেছি সুনামগঞ্জ। আব্দুল হাই ভাই সাহেব খবর পাঠালেন দেখা করার জন্য।“হাজী মকবুল পুরকায়স্থ” হাই স্কুলে। তিনি তখন এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক। সে স্কুলে তখন শিক্ষকতা করেন রাখাল দা, মনসুর ভাই, আসদ্দর ভুইয়া, রামেন্দু দে মিন্টু। সবাই মোটামুটি আমার পরিচিত।

-‘শুনেছি তুমি বি.এস.সি পরীক্ষা দিয়ে এসেছো? ভাইসাহেবের প্রশ্ন।

-জী। তবে রেজাল্ট বের হয় নাই।

-এইচ এস পি স্কুলে তোমাকে কয়েক মাস শিক্ষকতা করতে হবে। কোন ফর্মালিটির ধারধারি না গিয়ে সরাসরি আমাকে যেনো হুকুম করলেন। বললেন, ‘আমাদের বিজ্ঞানের শিক্ষকের অভাব। শিক্ষক হিসাবে তোমাকে দেখালে স্কুলটি বিজ্ঞানে অনুমোদন পাবে।’’

আবারো সেই যেনো শোক সভায় বক্তৃতা দেয়া। এবারেও ‘না’ বলে রেহাই পেলাম না। জীবনের সর্বপ্রথম চাকুরির হাতেকড়ি এই স্কুলে। আব্দুল হাই সাহেবের হাতে। যে কয়েকমাস ছিলাম, অভিজ্ঞতা অর্জন করেই বের হয়েছি। এই উৎসাহ উদ্দীপনা, সাহস ও অনুপ্রেরণার পিছনে যে বড় ভাইর অবদান সেই আব্দুল হাই ভাই সাহেবকে কোনদিন ভুলা যাবেনা।  আব্দুল হাই ভাইসাহেব আমার বয়সে অনেক অগ্রজ। কিন্তু উনার সঙ্গে অনেক মিল ও অনেক স্মৃতি রয়েছে যা ভুলার নয়। তিনি সুনামগঞ্জ কলেজে শিক্ষকতা করেছেন। আমিও পরবর্তীতে তিন বৎসর এই কলেজে শিক্ষকতা করেছি। তিনি কাদির বক্ত মক্তবের প্রাক্তন ছাত্র। আবার আমিও এই মক্তবে পড়াশুনা করেছি। আব্দুল হাই ভাই সাহেব অত্যন্ত সাদামাটা লোক ছিলেন। তার মুর্শিদি প্রেস ছিল আমাদের বাড়ির সন্নিকটে। আমার বড় বোন সুনামগঞ্জের প্রথম মহিলা ডাক্তার সালেহা খাতুনের বিয়েতে ১৯৫৮ সালে আব্দুল হাই ভাইসাহেব বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। তিনি আজ আমাদের মধ্যে নেই। তার অবদান সুনামগঞ্জবাসী আজীবন স্মরণ রাখবে।

লেখক পরিচিতি-শাহাগীর বখত ফারুক চিফ এডভাইজার ও সাবেক সভাপতি BRITISH BANGLADESH CHAMBER OF COMMERCE AND INDUSTRY IN U.K. সাবেক অধ্যাপক সুনামগঞ্জ কলেজ,যুক্তরাজ্য প্রবাসী।

 

 

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn