স্বপন কুমার দেব-
সুনামগঞ্জ শহরের আরপিননগর এলাকায় ‘ তালুকদার বাড়ী’ একটি ঐতিহ্যবাহী বাসভূমি হিসাবে পরিচিত। ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় এই বাড়িতে জন্ম গ্রহন করেন শহরের এক কীর্তিমান পুরুষ জনাব মুহাম্মদ আবদুল হাই। এক অঙ্গে এতরূপে’র মতো উনি ছিলেন অনেক গুনে গুণান্বিত। পঞ্চাশে’র দশকের শেষ অংশে এবং ষাটের দশকে’র প্রথম অংশে গভর্নমেন্ট জুবিলী হাই স্কুলের ছাত্র ছিলাম। বন্ধু সহপাঠী আবু আলী সাজ্জাদ হোসাইনের সুবাদে প্রথমে তালুকদার বাড়ীতে যাওয়ার সুযোগ ঘটেছিলো। আবু আলী সেই বাড়ীর এক গুনী সন্তান। বিরাট বাড়ী। অনেক শরীক বাসিন্দা। গমগম ভাব। সামনে বিরাট পুকুর। মালিক তালুকদার বাড়ী। পাড়া পরশী সবাই অবাধে ব্যবহার করতেন। লোক মুখে শুনতাম আবদুল হাই সাহেবে’র গুনের কথা। একদিন দেখলাম পুকুর ঘাটে’র সামনে দাড়িয়ে আছেন। শ্যামলা রং। শরীরের গঠন ভালো। সামান্য ব্যাক ব্রাশ করা চুল। প্রমান সাইজ উচ্চতা। মনে হলো রাশভারি ধরনের। তবে জেনেছি একবার মিশতে পারলে মনে’র দোয়ার খুলেদেন । সামনের বাংলা ঘরে’র এক অংশে হাই সাহেবের লাইব্রেরী। বন্ধু’র সুবাদে একদিন সুযোগ হয় ঢুকার। তখন অনেক কিছুই বুঝতামনা। কিন্তু উনার লাইব্রেরী তে সাজানো গুছানো রাশি রাশি বই দেখে মুগ্ধ হয়ে ছিলাম। কলেজ জীবনে এ বাড়ীর আরেক সদস্য আব্দুর রব চৌধুরী’র শেলী সঙ্গে বন্ধুত্বে’র সুবাদে নিয়মিত আসা যাওয়া ছিলো। আব্দুল হাই সাহেব একাধারে ছিলেন প্রগতিশীল মনে’র মানুষ, তেমনি সংস্কৃতি জগতের দিকপাল পুরুষ। ছিলেন ভাষা সৈনিক, আদর্শ শিক্ষক। বাংলা ভাষায় অসাধারন পান্ডিত্য ছিলো। সর্বোপরি হাই সাহেব ছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধে’র একজন সংগঠক। আরেক ভাই আব্দুল আহাদ চৌধুরী তারা মিয়া সাহেব ও ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক। এবং দুই ছেলে মুক্তিযুদ্ধা। অনুজ প্রতিম এডভোকেট সাহারুল ইসলাম সাহেবে’র আপন ভগ্নিপতি জনাব হাই সাহেব।
শেলী ভাই’র পিতা জনাব আব্দুর রইছ চৌধুরী অনেক দিন পলাশ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি ও সাহিত্য অনুরাগী ছিলেন। আবু আলী সাজ্জাদ হুসাইন সুনামগঞ্জ দেওয়ানী আদালতে’র প্রখ্যাত সিনিয়র আইনজীবি এবং’ সুনামগঞ্জের ইতিহাস ও ঐতিহ্য গ্রন্থ ‘ এর লেখক। যতদূর জানি হাই সাহেবদে’র আরেক ভাই ছিলেন। নাম ওয়াহিদ চৌধুরী লাট মিয়া। বেশীর ভাগ সময় থাকতেন এই গ্রন্থের সম্পাদক ইমানুজজামান মহীদের উকিলপাড়া’র বাসায়। মহী সম্পর্কে উনার ভাগিনা। কলেজে’র ছাত্র থাকাবস্থায় লাট মিয়ার অকাল মৃত্যু হয়। লাট মিয়াকে মেয়েলী হাতের লিখা একজনের অনেক চিঠি পড়া’র সুযোগ হয়েছিল। কারো সাথে হয়তো মন দেয়া নেয়ার সম্পর্ক ছিলো। শেলী ভাই এনেছিলেন কামরুজ্জামান সাফী ভাই (মহীর বড় ভাই) এর কাছ থেকে। চিঠির ভাষা ও গাঁথুনী চমৎকার। কে লিখেছিলো তা অনেক গবেষণা করেও বের করতে পারিনি।
আবদুল হাই সাহেব তৎকালীন বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে’র একজন কিংবদন্তি ছাত্রনেতা ছিলেন। বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলনে কারাবরন করেন। জেল থেকে পরীক্ষা দিয়ে কৃতিত্বে’র সঙ্গে বি.এ. পাশ করেন। ছোট বেলায় দূর থেকে দেখতাম আবদুল হাই সাহেব ঋুজু পদক্ষেপে হেঁটে যাচ্ছেন। পরনে সাদা পাজামা পাঞ্জাবী। খদ্দরে’র জামা। মাঝেমাঝে কোনকোন অনুষ্ঠানে প্রিন্সকোট গায়ে দিতেন। হাই সাহেব ও তারা মিয়া সাহেব বেশিরভাগ সময় সাইকেলে চলাচল করতেন। সে সময় বাজারে তিন ধরনের সাইকেল ছিল। মানে’র ক্রম অনুসারে র্যালে, ফিলিপ্স ও হারকিউলিস। মূল্য একশত পচাত্তর টাকা, একশত পচিশ টাকা ও আশি টাকা। হাই সাহেবরা দুই ভাই র্যালে সাইকেল ব্যবহার করতেন। আব্দুল হাই সাহেব দীর্ঘকাল সুনামগঞ্জ শিল্প কলা একাডেমি’র সেক্রেটারি ছিলেন। সেই সময় ‘সুরমা’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করতেন। সম্ভবতঃ মাসিক। আমার মা প্রয়াত কিরন বালা দেব ছিলেন সুনামগঞ্জ এস, সি গার্লস হাই স্কুলে’র সহকারি প্রধান শিক্ষক। তিনি ভারতে’র অনেক জায়গা ভ্রমণ করে একটি দীর্ঘ কাহিনী লিখেন। জনাব হাই সাহেব উনার সম্পাদিত ‘সুরমা’ পত্রিকায় তা প্রকাশে’র সুযোগ করে দিয়েছিলেন।
তখনকার দিনে পুরাতন কলেজে ঐতিহাসিক নাটক মঞ্চস্থ হতো। হাই সাহেব বিশেষ চরিত্রে দূর্দান্ত অভিনয় করতেন ও নাটক পরিচালনা করতেন। হাই সাহেব আড্ডার আসরে ও ছিলেন মধ্যমনি। আড্ডা বসতো ভূপতি এষ বাবু’র ফার্মেসিতে ও যোগেশ বাবু’র চা মিষ্টির দোকান ‘ ডেইরী’ তে। রাজনীতি সহ অনেক বিষয়ে আলোচনা হতো। সুনামগঞ্জ কলেজে একবার বাংলা’র অধ্যাপক এর অভাব দেখা দিলে জনাব হাই সাহেব কে অনুরোধ করলে তিনি খন্ড কালীন অধ্যাপক এর দায়িত্ব পালন করেন।আবদুল হাই সাহেব শহরে’র এইচ,এম, পি হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন ও স্কুলটি কে একটি মজবুত ভিত্তির উপর দাড় করিয়ে যান। আবদুল হাই সাহেব অত্যন্ত রাজনীতি সচেতন ছিলেন। এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অনুপ্রাণিত হন ও আওয়ামীলীগ দলে যোগদান করেন। তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধ কালে সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন। বালাটে সংবাদদাতা হিসেবে ও কাজ করেন। উনার প্রেরিত সংবাদ ভারতের বাংলা গনমাধ্যমে প্রচারিত হয়। দেশ স্বাধীনের পর সুনামগঞ্জে প্রথম যে পৌরসভা নির্বাচন হয় তাতে তিনি আওয়ামী লীগের পক্ষে চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী ছিলেন। হাই সাহেব এমনিতেই ভাবুক প্রকৃতির ছিলেন। ধীরেধীরে গভীর ভাব জগতে চলে যান। হাছন পছন্দ পরিচয়ে সম্ভবতঃ একটি গ্রন্থ রচনা করে ছিলেন। একমাত্র ছেলের অকাল মৃত্যুতে নিজেকে গুটিয়ে নেন। একদিন সাইকেল চালানো অবস্থায় অসুস্থ হন এবং অকালে পরলোক গমন করেন।
পরিশেষে সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি অনুরোধ জনাব আবদুল হাই সাহেবে’র কর্মযজ্ঞ সংরক্ষন করা ভবিষ্যৎ প্রজন্মে’র জন্য জরুরী। সূত্র গুলি হারিয়ে যাচ্ছে। জনাব হাই সাহেবের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। প্রয়াত আত্মার শান্তি কামনা করি।
— লেখক পরিচিতিঃ স্বপন কুমার দেব এডভোকেট সুনামগঞ্জ জজকোর্ট । (বর্তমান টরন্টো,কানাডা প্রবাসী )
সংবাদ টি পড়া হয়েছে :
১৯৮ বার