ইমতিয়াজ মাহমুদ –
ষোলই ডিসেম্বরে ঢাকায় পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণ একটা ঐতিহাসিক ঘটনা। এটা নিয়ে ১৯৭৫ সনের পর থেকে আমাদের দেশের কিছুসংখ্যক লোক বিচিত্র সব ফালতু বিতর্ক তৈরি করেছিল। উদ্বেগের ব্যাপার হচ্ছে যে সেইসব ফালতু কথা এখনো পর্যন্ত অনেকেই আলোচনা করেন। কেউ করেন বদমতলব থেকে আর কেউ করেন ভ্রান্তি থেকে। এর মধ্যে একটা ফালতু আলাপ হচ্ছে যে পাকিস্তান বাহিনী নাকি ভারতের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে, আমাদের কাছে নয় ইত্যাদি। এইসবই বাজে কথা এবং কোন না কোনোভাবে আমাদের গৌরবময় বিজয়কে ম্লান করার চেষ্টা ছাড়া আর কিছু না।
আইনগতভাবে, রাজনৈতিকভাবে এবং কূটনৈতিক বিবেচনা সব দিক দিয়েই বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৯৭১ সনের মার্চের ২৬ তারিখ থেকে। আমাদের যে আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র প্রণীত হয়েছিল ১৯৭১ সনের এপ্রিলের দশ তারিখে সেখানেই স্পষ্ট করে নির্দেশ করা আছে সেই তারিখটি। তার ভিত্তিতেই আমাদের প্রবাসী সরকার গঠন করা হয় এবং বিভিন্ন দেশের সাথে কূটনৈতিক যোগাযোগ স্থাপন করা হয়। ভুটান ও ভারত সরকারও আমাদের দেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি দেয় সেই ভিত্তিতেই। ২৬ মার্চ থেকে যে যুদ্ধটা, সেটা ছিল বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী সেই সময় বাংলাদেশ দখল করে রেখেছিল।
পাকিস্তান যখন ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে, ভারত পশ্চিম রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেছে ওদের নিজেদের মতো করে। এদিকে পূর্ব রণাঙ্গনে যুদ্ধ করার জন্যে বাংলাদেশ ও ভারতের বাহিনীর মধ্যে যৌথ কমান্ড গঠন করা হয়। মনে রাখবেন এটা ছিল ভারত ও বাংলাদেশের দুইটি স্বাধীন দেশের দুই বাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত যৌথ বাহিনী। এই যৌথ বাহিনীর কমান্ডার নিয়োগ করা হয় ভারতের একজন জেনারেল, জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরাকে। এই যৌথ বাহিনী গঠনের আগেই বাংলাদেশকে ভারত স্বীকৃতি দেয়, যাতে করে এই যৌথ বাহিনীটির মর্যাদা দুইটি স্বাধীন দেশের বাহিনীর যৌথ কমান্ড হিসাবে বৈধতা পায়।
সেই সাথে এটাও মনে রাখবেন যে ভারত যখন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় ততদিনে আনুষ্ঠানিকভাবেই বাংলাদেশের সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনী গঠিত হয়ে গেছে। ১১ নভেম্বরে বাংলাদেশের তিন বাহিনী যৌথভাবে অভিযানও পরিচালনা করেছে, সেজন্যে ১১ নভেম্বরকে সামরিক বাহিনী দিবস হিসাবে পালন করা হয়। এসব বলছি তার কারণ হচ্ছে যে ভারত ও বাংলাদেশের বাহিনীগুলোর মধ্যে যে যৌথ কমান্ড গঠিত হয়ে এটা কোন কথার কথা ছিল না। সামরিক বিচারে, আইনগতভাবে সবদিক দিয়েই এটা ছিল দুইটি স্বাধীন দেশের একটি যৌথ বাহিনী।
২
এরকম যৌথ বাহিনী হলে একজন জেনারেলকে তার কমান্ডিং অফিসার করতে হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকা ইংল্যান্ডসহ এই পক্ষের কমান্ডিং অফিসার ছিলেন একজন আমেরিকান জেনারেল, জেনারেল আইজেনহাওয়ার। আমাদের ক্ষেত্রে কমান্ডিং অফিসার ছিলেন একজন ভারতীয় জেনারেল, জেনারেল অরোরা। তাঁর পদবী ছিল General Officer Commanding in Chief, India and BANGLA DESH Forces in the Eastern Theatre অর্থাৎ পূর্ব রণাঙ্গনে ভারত ও বাংলাদেশের বাহিনী সমূহের প্রধান কমান্ডার।
পাকিস্তান বাহিনী যখন আত্মসমর্পণ করে ডিসেম্বরের ষোল তারিখে, ওরা কার কাছে আত্মসমর্পণ করবে? বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ বাহিনীর কাছে না তো কার কাছে? সেটাই হয়েছে। ষোলই ডিসেম্বরে আত্মসমর্পণ দলিলে আমাদের পক্ষে স্বাক্ষর করেছেন জেনারেল অরোরা। আত্মসমর্পণের দলিলে লেখা আছে, একদম প্রথম লাইনে, “The PAKISTAN Eastern Command agree to surrender all PAKISTAN Armed Forces in BANGLA DESH to Lieutenant-General JAGJIT SINGH AURORA, General Officer Commanding in Chief of Indian and BANGLA DESH forces in the Eastern Theatre.”
যখন একাধিক দেশের সামরিক বাহিনী একসাথে কাজ করে তখন এরকমই হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানি যখন প্রথম আত্মসমর্পণ করে ফ্রান্সের রিম শহরে, তখন সেই দলিলে মিত্রশক্তির পক্ষে অর্থাৎ ফ্রান্স, ইংল্যান্ড ও আমেরিকার পক্ষে স্বাক্ষর করেন জেনারেল আইজেনহাওয়ার। সোভিয়েত ইউনিয়ন টেকনিক্যালি ওই জোটে ছিল না, ওদের কাছে জার্মানরা আবার আলাদা করে স্বাক্ষর করে ১৯৪৫ সনের মে মাসের ৯ তারিখে।
৩
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা যখন এসেছে তখন আপনাদেরকে আরেকটা তথ্য দিয়ে রাখি। অনেকে হয়তো জানেন এটা। এই যা ষোলই ডিসেম্বর তারিখে পাকিস্তান বাহিনী ওদের প্রায় লাখ খানেক সৈন্যসহ আত্মসমর্পণ করেছে এটা পৃথিবীর ইতিহাসে একটা উল্লেখযোগ্য অনন্য সাধারণ ঘটনা। কীভাবে?
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পাকিস্তান ছাড়া পৃথিবীর আর কোন দেশের সেনাবাহিনী এইভাবে অন্য দেশের কাছে আত্মসমর্পণ করেনি। পাকিস্তানের বাহিনীই একমাত্র বাহিনী যারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করেছে। না, যুদ্ধ তো বেশ কিছু হয়েছে, বড় বড় যুদ্ধ হয়েছে। কিন্তু সেইসব যুদ্ধ শেষ হয়েছে সন্ধির মাধ্যমে বা যুদ্ধবিরতির মধ্য দিয়ে বা সেরকম কোন চুক্তি বা মধ্যস্থতার মাধ্যমে। আত্মসমর্পণ কেউ করেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এইরকম কালিমা পাকিস্তান বাহিনী ছাড়া আর কারো কপালে লাগেনি।
আরেকটা উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হচ্ছে যেভাবে ওরা আত্মসমর্পণ করেছে আমাদের কাছে সেটা। পাকিস্তান বাহিনী হচ্ছে আধুনিক যুদ্ধের ইতিহাসে একমাত্র বাহিনী যারা এইভাবে খোলা মাঠে এসে মাথা হেঁট করে আনুষ্ঠানিকভাবে অস্ত্র সমর্পণের মাধ্যমে সারেন্ডার করেছে। এরআগে উল্লেখযোগ্য যেসব আত্মসমর্পণের ঘটনা ঘটেছে সেগুলো ঘটেছে কোন না কোন ঘরে বা সেরকম কোন জায়গায় বসে দুই পক্ষের জেনারেলরা আনুষ্ঠানিক দলিল স্বাক্ষর করেছে- ব্যাস। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে ভারসাই চুক্তি দিয়ে- সেটা স্বাক্ষর হয়েছে ভারসাই-এর বনের মধ্যে একটা ট্রেনের বগিতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের যে তিনটা আত্মসমর্পণ দলিল, তার একটা স্বাক্ষর হয়েছে ফ্রান্সের ওই শহরে একটা ভবনে, এর পরেরটা বার্লিনের উপকণ্ঠে একটা হলে, আর তৃতীয়টা স্বাক্ষর করেছে জাপান একটা ভাসমান জাহাজে।
৪
এরকম খোলা মাঠে এসে প্রকাশ্যে জনগণের সামনে হাঁটু গেঁড়ে নতজানু হয়ে আত্মসমর্পণের ঘটনা আধুনিক কোন যুদ্ধে কখনো হয়নি। কোন দেশের সামরিক বাহিনী এরকম করেনি। ইতিহাসে এর আগে আদৌ কখনো কোন বাহিনী এইরকম অবমাননাকর অনুষ্ঠান করে আত্মসমর্পণ করেছে কিনা আমার জানা নাই। আমি খুঁজেও দেখেছি, আমার জানা মতে মানুষের জ্ঞাত ইতিহাসে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীই সবচেয়ে অবমাননাকর পদ্ধতিতে আত্মসমর্পণ করেছে। আর সেটা ওরা করেছে আমাদের যৌথ বাহিনী, অর্থাৎ বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ বাহিনীর কাছে।-ইমতিয়াজ মাহমুদ, অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sunamganjbarta.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sunamganjbarta.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
সংবাদ টি পড়া হয়েছে :
১০৯ বার