ছবি কৃতজ্ঞতা: বেঙ্গল স্টুডিও

সঞ্জয় কুমার নাথ :: শিক্ষকতা মহান পেশাকে তিনি অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন নিজের শ্রমে-কর্মে। পেশাগত জীবনে পুরো সময় কেটেছে মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে। সাফল্যের পত্র-পুষ্পে পূর্ণ বিকশিত তাঁর শিক্ষকতা জীবন। তিনি বাবলী পুরকায়স্থ। প্রধান শিক্ষক, অগ্রগামী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ। আজ ৪ ফেব্রুয়ারি তাঁর কর্মদিবসের শেষ দিন। সেই সঙ্গে দীর্ঘ ৩৪ বছরের বর্ণাঢ্য শিক্ষকতা জীবনের আনুষ্ঠানিক যবনিকা ঘটছে আজ।

সুনামগঞ্জ শহরের উকিলপাড়ায় ১৯৬২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন বাবলী পুরকায়স্থ। বাবা কৃষ্ণ কিশোর পুরকায়স্থ ও মা কনকপ্রভা পুরকায়স্থ। ১৯৭৭ সালে এসএসসি, ১৯৭৯ সালে এইচএসসি, ১৯৮১ সালে বিএ ও ১৯৮৪ সালে বিএড ডিগ্রি লাভ করেন। শিক্ষাজীবন শেষে নিজ বিদ্যালয় এসসি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে তিনি সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। সালটি ছিল ১৯৮৭। ১৯৯০ সালের ১৯ মার্চ সিলেট সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে বাবলী পুরকায়স্থ সহকারী শিক্ষক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। সেখানে দীর্ঘ ২১ বছর সুনামের সঙ্গে কাজ করেন। ২০১১ সালের ১১ আগস্ট তিনি সরকারি অগ্রগামী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ২০১১ সালের ৩১ ডিসেম্বর ওই বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে পদোন্নতি পান।

১৯৮৯ সালে বাবলী পুরকায়স্থ সিলেটের লালাদিঘীর পার নিবাসী পূর্ণেন্দু ভট্টাচার্যের সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। তাঁর দুই ছেলেও কর্মক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। সিলেট অগ্রগামী উচ্চ বিদ্যালয়ে বাবলী পুরকায়স্থ এক দশক কাল অতিবাহিত করেছেন। এই দশ বছর নিয়ে আলাদাভাবে কিছু উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য সিলেটের মাধ্যমিক শিক্ষার ইতিহাসে সংযোজিত হয়েছে। নিঃসন্দেহে তা স্বর্ণযুগ হিসেবেই আখ্যায়িত করা যায়। সিলেট বিভাগের ‘মেয়েদের সেরা বিদ্যালয়’ কেবল ফলাফলের ভিত্তিতেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি এগিয়ে ছিল, তা নয়।

সাংস্কৃতিক, ক্রীড়া ও সহ-পাঠক্রমিক নানা শাখায় প্রভূত সুনাম কুড়িয়েছে বিদ্যালয়টি। আর এই সাফল্যের কান্ডারি ছিলেন প্রধান শিক্ষক বাবলী পুরকায়স্থ। তাঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব তিনি তাঁর শিক্ষকমণ্ডলীকে একটি টিম-এ নিয়ে আসতে পেরেছিলেন। তাঁর আন্তরিক স্নেহ-ভালোবাসা আর সঠিক পরিচালনায় সর্বক্ষেত্রে শৃঙ্খলা ছিল বিদ্যালয়ের এগিয়ে যাওয়ার চাবিকাঠি। তিনি শিক্ষকদের কাছে যতটা না ছিলেন তটস্থ প্রধান শিক্ষক, তার চেয়ে বেশি ছিলেন স্নেহময়ী ‘দিদি’। ম্যাডামের চেয়ে দিদি সম্বোধনে তিনি অধিক স্বাচ্ছন্দবোধ করতেন। শিক্ষার্থীরা ছিল মেয়েসম অথবা তার চেয়েও বেশি কিছু।

দেশ-বিদেশে উঁচু পদে কর্মরত তাঁর একাধিক শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের সাফল্যের পেছনে প্রধান শিক্ষক বাবলী পুরকায়স্থের সরাসরি অবদান রয়েছে। কারণ এমন অনেক বড় বড় সমস্যা তিনি স্বাভাবিকভাবে তাৎক্ষণিক সমাধান করতে পারতেন। তিনি কাছে টেনে নিতেন পরম মমতায়। পারিবারিকভাবে সম্পর্ক গড়ে উঠত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। তাদের সাফল্যে তিনি শিশুর মতো উল্লসিত হতেন।

এ সব বিষয়ের প্রমাণ পাওয়া গেল গত ৩ ফেব্রুয়ারি। কোভিড-১৯ এর কারণে তাঁর বিদায়কালে জনসমাবেশ করে কোনো অনুষ্ঠান হবে না, বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আগেই জানানো হয়েছিল। কিন্তু বিদ্যালয়ের বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থীরা বিনা নোটিশে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এসেছে নিরবচ্ছিন্নভাবে। তাদের হাতে ছিল ফুল, হাতে আঁকা ছবি, নানা উপহার। কারো চোখে জল। তিনিও বরাবরের মতো আদরে-সোহাগে বুকে টেনে নিয়েছেন তাঁর প্রিয় শিক্ষার্থীদের। মানুষের সেবা করার কথা বলেছেন বরাবরের মতো।

বাবলী পুরকায়েস্থর সময়কালে অগ্রগামী স্কুল এক সাংস্কৃতিক পীঠস্থানে স্থান করে নিয়েছিল। তিনি অভিভাবকদের আস্থা অর্জন করতে পেরেছিলেন। বিশেষ করে মায়েদের জন্য তাঁর কিছু কীর্তি অক্ষয় হয়ে থাকবে। প্রতি বছর ‘মা সম্মাননা’ মায়েদের জন্য ছিল সন্তানদের সাফল্যের বিশাল স্বীকৃতি। এ রকম অনেক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন বাবলী পুরকায়স্থ। যেমন-সৃজনশীল মেধা অন্বেষণে জাতীয় পর্যায়ে অংশগ্রহণ ও পুরস্কারগ্রহণ, বইপড়া ও পাঠাভ্যাসে শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করা ও শিক্ষার্থীদের কৃতিত্ব অর্জনে সহায়তা করা। প্রতিবছর জাতীয় পর্যায়ে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা একাধিক পুরস্কার পেয়ে থাকে। এ জন্য তিনি নির্ধারিত শিক্ষকদের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের সংগীত, আবৃত্তি ও নৃত্যসহ শিল্প-সাহিত্যের ব্যাপক চর্চার জন্য আলাদা শিক্ষক রেখেছেন নিয়মিত। এসব ব্যাপারে ছিল তাঁর নিবিড় তত্ত্বাবধান।

লেখাপড়ার ক্ষেত্রে তিনি যেমন ছিলেন সজাগ, তেমনি অন্যান্য বিষয়েও তাঁর ছিল সমান আগ্রহ। ফলে জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ-২০১৬ সালে তিনি সিলেট জেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক হয়েছিলেন। অপরদিকে ২০১৫ সালে মাল্টিমিডিয়া ক্লাস পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য জেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠান প্রধানের পুরস্কার পান। গত এক দশকে প্রতিবছর স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে যে সকল পুরস্কার এসেছে তার তালিকা বেশ দীর্ঘ। উল্লেখযোগ্য অর্জনের মধ্যে রয়েছে-তথ্য প্রযুক্তি প্রসার ও উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে জাতীয় তথ্য ও যোগাযোগ পুরস্কার ২০১৫ ও ২০১৬, জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ ২০১৪, ২০১৫।

২০১৭ সালে শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পুরস্কার, জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ উপলক্ষে ২০১৬ সালে শ্রেষ্ঠ গার্ল গাইড, ডিজিটাল উন্ন্য়ন মেলায় বিতর্ক, উপস্থিত বক্তৃতা ও প্রজেক্ট উপস্থাপনায় শিক্ষার্থীদের প্রথম স্থান অর্জন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মেলায় ২০১৭ সালে প্রথম স্থান অর্জন, এন.ডি.এফ ডিবেট ফেস্টিভেলে ২০১৭ সালে বেস্ট স্কুল এওয়ার্ডসহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছে বিদ্যালয়। আইসিটি প্রশিক্ষণে বাবলী পুরকায়স্থ নিউজিল্যান্ড ও বাংলাদেশ গার্ল গাইডসের আঞ্চলিক কমিশনার হিসেবে গাইডের জাতীয় দিবসে থাইল্যান্ড ভ্রমণ করেন।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn