বার্তা ডেস্ক :: ওয়ানিদু হাসারাঙ্গা আর ইসুরু উদানা মিলে একটু শঙ্কা জাগিয়েছিলেন; কিন্তু সেই শঙ্কাও যখন সাইফউদ্দিনের বলে আফিফ হোসেনের ক্যাচে কেটে গেলো, তখন বাংলাদেশের জয়ের সামনে শুধু বাধা ছিল খানিকটা সময়। সেই সময়ের ব্যবধানে বাকি উইকেটগুলোও বিদায় নিলো বোলারদের দৃঢ়তায়। বিশ্বকাপ সুপার লিগে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে তিন ম্যাচ সিরিজের প্রথম ম্যাচে তাই ৩৩ রানের ব্যবধানে অনায়াস জয় তুলে নিলো বাংলাদেশ। এই জয়ে ব্যাটসম্যান মুশফিকুর রহীম, তামিম ইকবাল এবং মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের যেমন অবদান ছিল, তেমনি বল হাতে কব্জির ঘূর্ণিতে দুর্দান্ত অবদান রাখেন মেহেদী হাসান মিরাজ।

২৫৮ রানের লক্ষ্যে খেলতে নেমে ব্যাটিং বিপর্যয়ে পড়ে শ্রীলঙ্কা। ইনিংসের ১৮ ওভারে ২ উইকেটে ৮২ রান থেকে ২৭.৩ ওভারে ৬ উইকেটে ১০২ রানের দলে পরিণত হয় তারা। অর্থাৎ ৯.৩ ওভারে মাত্র ২০ রান তুলতেই ৪ উইকেট হারিয়ে ফেলে লঙ্কানরা। যার মূল কৃতিত্ব ছিল অফস্পিনার মেহেদি মিরাজের। এর আগে বাংলাদেশকে প্রথম উইকেটও এনে দিয়েছিলেন মিরাজ। লঙ্কানদের পক্ষে ইনিংস সূচনা করেন দুই বাঁহাতি কুশল পেরেরা ও দানুশকা গুনাথিলাকা। দুইপাশেই বাঁহাতি থাকায় ডানহাতি অফস্পিনার মিরাজকে দিয়েই বোলিং শুরু করেন বাংলাদেশ অধিনায়ক তামিম ইকবাল এবং সাফল্যও পেয়ে যান খুব দ্রুত।

ইনিংসের পঞ্চম ওভারেই ফিরতি ক্যাচে আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠা গুনাথিলাকাকে ফেরান মিরাজ।আউট হওয়ার আগে ১৯ বলে ২১ রানে করেন গুনাথিলাকা। প্রথম স্পেলে ৪ ওভারে ১১ রান খরচায় এই একটি উইকেটই নেন মিরাজ। পরে দ্বিতীয় স্পেলে ফিরে ৬ ওভারে ১৯ রান খরচায় নেন আরও ৩ উইকেট। মিরাজ দ্বিতীয় স্পেলে ফেরার আগে অবশ্য পাথুম নিসাঙ্কাকে (১৩ বলে 8) আউট করেন মোস্তাফিজুর রহমান এবং সাকিব আল হাসানের শিকারে পরিণত হন কুশল মেন্ডিস (৩৬ বলে ২৪)। সাকিবের বলে মেন্ডিস আউট হওয়ার খানিক পরেই দ্বিতীয় স্পেলে আনা হয় মিরাজকে।

নতুন স্পেলের দ্বিতীয় ওভারেই লকান অধিনায়ক কুশল পেরেরার উইকেট নেন মিরাজ। আউট হওয়ার আগে ৫০ বল খেলে ৩০ রান করতে সক্ষম হন পেরেরা। পরের ওভারে সাজঘরের পথ ধরেন ধনঞ্জয় ডি সিলভা। একপর্যায়ে দ্বিতীয় স্পেলে মিরাজের বোলিং ফিগার ছিল ৪-২-৩-২! অর্থাৎ চার ওভারের স্পেলেই লঙ্কানদের বেঁধে ফেলেন মিরাজ। পরের দুই ওভারও একসঙ্গেই করে ফেলেন তিনি। যেখানে আশেন বান্দারার উইকেট নিলেও, ভানিন্দু হাসারাঙ্গা করেন পাল্টা আক্রমণ। দুই চার ও এক ছয়ের মারে মিরাজের শেষ দুই ওভারেই হয় ১৬ রান। সবমিলিয়ে তার বোলিং ফিগার দাঁড়ায় ১০-২-৩০-৪।

কিন্তু তার শেষ দুই ওভারে যে আক্রমণাত্মক ব্যাটিং শুরু করেন হাসারাঙ্গা, তা চালিয়ে নেন ৪৪ ওভার পর্যন্ত। প্রথমে দাসুন শানাকাকে নিয়ে ৬.৪ ওভারে গড়েন ৪৭ রানের জুটি। যেখানে শানাকার অবদান ২৫ বলে ১৪ রান। তাকে সোজা বোল্ড করে জুটি ভাঙেন মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন। এতে অবশ্য তেমন ফায়দা হয়নি। কেননা নয় নম্বরে নামা ইসুরু উদানাকে নিয়ে নতুন লড়াই শুরু করেন হাসারাঙ্গা। লোয়ার অর্ডার ব্যাটসম্যান হলেও দারুণ সঙ্গ দেন উদানা। একের পর এক চার-ছয়ের মারে মাত্র ৩১ বলে তুলে নেন ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় ফিফটি। তার ব্যাটেই জয়ের আশা জাগিয়ে তোলে শ্রীলঙ্কা।

ইনিংসের ৪১তম ওভারে আউট হতে পারতেন হাসারাঙ্গা। কিন্তু ডিপ মিড উইকেটে তার ক্যাচ ছেড়ে দেন লিটন দাস। তবে ৪৪তম ওভারে আর ভুল করেননি আফিফ হোসেন ধ্রুব। সাইফউদ্দিনের বলে দারুণ এক ক্যাচ নিয়ে হাসারাঙ্গার বিদায়ঘণ্টা বাজান তিনি। আউট হওয়ার আগে ৬০ বলে ৭৪ রান করেন হাসারাঙ্গা। এরপর আর বেশি দেরি হয়নি বাংলাদেশের জয় পেতে। পরের ওভারের প্রথম বলেই ২১ রান করা উদানাকে ফেরান মোস্তাফিজুর রহমান। শেষ উইকেট জুটিতে লক্ষ্মণ সান্দাকান এবং দুস্মন্তে চামিরা কিছুটা অপেক্ষায় বাড়ায় বাংলাদেশের বিজয় উদযাপনে। শেষ পর্যন্ত ৪৯তম ওভারে মোস্তাফিজের প্রথম বলেই উইকেট দিয়ে দিলেন চামিরা। শেষ হয়ে গেলো লঙ্কানদের ইনিংস। ৩৩ রানে জিতে গেলো বাংলাদেশ।

মেহেদী হাসান মিরাজ নেন সর্বোচ্চ ৪ উইকেট। ৩টি নিলেন মোস্তাফিজুর রহমান, দুটি নিলেন সাইফউদ্দিন এবং একটি নিলেন সাকিব আল হাসান। এর আগে হোম অব ক্রিকেটের দুই নম্বর উইকেটে টস জিতে আগে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বাংলাদেশ অধিনায়ক তামিম ইকবাল। নতুন বলে একপাশ থেকে গতির ঝড় তোলেন সফরকারী দলের ডানহাতি পেসার দুশমন্ত চামিরা, অন্যপাশে নিখুঁত লাইন-লেন্থের প্রদর্শনী করেন বাঁ-হাতি ইসুরু উদানা। নিজের প্রথম দুই ওভারের মধ্যে ১০টি ডেলিভারিতেই ১৪০+ প্রতি ঘণ্টা গতিতে বল করেন চামিরা।

অবশ্য প্রথম উইকেটের ক্ষেত্রে চামিরার গতির চেয়ে লিটন দাসের দায়ই ছিল বেশি। ইনিংসের দ্বিতীয় ওভারের তৃতীয় বলটি ছিল ১৪৬.৫ কিমি গতির, প্রতি ঘণ্টায়। অফ স্ট্যাম্পের বাইরের বলে ছিল হালকা আউটসুইংও, সেটি জায়গায় দাঁড়িয়ে খেলতে গিয়ে প্রথম স্লিপে ধরা পড়েন লিটন। সাজঘরে ফেরেন শূন্য রানে। সবশেষ পাঁচ ইনিংসে লিটনের এটি তৃতীয় শূন্য। শুরুতেই লিটনকে হারানোর পর পাওয়ার প্লে’তে খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি দুই অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান তামিম ইকবাল ও সাকিব আল হাসান। প্রথম ১০ ওভারে স্কোরবোর্ডে রান ওঠে ৪০। রানের জন্য ছটফট করতে করতে নিজের উইকেট হারান সাকিব। অতিরিক্ত ডট খেলে ফেলায় চাপ সরানোর লক্ষ্য উইকেট ছেড়ে মেরেছিলেন তিনি। কিন্তু ধরা পড়ে যান লং অনে দাঁড়ানো পাথুম নিসাঙ্কার হাতে। মাত্র ২ ওভারের স্পেলে মূল্যবান উইকেটটি নিয়ে যান দানুশকা গুনাথিলাকা।

সাকিব আউট হওয়ার সময় দলীয় সংগ্রহ মাত্র ৪৩ রান। শুরুর এই চাপটা ভালোভাবেই সামাল দেন তামিম ও মুশফিক। দুজন মিলে ৬৪ বলে গড়েন ৫৬ রানের জুটি। ইনিংসের ২০তম ওভারে প্রথম ছক্কা হাঁকান তামিম, পরের ওভারে স্লগ সুইপে সীমানাছাড়া করেন মুশফিকও। এক ওভার পর ক্যারিয়ারের ৫১তম ফিফটি তুলে নেন টাইগার অধিনায়ক। যখন মনে হচ্ছিল ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ বাংলাদেশের হাতে, তখনই গড়বড় পাকান তামিম। দলীয় ৯৯ রানের মাথায় নিজের উইকেটটি উপহারই দিয়ে আসেন প্রতিপক্ষকে। ধনঞ্জয়া ডি সিলভা বোলিং রানআপ শুরুর আগেই তামিম সরে যান অনসাইডে। যা দেখে চতুর ধনঞ্জয়া করেন ইয়র্কার লেন্থের ডেলিভারি। যা ঠেকাতে গিয়েও ব্যাটে লাগাতে পারেননি তামিম। বল আঘাত হানে প্যাডে, আউট দেন আম্পায়ার।

ব্যাটে লেগেছে ভেবে রিভিউ নিয়েছিলেন তামিম। কিন্তু টিভি রিপ্লেতে দেখা যায়, ব্যাট-বলের দূরত্ব ছিল স্পষ্ট। ফলে থেমে যায় তামিমের ৭০ বলে ৫২ রানের ইনিংস, নষ্ট হয় প্রথম রিভিউ। এরপর সবাইকে অবাক করে দিয়ে মুখোমুখি প্রথম বলেই স্কুপ খেলার চেষ্টা করেন পাঁচ নম্বরে নামা মোহাম্মদ মিঠুন। যা তার ব্যাটে-বলে হয়নি, লেগ বিফোর আউট দেন আম্পায়ার। তামিমের মতো মিঠুনও নষ্ট করেন আরেকটি রিভিউ।

দলীয় সংগ্রহ ১০০ হওয়ার আগেই ৪ উইকেট হারিয়ে তখন কঠিন চাপে বাংলাদেশ। সেখান থেকে দলকে উদ্ধার করেন ব্যক্তিগত সম্পর্কে দুই ভায়রা ভাই মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ ও মুশফিকুর রহীম। প্রতি ওভারে বাউন্ডারি হাঁকানোর চেয়ে এক-দুইয়ের দিকেই বেশি মনোযোগ দেন দলের অন্যতম অভিজ্ঞ এ দুই ব্যাটসম্যান। যার সুফলও পায় বাংলাদেশ।

মুশফিক-মাহমুদউল্লাহর জুটিতে ৪৩তম ওভারে দলীয় ২০০ রান পূরণ করে ফেলে টাইগাররা। ইনিংসের ৩১ থেকে ৪০ ওভার পর্যন্ত কোনো উইকেট না হারিয়ে ৬৯ রান পায় বাংলাদেশ। এরই মাঝে মুশফিক তুলে নেন ক্যারিয়ারের ৪০তম ফিফটি। মাহমুদউল্লাহকে নিয়ে দলকে নিয়ে যান বড় সংগ্রহ গড়ার কাছে। অসাধারণ ব্যাটিংয়ে সেঞ্চুরির কাছে পৌঁছে গেলেও, মুশফিকের ইনিংসের সমাপ্তি ঘটে দৃষ্টিকটু এক শটে। ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ যখন পুরোপুরি বাংলাদেশের হাতে, তখন রিভার্স সুইপ খেলতে গিয়ে শর্ট থার্ড ম্যানে দাঁড়ানো উদানার হাতে। ফলে সমাপ্তি ঘটে তার ৮৭ বলে ৮৪ রানের উজ্জ্বল ইনিংসের। যেখানে ছিল ৪টি চারের সঙ্গে ১ ছয়ের মারে। মাহমুদউল্লাহর সঙ্গে মুশফিকের জুটিটি ছিল ১০৯ রানের।

মুশফিক ফেরার পর খানিক মন্থর হয়ে যায় বাংলাদেশের ইনিংস। শেষ ৭ ওভারে স্কোরবোর্ডে যোগ হয় মাত্র ৪৯ রান। ক্যারিয়ারের ২৪তম ফিফটি করে ধনঞ্জয়ের তৃতীয় উইকেটে পরিণত হন মাহমুদউল্লাহ। আউট হওয়ার আগে তিনি করেন ৭৬ বলে ৫৪ রান। যেখানে ছিল ২ চার ও ১ ছয়ের মার। শেষদিকে আফিফ হোসেন ধ্রুবর ব্যাট থেকে আসে ২২ বলে ২৭ রানের ক্যামিও ইনিংস। বাঁহাতি পেস বোলিং অলরাউন্ডার মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন অপরাজিত থাকেন ৯ বলে ১৩ রানে। শ্রীলঙ্কার পক্ষে সফলতম বোলার পার্টটাইম স্পিনার ধনঞ্জয় ডি সিলভাই। তিনি ১০ ওভারে ৪৫ রান খরচায় নেন ৩টি উইকেট। সৌজন্যে :  জাগো নিউজ

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn