করোনাকালের শিক্ষাঙ্গন এবং আবুলের ছাগল বন্দি
রহিম আব্দুর রহিম – আর সময় নষ্ট নয়, মূল আলোচনা। চীনের উহানে আবিষ্কৃত করোনা নামক অদৃশ্য এক রোগের হাতে পৃথিবী হাবুডুবু খাচ্ছে। এই রোগের ভাইরাস, কখন কোন পাশ দিয়ে কিভাবে আসছে তার কোন হদিস নেই। বিশ্ব সওদাগর চীনের বাদশা করোনা তাড়াতে জারি করেছিলেন ‘লকডাউন’। অর্থাৎ ‘বন্ধাবস্থা’। শুরু হল পৃথিবী জুড়ে লকডাউনের মহাতাণ্ডব। বন্ধ হয়ে গেল স্কুল-কলেজ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। চালু থাকলো বাকি সকল প্রকার কর্মকাণ্ড। দীর্ঘ প্রায় ১৬ মাস ধরে প্রিয় স্বাধীন দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অচল। ঘুরছে না শিক্ষার চাকা। প্রায় ৪ কোটি বিভিন্ন শ্রেণি, বয়সের শিক্ষার্থীরা শিক্ষাদ্বার বন্ধ থাকায় কাণ্ডারহীন পরিবেশে সময় পার করছে। জুয়া, নেশা, ধর্ষণ, আত্মহত্যা, হতাশার মত জীবন বিধ্বংসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে জাতির ভবিষ্যৎ। সবচেয়ে বড় ক্ষতি হচ্ছে তাদের, যারা অনলাইন ক্লাসের জন্য পিতা-মাতার কাছ থেকে সারপ্রাইজ হিসেবে এনড্রয়েড মোবাইল পেয়েছে। হুজুজের দেশে বাঙালি জাতির ভাবি প্রজন্মের এই গ্রুপটি শিক্ষার নামে বাহারি প্রযুক্তিগত ক্রীড়া বিনোদন ও নীল জগতে প্রবেশ করেছে। আর যে গ্রুপটি অর্থের অভাবে একটি এনড্রয়েড মোবাইল ক্রয় করতে পারছে না, ওই গ্রুপের বড় অংশ একটি ফোন নাগালে পাওয়ার নেশায় বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চুরি, ছিনতাইর মত গ্যাং অপরাধে শামিল হচ্ছে। একটি শিক্ষাঙ্গন, শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের যে পরিবেশ দেয়, তা কোনভাবেই প্রযুক্তিগত পদ্ধতি দিতে পারে না। নীতি-নৈতিকতা এবং দেশাত্মবোধ সৃষ্টি হয় সামাজিকতার মাধ্যমে। দীর্ঘ প্রায় ১৬ মাসের ব্যবধানে শিক্ষার্থীরা সামাজিক যে পরিবেশ পেয়েছে, ওই পরিবেশ নীতি-নৈতিকতা বিবর্জিত এক অন্ধকার জগতের।
সবকিছু মিলে বলতে দ্বিধা নেই, গত ১৬ মাসের ব্যবধানে জাতিকে শত বছর পিছিয়ে পড়েছে। এর জন্য মূলত দায়ি কে? উত্তর সোজা-সাপটা, একটি জাতি-গোষ্ঠীর দিক নির্দেশক, বুদ্ধিজীবী, গবেষক, চিকিৎসক এবং রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলে আলোচিত বিশ্বমিডিয়া। যারা ব্যক্তি, গোষ্ঠী, সমাজ, রাষ্ট্র এবং বিশ্বপরিমণ্ডলের ভ্রান্ত পথ উত্তরণের দিক নির্দেশক হিসেবে কাজ করে। সেই দিক নির্দেশক পরিমণ্ডলের ভুল নির্দেশনায় আজ পৃথিবীর অন্যতম উন্নয়নশীল ‘বাংলাদেশ’ আজ শিক্ষাদ্বার বন্ধ রেখে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। খুঁড়িয়ে চলছে বললাম এই কারণে, করেনা ইস্যুতে দেশের প্রতিটি সেক্টর যথাযথ চললেও, চলছে না শুধুমাত্র শিক্ষা কার্যক্রম। একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়লে ওই দেশের উন্নয়ন শিকড় কোনভাবেই মজবুত থাকে না। বাংলাদেশে করোনাকালের শুরুতে সরকারের শিক্ষামন্ত্রীকে একটি মিডিয়ায় সংবাদ কর্মীরা এমনভাবে ঘিরে ধরেছিলেন যে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ না করা হলে যেন করোনার মহাসমুদ্রে দেশটা নিমিষে তলিয়ে যাচ্ছে। অথচ দীর্ঘ ১৬ মাসের ব্যবধানে ওই মিডিয়ার কোন সংবাদকর্মী দেশের অন্যান্য সেক্টরের মত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু রেখে এবং করোনা থেকে রেহাই পাওয়ার মত কোন দিক নির্দেশনা দিতে পারছে না। শুধু তাই নয়, পৃথিবীর সকল দেশই মহামারি বা কোন ক্রান্তিকালে একটি জাতীয় কমিটি গঠন করেন। যে কমিটি সকল প্রকার বাঁধা-বিপত্তি পাশ কাটিয়ে জীবন-যাত্রা সচল রাখার উপায় নির্ণয় করবেন। মজার এবং হাস্যকর ব্যাপার, সৃষ্ট করোনাকালের লকডাউন এবং স্কুল-কলেজ বন্ধ রাখা ছাড়া জাতীয় কমিটি ইতিবাচক কোন সিদ্ধান্ত আজ অবধি দিতে পারেনি। যখনই স্কুল-কলেজ চালু করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তখনই জাতীয় কমিটির ঘোষণায় করোনার প্রাদুর্ভাব মাত্রাধিক আকার ধারণ করে। অথচ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু রাখলে অতিদ্রুত গোটা জাতি করোনা সম্পর্কীয় সচেতনতায় স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিধি মানতে শতভাগ সচেষ্ট হতো। এটা কোন মনগড়া কথা নয়, বিশ্বের সকল ক্রান্তিকাল, মহামারি, দুর্যোগ, বন্যা, খরা, যুদ্ধ-বিগ্রহকালে ছাত্রসমাজ যে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছে, তা ইতিহাসের মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত। শুধুমাত্র করোনাকালে যাদের ভূমিকা শূন্যের কোঠায়।
বর্তমান সরকারের অনেক দৃশ্যমান উন্নয়ন ফিরিস্তি চাঁপা পড়ে যাচ্ছে করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখায়। গ্রাম-গঞ্জের তৃণ পর্যায়ে সরকারের কোন উন্নয়ন ফিরিস্তি নেই। আছে শুধু নেতিবাচক সমালোচনা। কেউ বলছেন হেফাজতিদের গ্রেপ্তার করতে সরকার স্কুল-কলেজ বন্ধ রেখেছে, কেউ বলছে ছাত্র আন্দোলনের ভয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অচল করে রাখা হয়েছে, আবার কেউ বলছে, লাখপতি-কোটিপতিদের সন্তানদের লেখাপড়া তো আর বন্ধ হয়নি, ভিক্ষুক জাতি সৃষ্টি করতে সরকার ইচ্ছা করেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখেছেন। এর মাঝেই কেউ আবার বলছেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সেনসিটিভ জায়গা, এই অঙ্গনের একজন শিক্ষক বা শিক্ষার্থী করোনায় আক্রান্ত হলে দায়ভার সরকারকে বহন করতে হবে, বিধায় সরকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখেছেন। যুক্তিতর্কে এটাও ওঠে আসছে যে, দীর্ঘ ১৬ মাসের ব্যবধানে যে ছাত্র সমাজ স্কুল চালু করার জন্য ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে রাজপথ গরম করতে পারেনি, ওই ছাত্র সমাজ ইস্যুবিহীন সরকার পতনের আন্দোলন করবে তা নিন্দুকরা না বুঝলেও সরকার বাহাদুর ঠিকই বুঝতে পারছেন।
একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে রাজাকার-আলবদর, আল শামস কিংবা পাক হানাদার বাহিনীরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ফাঁকা পেয়ে স্কুল-কলেজগুলোতে যেমন ক্যাম্প করেছিলো, তেমনি করোনাকালে দুঃখজনক হলেও সত্য যে, দেশের সকল গণযন্ত্রে ভাইরাস না ঢুকলেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যে করোনা ভাইরাস ক্যাম্প করেছে, এতে কোন সন্দেহ নেই। এই করোনা ভাইরাস থেকে দেশের শিক্ষা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে বাঁচাতে হলে এমন কিছু করা যায় কিনা?ক) শিক্ষার্থীদের সিফট অনুযায়ী সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে সপ্তাহে তিন দিন করে ক্লাস চালুর ব্যবস্থা। এক্ষেত্রে মেট্রোপলিটন শহরগুলোতে এলাকাভিত্তিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ওই অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের সমানুপাতিক হারে ক্লাসে বসানোর ব্যবস্থা।খ) প্রত্যেক শিক্ষার্থী স্ব স্ব গ্রামে স্কাউট, গার্লস গাইড এবং রোভার এর আদলে স্বাস্থ্যবিধি নিজে মেনে চলবে এবং গ্রামের মানুষদের সচেতন করবে। এতে করে তাদেরকে নাম্বার প্রদান করার ব্যবস্থা করা।
গ) ২ সপ্তাহ পর পর বিষয় রুটিন বদলিয়ে পাঠদান পদ্ধতি চালু রাখা এবং হোম ওয়ার্ক করানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা।ঘ) কোনভাবেই অটো-পাশ নয়। প্রত্যেকটি শ্রেণি এবং পাবলিক পরীক্ষা বিসিএস আদলে সংক্ষিপ্ত সময়ের ব্যবধানে এমসিকিউ বা লিখিত পদ্ধতিতে পরীক্ষা গ্রহণের ব্যবস্থা।ঙ) শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু থাকবে, তবে কোন শিক্ষার্থী ওপর উপস্থিতি নিশ্চিত করতে কড়াকড়ি নিষেধ না রাখা। তবে প্রতিষ্ঠানে উপস্থিত শিক্ষার্থী, শিক্ষকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষাবিধি পালনে বাধ্য করা। এতে করে সত্যিকার আগ্রহী এবং সাহসী শিক্ষার্থীদের খুঁজে বের করা এবং রাষ্ট্রীয় দায়ভার মুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব। তবে কোন অঞ্চলে করোনার মত মহামারির প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে ওই অঞ্চলে ‘লকডাউন’র পরিবর্তে ‘স্থিতাবস্থা’ অর্থাৎ সুস্থ এলাকার লোকজনরা আক্রান্ত এলাকায় যাবে না, আক্রান্ত এলাকার লোকজনরা সুস্থ এলাকায় যাবে না।এক এলাকায় আক্রান্তের জন্য সারাদেশের মানুষ যাতে হয়রানির শিকার না হয়, সে বিষয়টি নজরে আনা। কোনভাবেই একটি জাতির ‘মেরুদণ্ড শিক্ষা’র কারখানা ‘শিক্ষাঙ্গন’ বন্ধ রাখা সমীচীন নয়। এক্ষেত্রে আর কোন কমিটির বাণী কিংবা দ্বার বন্ধের কারিগরদের সুপারিশ নয়। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীকেই ঝুঁকি নিতে হবে। যাতে বাংলাদেশের প্রেসক্রাইব করোনাযুক্ত বিশ্বের অন্যান্য দেশের টেকনিক্যাল কমিটি গ্রহণ করে। এমনটাই সময়ের দাবি।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব sunamganjbarta.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sunamganjbarta.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।