ওয়েছ খছরু-পান্না বেগম। বয়স উনিশ বছর। কিন্তু তেরো বছর বয়সেই বাসার মালিক মোবাশ্বিরের নজর পড়ে তার ওপর। আদরের ছলে নানা ভাবে যৌন হয়রানি করে। এতে বিরক্ত ছিল পান্নাও। এক পর্যায়ে বাসার কেয়ারটেকার রবিউলের কাছে তার মেয়ে পান্নাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন মোবাশ্বির। দেখান নানা প্রলোভনও। এতে রাজি হয়ে যান পান্নার পিতা। মাওলানা ডেকে বিয়ে পড়ান। একটি এফিডেভিটও করেন। কিন্তু কাবিন করেননি মোবাশ্বির। পরিবারকেও জানাননি এই বিয়ের কথা। এরপর থেকে সবার অগোচরে স্বামী-স্ত্রীর মতো জীবনযাপন ছিল তাদের। কিন্তু পান্না এতে বিরক্ত ছিল। এরপরও অসহায় পিতা-মাতা ও পরিবারের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে সে কিছু বলেনি। বরং বয়সের চেয়ে তিনগুণ বেশি পুরুষের শয্যা সঙ্গী হয়ে সে জীবনযাপন করছিল। কিন্তু সময় গেলেও স্বীকৃতি দিতে টালবাহানা করছিল মোবাশ্বির। সাম্প্রতিক সময়ে একখণ্ড জমি কিনে দিতে পান্নার মায়ের কাছ থেকে টাকাও নেন মোবাশ্বির। এরপর জমি কিনে দিতেও নানা নাটকীয়তা। পান্না বেগম হচ্ছেন দক্ষিণ সুরমার চান্দাই মিলিবাড়ি গ্রামের রবিউল ইসলামের মেয়ে।

ভূমিহীন রবিউল ছিলেন খুন হওয়া সিলাম শেখপাড়া গ্রামের আব্দুল হক মোবাশ্বিরের কেয়ারটেকার। ঘটনা গত শনিবারের। ওই দিন সন্ধ্যায় দক্ষিণ সুরমার ময়ূরকুঞ্জ কমিউনিটি সেন্টারের পাশের মোবাশ্বিরের বাগানবাড়িতে তার লাশ পাওয়া যায়। লাশের শরীরে আঘাতের চিহ্ন ছিল। মদের বোতলও পাওয়া যায় লাশের পাশ থেকে। শরীরের কাপড়ও ছিল অগোছালো। পুলিশ লাশ উদ্ধারের পরপরই ঘটনার অনুসন্ধান শুরু করে। প্রাথমিক তদন্তেই দ্বিতীয় স্ত্রী পান্নার সম্পৃক্ততার বিষয়টি তদন্তে মিলে। এরপর পুলিশ পান্নাকে আটক করে থানায় নিয়ে আসে।  রোববার পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদেই পান্না খুনের ঘটনা স্বীকার করে। রোববার সন্ধ্যায় সিলেটের জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট দ্বিতীয় আদালতে পান্না খুনের ঘটনা স্বীকার করে জবানবন্দিও দেয়। এরপর পান্নাকে কারাগারে পাঠিয়ে দিয়েছেন আদালত।

পুলিশ জানিয়েছে, গ্রেপ্তারের পর পান্না প্রথমে ঘটনাটিকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। খুনের ঘটনায় তার সম্পৃক্ততার বিষয়টি অস্বীকারও করে। এক পর্যায়ে সে খুনের ঘটনা স্বীকার করে। পান্না বেগম পুলিশকে জানিয়েছে, ঘটনার দিন শনিবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে মোবাশ্বির তাকে বাসা থেকে নিয়ে যায়। এরপর নগরীর হাউজিং এস্টেট সহ বিভিন্ন স্থানে তাকে নিয়ে ঘুরাঘুরি করে। তারা হোটেলে খাবারও খায়। দুপুরের মধ্যে পান্নাকে নিয়ে  মোবাশ্বির চলে যায় দক্ষিণ সুরমার ধোপাঘাটের ময়ূরকুঞ্জ কমিউনিটি সেন্টারের পাশে ব্যক্তিগত হাউজিংয়ে। ওই জায়গাটা নিরিবিলি। হাউজিংয়ের চারদিক দেয়াল ঘেরা। এ কারণে কেউ ওদিকে যান না। ওখানে একটি অস্থায়ী ঘরও আছে।  মোবাশ্বির মদ খায়। সে হাউজিংয়ের ওই ঘরে মদ নিয়ে যায়। পান্না সেটি জানতো যে মোবাশ্বির মদ খাবে। এ জন্য সে মোবাশ্বিরকে খুন করতে আগে থেকেই খুনের পরিকল্পনা করে রেখেছিলো। মোবাশ্বির যখন মদ খেয়ে মাতলামি শুরু করে তখন মদের সঙ্গে মোবাশ্বিরকে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দেয় পান্না বেগম। ঘুমের ওষুধ মেশানো মদ খেয়ে অচেতন হয়ে পড়েন মোবাশ্বির। আর ওই সময় মোবাশ্বিরকে প্রায় ২০ মিনিট বালিশ চাপা দিয়ে রাখে পান্না। পরে তার গলায় কারেন্টের তার পেঁচিয়ে ধরে। এক পর্যায়ে রড দিয়ে তার শরীরে ৪-৫টি আঘাত করে। এতে নিস্তেজ হয়ে পড়ে মোবাশ্বিরের দেহ। পান্না এর পর তার আর কোনো সাড়া-শব্দ পায়নি।

খুনের ঘটনার পর পান্না ওই হাউজিং কোম্পানি থেকে বেরিয়ে যায়। এদিকে খুনের ঘটনার দিন দুপুরের পর থেকে মোবাশ্বিরকে খুঁজে না পেয়ে তার পরিবারের লোকজন খোঁজাখুঁজি শুরু করেন। মোবাইল ফোনও বন্ধ পাওয়া যায়। বিকালে হাউজিংয়ের কেয়ারটেকার প্রথমে মোবাশ্বিরের লাশ দেখেন। পান্না পুলিশকে জানিয়েছে, ক্ষোভ থেকেই সে মোবাশ্বিরকে খুন করেছে। কারণ শিশুকাল থেকেই মোবাশ্বির গরিব বলে তাকে উত্ত্যক্ত করতো। বয়স যখন ১৩ বছর হয় তখনই তার ওপর কু-নজর পড়ে মোবাশ্বিরের। তার পিতা-মাতাকে ম্যানেজ করে বিয়ে করলেও কখনো স্বীকৃতি দেয়নি। সময়-অসময়ে সে পান্নাকে ডেকে নিয়ে আসতো। তার সঙ্গে অমানবিক আচরণ করেছে। উন্মত্ত যৌনাচার করেছে। এসব আচরণ পান্নার সহ্য হতো না। মোবাশ্বির কথা দিয়েছিল বিয়ের পর তার পিতা-মাতাকে জমি দেবে। কিন্তু জমি না দিয়ে উল্টো টাকা নিয়েছে। টাকা নেয়ার পরও জমি দিতে টালবাহানা করছিল। এ কারণে তার পিতা-মাতার পরিবারে অশান্তি লেগেই ছিল। এসব কারণেই সে মোবাশ্বিরকে খুন করেছে বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানায়।

সিলেটের দক্ষিণ সুরমা থানার ওসি কামরুল ইসলাম জানিয়েছেন, পান্নাকে গ্রেপ্তারের পর সে প্রথমে খুনের ঘটনা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। পরে অবশ্য সব খুলে বলেছে। পরে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছে। তিনি বলেন- ঘটনার তদন্ত দ্রুত শেষ করে পুলিশ আদালতে চার্জশিট দাখিল করবে। পান্না ক্ষোভ থেকে একাই এ ঘটনা ঘটিয়েছে বলে জানিয়েছে। এখন পান্নার বক্তব্য পর্যালোচনা এবং পারিপার্শ্বিক তদন্ত শেষ করা হবে বলে জানান তিনি।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn