শুভ্র দেব-খিলক্ষেত এলাকার ভাড়া বাসায় সাথী আক্তার নামের এক নারীর মরদেহ পায় পুলিশ। মরদেহের মোটিভ ছিল আত্মহত্যার। এ ঘটনায় সাথীর ভাই খিলক্ষেত থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। মামলায় আসামি করেন তার দ্বিতীয় স্বামী জোবায়ের হোসেন শুভ (২৩)কে। সেই মামলার তদন্ত শুরু করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা এটি হত্যা না আত্মহত্যা বুঝে উঠতে পারছিলেন না। মামলার ছায়া তদন্ত শুরু করে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। গভীর তদন্তে ডিবির তদন্ত সংশ্লিষ্টরা ক্লু পান এ ঘটনায় পেছনে সাথীর দ্বিতীয় স্বামীর হাত থাকতে পারে।

কারণ ঘটনার পর থেকে সে পলাতক। প্রযুক্তির সহযোগিতা নিয়ে ডিবি হাটহাজারী থানার গাজী কালুসার হঠাৎ কলোনি থেকে শুভকে গ্রেপ্তার করে। পরে ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে শুভ হত্যার দ্বায় স্বীকার করে। আদালতেও স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। সে জানিয়েছে, ডিভোর্সের পরও তারা একসঙ্গে লিভটুগেদার করছিল। এমনকি প্রথম স্বামীর সঙ্গে ডিভোর্সের পরও তার অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ছিল। নানা বিষয়ে মনোমালিন্য ও ঝগড়াঝাটির কারণেই সাথীকে সে হত্যা করেছে। আর ধরা পড়ার ভয়ে আত্মহত্যার নাটক সাজিয়ে পালিয়েছে।

ডিবির তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০১৮ সালে শুভ’র সঙ্গে ফেসবুক ও টিকটকের মাধ্যমে পরিচয় হয় সাথীর। স্বামী প্রবাসী ও দীর্ঘদিন ধরে দেশে না আসায় সাথী ফেসবুক ও টিকটক নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সারাদিন ফেসবুক চালাতো আর টিকটক ভিডিও তৈরি করে ফেসবুকে আপলোড করতো। সাথীর বিভিন্ন ছবি ও ভিডিওতে শুভ লাইক কমেন্ট করতো। লাইক কমেন্ট করতে করতে মেসেঞ্জারে চ্যাটিং, অডিও কলে কথা বলা শুরু করে তারা। সাথী থাকতো তার শ্বশুরবাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। আর শুভ থাকতো বগুড়া। তখন তারা দু’জনেই ব্যক্তিগত সুখ দুঃখের কথা শেয়ার করতো। একজনের প্রবাসী স্বামী বিয়ের পর আর দেশে আসেনি। আর আরেকজনের স্ত্রীকে তিন মাসের মাথায় ডিভোর্স দিতে হয়েছে। এভাবে তাদের মধ্যে সখ্যতা গড়ে ওঠে।

একপর্যায়ে তারা বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়। সাথী তার আগের স্বামীকে ২০২০ সালের মে মাসে ডিভোর্স দিয়ে সেপ্টেম্বর মাসে শুভকে বিয়ে করে। বিয়ের পরপরই তাদের মধ্যে মনোমালিন্য শুরু হয়। কারণ সাথীর প্রথম স্বামী বিদেশে থাকতো। শ্বশুরবাড়ি থেকে স্বামীর টাকায় সে ভালোই চলতো। অথচ শুভ’র আয় ইনকাম ছিল না। নানা বিষয় নিয়ে তাদের মধ্যে ঝামেলা হতো। কিছুদিন পর তারা দু’জনে বগুড়া থেকে চট্টগ্রামে এসে গার্মেন্টসে চাকরি নেয়। সাথীর চাকরি ভালো লাগেনি তাই শুভকে কিছু না বলে চলে আসে রাজশাহী। আসার সময় শুভর একটি মোবাইলও নিয়ে আসে। সেই মোবাইলে শুভর আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুদের মোবাইল নম্বর ছিল। সাথী ওইসব নম্বরে যোগাযোগ করতো। এ ছাড়া সাথীর স্মার্টফোনে শুভর একটি ইমেইল আইডি খোলা ছিল। ওই ইমেইল আইডি দিয়ে শুভর ফেসবুকে ঢুকে তার বন্ধুদের মেসেজ দিয়ে উল্টাপাল্টা কথা বলতো। এসব বিষয় নিয়ে তাদের দু’জনের মধ্যে ঝগড়া হতো।

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানায়, ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষের দিকে সাথী তাকে ডিভোর্স লেটার পাঠায়। ডিভোর্সের পরও সাথী তার আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের ফোন দিয়ে মানহানিকর কথা বলতো। কিছুদিন পর সাথী পুনরায় আগের মতো তার সঙ্গে কথা বলা শুরু করে এবং একসঙ্গে থাকার আশ্বাস দিয়ে শুভকে ঢাকায় আসতে বলে। শুভ সাথীর আশ্বাসে গত ২৬শে অক্টোবর ঢাকায় আসে। পরে স্বামী-স্ত্রী পরিচয় দিয়ে দু’জনে ৭ হাজার টাকায় খিলক্ষেতের বাসা নং-ক/২০৫/এইচ/২ দর্জি বাড়ি রোড এলাকায় বাসা ভাড়া নেয়। সেখানেই দু’জন থাকতে শুরু করে। বাসায় ওঠার পর সাথীকে পুনরায় বিয়ের কথা বলে শুভ। সাথী তখন তার এই কথা এড়িয়ে গিয়ে বলে তারা এভাবেই লিভ টুগেদার করবে। সাথী তার আগের প্রবাসী স্বামীর সঙ্গেও যোগাযোগ শুরু করে। ভিডিও কলে খোলামেলা হয়ে কথা বলতো। এ ছাড়াও আরও অনেক ছেলের সঙ্গে কথা বলতো। বাধা দেয়া সত্ত্বেও টিকটকে ভিডিও বানাতো। যখন তখন বাহিরে যাতায়াত করতো। এসব বিষয় সহ্য করতে পারতো না শুভ। সাথীর নানা রকম টর্চারে দিনে দিনে ক্ষোভ বাড়ে শুভ’র। ঘটনার দিন ১৪ই সেপ্টেম্বর সকালে তারা দু’জন একসঙ্গে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা করে।

বিকালে শুভ নিজ হাতে চা বানিয়ে সাথীকে দেয়। তখন কিছু কিনে আনার জন্য সাথীর কাছে শুভ টাকা চায়। কিন্তু সাথী বলে তার বিকাশে মাত্র ২ হাজার টাকা আছে। এটা দিয়ে পুরো মাস চলতে হবে। শুভ তখন বলে আমি তোমার বিকাশে চার হাজার টাকা দেখেছি। তোমার আগের স্বামী পাঠিয়েছে। সেই টাকা কি করছো? এই কথা বলার পর কোনো উত্তর না দিয়ে তার পরিবার তুলে বিভিন্ন ভাষায় গালিগালাজ শুরু করে সাথী। তাকে বাসা থেকে বের করে দেয়ার হুমকি দেয়। এ সময় সাথীর কাছ থেকে শুভ জোর করে তার স্মার্টফোন নিয়ে বন্ধ করে দেয়। এতে করে দু’জনের মধ্যে ঝগড়া আরও বেড়ে যায়। একপর্যায়ে সাথী তার গায়ে হাত তুলে। তখন স্মার্টফোনটি সে দিয়ে দেয়। ফোন হাতে পেয়ে জানালার পাশে বসে সাথী টিকটক ভিডিও তৈরি করছিল। সহ্য করতে না পেরে ওইদিন রাত ১০টা ২০ মিনিটের সময় সাথীকে হত্যা করে।

ডিবি জানায়, রাতের বেলা শুভ ও সাথী বিছানায় শুয়ে ছিল। সাথীর ওড়না বিছানার উপর ছিল। শুভ ওড়না হাতে নিয়ে সাথীর পেছন থেকে গলায় শক্ত করে পেঁচিয়ে ধরে। তখন ধস্তাধস্তি শুরু হয়।  একপর্যায়ে শুভ আরও শক্ত করে ধরতে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে কয়েক মিনিটের মধ্যে সাথী মারা যায়। নড়াচড়া না করাতে শুভ সাথীকে ছেড়ে দেয়। সাথীর মরদেহ তখন ফ্লোরে পড়ে যায়। পুলিশের কাছে ধরা পড়বে এমন ভয়ে শুভ আত্মহত্যার নাটক সাজায়। সাথীর বগলের নিচে ধরে টেনেহিঁচড়ে বাথরুমে নিয়ে যায়। গলায় পেঁচানো ওড়নাটি দিয়ে বাথরুমের ভেন্টিলেটরের রডের সঙ্গে ওড়নাটির এক মাথা বাঁধে এবং অন্য মাথা দিয়ে ওড়না গলায় গিঁট দিয়ে ঝুলিয়ে দেয়। ঝুলানোর পর সাথীর পা বাথরুমের ফ্লোরে লেগে গেলে শুভ পরিকল্পনা বদলায়। রান্নাঘরে থাকা সবজি কাটার বঁটি দিয়ে ওড়নার মাঝখানে কেটে দেয়। এতে এক পা বাথরুমের ভেতরে থাকে আর মাথা বাথরুমের দরজার দিকে হেলে পড়ে যায়। পরে বাথরুমের দরজার ছিটকিনি সবজি কাটার বঁটি দিয়ে ভাঙে।

ডিবির ক্যান্টনমেন্ট জোনাল টিমের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার এসএম রেজাউল হক বলেন, আত্মহত্যার নাটক সাজিয়ে শুভ বাসা থেকে তার কাপড় এবং সাথীর ব্যবহৃত দুটি মোবাইল ফোন নিয়ে রাত সাড়ে ১০টার দিকে বাসা থেকে বের হয়। তারপর রামপুরায় এসে তার খালার কাছ থেকে ১ হাজার টাকা নিয়ে চট্টগ্রাম চলে যায়। পরে সেখান থেকে জানতে পারে তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। পুলিশ তাকে খুঁজছে। এই খবর পেয়ে শুভ সাথীর মোবাইল ফোন চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী থানার বালুচড়া নতুন পাড়ার একটি ক্যানেলের পানিতে ফেলে দেয়। পরে ওই এলাকার একটি ফসলের মাঠ থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে।

ডিবির গুলশান বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মশিউর রহমান  বলেন, ঘাতক খুব নিখুঁতভাবে সাথীকে হত্যা করেছে। তদন্ত করতে গিয়ে আমরা কনফিউজড ছিলাম এটা হত্যা না আত্মহত্যা। পরে আমাদের তদন্তে বের হয়েছে এটি হত্যা। হত্যাকারী সাথীর দ্বিতীয় স্বামী। তিনি বলেন, বিবাহিত সম্পর্কে যারা অসম্মান করে বিশ্বাস করে না তাদের পরিণতি ভালো হয় না। তারা অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে আত্মহত্যা করে। না হয় হত্যার শিকার হয়।
 
ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার একে এম হাফিজ আক্তার  বলেন, সাথীকে হত্যার পর শুভ এমনভাবে নাটক সাজিয়ে রেখেছিল বোঝার উপায় ছিল না এটি হত্যাকাণ্ড। ভুক্তভোগী সাথীর স্বামী বিদেশে থাকায় সে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। সারাক্ষণই ফেসবুক, টিকটক নিয়ে ব্যস্ত থাকতো। যার কারণে সে অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। মূলত সামাজিক অবক্ষয় ও ডিজিটাল প্ল্যাটফরমের অপব্যবহারের কারণে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। আমরা ডিজিটাল প্ল্যাটফরমের অপব্যবহার রোধে কাজ করছি। মানুষকেও সচেতন হতে হবে। সুস্থ বিনোদনের সঙ্গে যুক্ত থাকতে হবে।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn