সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি : সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার লক্ষনশ্রী ইউনিয়নের নাউরিয়া জলমহালের ইজারাদারের কাছে মসজিদের নামে আড়াই লাখ টাকা চাঁদা দাবির অভিযোগ উঠেছে লক্ষণশ্রী ইউপি সদস্য আব্দুর রহিম (৪৫) এর বিরুদ্ধে। চাঁদা না দেয়ায় জলমহালের ইজারাদারের নৌকাসহ মালামাল সামগ্রী লুটতরাজ এবং জলমহালের পাহাড়াদারদেরকে প্রাণে হত্যার হুমকি দিয়ে আসেন এই ইউপি সদস্যের লোকজন। বিষয়টি নিয়ে সুনামগঞ্জ সদর থানায় লিখিত অভিযোগ দেন সুনামগঞ্জ শহরতলীর ইকবালনগর মৎস্যজীবি সমবায় সমিতি লিঃ এর ক্যাশিয়ার শান্তা মিয়া।
অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে সদর থানার অফিসার ইন-চার্জ বরাবরে গত ৪ অক্টোবর ১৪৬৪ স্মারকে লিখিত আদেশ দেন সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোঃ ইমরান শাহারীয়ার।অ ভিযোগ সুত্রে জানা গেছে, গত ১৮মে হাওয়াখাই প্রকাশিত নাউরিয়া জলমহালটি ইকবালনগর মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি লি. এর সভাপতি মোঃ সারজ আলীকে নগদ ইজারা মূল্য গ্রহনক্রমে ১৪২৮-১৪৩০ বাংলা সন মেয়াদে ইজারা দিয়েছেন সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার।
গত ২৭ মে সদর উপজেলা ভূমি অফিসের ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা মোঃ নুর আলী,সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নির্দেশে ইজারামূল্য গ্রহন শেষে নাউরিয়া জলমহালটির দখলনামা সমজিয়ে দেন। পরে সমিতির লোকজন জলমহালে কাটা, বাঁশ লাগিয়ে পোনা মাছ ছেড়ে রক্ষণাবেক্ষণ শুরু করেন , কিন্তু গত ২০ সেপ্টেম্বর লক্ষণশ্রী ইউপি সদস্য আব্দুর রহিম (৪৫) এর নেতৃত্বে তার ভগ্নিপতি আইন উদ্দিন (৪০), সাবেক মেম্বার শফিক মিয়া (৫৫), আতাবুল (৪০), নুর উদ্দিন (৩৮), আওলাদ মিয়া (৪৩) সহ একদল লোক দেশিয় অস্ত্র নিয়ে জলমহালের পাহাড়াদারদেরকে ভয় দেখিয়ে আসে। গ্রামের লোকজন ও মসজিদ কমিটিকে টাকা না দিলে জলমহালে ইজারাদারদেরকে থাকতে দেয়া হবে না বলেও হুমকী দেয় এরা। টাকা প্রদানে ব্যর্থ হলে মসজিদের নামে জলমহালটি নি:শর্তভাবে ছেড়ে দেয়ার জন্য ইজারাদার সমিতির লোকজনকে নির্দেশ দেন সাবেক মেম্বার শফিকুল ইসলাম।
এইভাবে গত কয়েক বছর ধরে মসজিদের নামে এই জলমহালের ইজারাদারদের কাছ থেকে চাঁদা আদায়ের অভিযোগ রয়েছে । এদিকে সরকারি জলমহাল নিয়ে চাঁদা আদায়ের প্রস্তাবকারী অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে সদর থানার অফিসার ইন-চার্জকে লিখিতভাবে অনুরোধ করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। অভিযোগকারী শান্তা মিয়া বলেন, নাউরিয়া জলমহালটি সরকারের কাছ থেকে আমরা ইজারা নিয়েছি। কিন্তু স্থানীয় লক্ষণশ্রী ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ও বিএনপি নেতা আব্দুর রহিমসহ বাহদুরপুর জামে মসজিদ কমিটির লোকজন তাদের মসজিদের নামে আড়াই লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন। নইলে এই জলমহালে আমাদেরকে নামতে দিবে না বলে তারা হুসিয়ারি দেন। পরে চাঁদা না দেয়ায় এক পর্যায়ে অভিযুক্ত ইউপি সদস্য আব্দুর রহিমের আত্মীয় আইন উদ্দিনের কাছে মসজিদের নামে ইজারা দিয়ে দেন মসজিদ কমিটি। সরকারি জলমহাল মসজিদ কমিটি ইজারা দেয় কিভাবে? আর মেম্বার আব্দুর রহীমের ভগ্নিপতি আইন উদ্দিন মসজিদ কমিটির কাছ থেকে ইজারা নেয় কিভাবে? তা নিয়ে প্রশ্ন সরকারের কাছ থেকে পাওয়া ইজারাদারসহ স্থানীয়দের।
শান্তা মিয়া আরোও বলেন, আমরা গত ২৮ সেপ্টেম্বর সুনামগঞ্জ সদর মডেল থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করার পর থানা থেকে এসআই জাহাঙ্গীর আলমকে তদন্তের দায়িত্ব দিলে উভয় পক্ষকে থানায় এনে কাগজপত্র দেখে অভিযুক্তদেরকে জলমহালে যেতে নিষেধ দেন এই কর্মকর্তা। বিশেষ করে গত ১লা অক্টোবর সুনামগঞ্জ সদর মডেল থানা প্রাঙ্গনে অনুষ্ঠিত সালিশ বৈঠকে মসজিদ কমিটির সভাপতি ও সাবেক মেম্বার শফিক মিয়াসহ গ্রামবাসীকে বলা হয়, যতক্ষণ পর্যন্ত ইজারাদারদের ইজারা বহাল আছে ততক্ষণ পর্যন্ত মসজিদের নামে কেউ যেন জলমহালে গিয়ে ইজারাদার ও তাদের লোকজনকে জলমহালের ভোগদখলে বাধাপ্রদান না করে। ঐ সালিশী সভায় উপস্থিত ছিলেন এসআই জাহাঙ্গীর ও এসআই জিন্নাতুল ইসলাম। কিন্তু পুলিশ প্রশাসনের নিষেধ দেয়ার পরও গত ৮ অক্টোবর দুপুরে আইন উদ্দিনের নেতৃত্বে একদল লোক জলমহালের পাহাড়াদারদেরকে মারধর করে বিলে থাকা খলা (ঘর) ভাঙচুর করেন। সদর থানার এসআই কামরুল ইসলাম ঘটনাস্থলে গিয়ে তার সত্যতা পান।
তিনি বলেন,২৮ সেপ্টেম্বর দায়েরকৃত লিখিত অভিযোগটি এফআইআর করলে মসজিদ কমিটির নামে এরা আমাদের ক্ষতিসাধন করতে পারতনা। বরং আমাদের দায়েরকৃত অভিযোগ আমলে না নিয়ে অভিযুক্তদের সামনে আমাদেরকে থানার ওসি তদন্ত স্যার অপমানসহ নানা ধরণের খারাপ আচরণ করে মসজিদ কমিটির সঙ্গে আলোচনা করে জলমহালটি দিয়ে আসার কথা বলেন। এবং আমরা মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির ইজারাগ্রহীতাদের বিপক্ষে মামলা এফআইআরের লক্ষে উনার কাছে কাউন্টার লিখিত অভিযোগ দায়েরের জন্য উনি উস্কানী দেন আমাদের প্রতিপক্ষকে।
ইজারাদার সমিতির সদস্য আলাউর রহমান অভিযোগ করে জানান, নাউরিয়া বিল নিয়ে ৯ অক্টোবর সদর মডেল থানার ওসি (তদন্ত) সাহেবের রুমে এক সালিশ বৈঠক হয়। এতে ওসি তদন্ত ইজারাদারদের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দায়েরের জন্য মসজিদ কমিটির লোকজনদেরকে উস্কানী দিয়েছেন। এতে আমরা ভীত হয়েছি। ওসি উভয় পক্ষকে থানায় ডাকেন। থানায় আসার পরে তিনি দুই পক্ষের কাগজপত্র দেখেন । মসজিদ কমিটি কোনো কাগজপত্র দেখাতে পারেনি। ইজারাদার হিসেবে আমরা সঠিক কাগজপত্র দেখাই। তারপর ও ওসি স্যার খারাপ আচরণ করেন। বলেন, ইকবালনগর থেকে বাদুরপুর গিয়ে বিল খাইতে (খেতে) পারবেন না। বরং মসজিদ কমিটির সাথে বসে তাদেরকে জলমহালটি দিয়ে আসেন। ইউপি সদস্য আব্দুর রহিম বলেন, জলমহালটি মসজিদের। সামান্য জায়গা সরকারি। সরকার ইজারা দিছে ভালো কথা। আমরা চেয়েছি ইজারাদারদেরকে ম্যানেজ করে তুলে দিতে কিন্তু পারছি না। এই বিল আমরা শতবছর ধরে ভোগদখল করছি। তিনি বলেন, ওসি তদন্ত সাহেবের কাছ থেকে সময় নিয়েছি। ওসি সাহেব আমাদেরকে পরামর্শ দিয়েছেন আইনিভাবে এগুতে। আমরা সেভাবে এগোচ্ছি। কোন ওসি ?জানতে চাইলে তিনি বলেন, ফর্সা লোক এবং গত শনিবার রাতে যার সাথে উভং পক্ষ মিটিং এ বসেছিলাম তিনি। ইউপি সদস্য আব্দুর রহিম বলেন, খুব শিঘ্রই আমরাও মামলা করবো।
ইজারাদারদের দায়েরকৃত অভিযোগের প্রধান আসামী বাহাদুরপুর গ্রামের আইন উদ্দিন বলেন, গত ২৪ সেপ্টেম্বর বাদুরপুর গ্রামের বড় মাদ্রাসা মসজিদে বসে মসজিদ কমিটির কাছ থেকে ২ লাখ ২৩ হাজার টাকা ইজারামূল্যে আমি বিরোধীয় জলমহালটি ইজারা নিয়েছি। মসজিদ কমিটির সভাপতি হিসেবে সাবেক মেম্বার সফিকুল ইসলাম শফিক মিয়া আমার পক্ষে মৌখিকভাবে ইজারা মঞ্জুরী ঘোষনা করেছেন। ঐসময়ে ইকবালনগর মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির ১০ জন প্রতিনিধি ছিলেন। তারা মসজিদের ডাকে সাড়া না দিয়ে সরকারী ডাকের দোহাই দিলে তাদের পক্ষে সমবেত মুসল্লীয়ানরা উত্তেজিত হয়। তারা যদি ২ লাখ ২৫ হাজার টাকা ডাক ধরতো তাহলে হয়তো মসজিদ কমিটি তাদেরকেই জলমহালটি লীজ দিত। তারা শারীরিকভাবে মসজিদে বসার পরও মসজিদের প্রকাশ্য নীলামে অংশ না নেওয়ায় আমি ইজারা পেয়েছি। তাই আমি আমার ইজারাপ্রাপ্ত জলমহালটি ভোগদখলে নেয়ার চেষ্টা করছি।
কেন এবং কিভাবে কোন আইন ও ক্ষমতা বলে,সরকারী জলমহাল মসজিদ কমিটির নামে মসজিদে বসে ইজারা দিয়ে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ও ধর্মীয় উস্কানী দিয়ে যাচ্ছেন জানতে চাইলে সাবেক মেম্বার সফিকুল ইসলাম শফিক মিয়া তার বিরুদ্ধে আনীত সকল অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, এটা আমার ব্যক্তিগত বিষয় নয় সমগ্র গ্রাম ও মসজিদ কমিটির সামগ্রিক বিষয়। অভিযোগের তদন্তকারী কর্মকর্তা সদর থানার এসআই জাহাঙ্গীর আলম বলেন, গ্রামের বর্তমান ও সাবেক মেম্বারসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে গত ২৮/৯/২০২১ইং তারিখে ইজারাদারদের পক্ষ থেকে দায়েরকৃত অভিযোগ তদন্ত করে এসেছি। ইজারাদাররা তাদের সমিতি ও জলমহাল ইজারা গ্রহনের কাগজপত্র দেখালেও অভিযুক্তরা কোন কাগজপত্র দেখাতে পারেনি। ইজারাদারের সকল কাগজপত্র পেয়েছি।
চাঁদা দাবি প্রসঙ্গে তদন্তকারী কর্মকর্তা বলেন,তদন্তে গিয়ে মসজিদ কমিটির নামে ২ লাখ ২৩ হাজার টাকা চাঁদা দাবির সত্যতা পান বলে জানান এই তদন্ত কর্মকর্তা। এ ব্যাপারে সুনামগঞ্জ সদর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোঃ সহিদুর রহমান বলেন, মামলার তদন্ত চলছে। আমরা অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেব। সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইমরান শাহারীয়ার বলেন, সরকারি জলমহালে চাঁদা দাবি এটা মেনে নেয়া হবে না। জলমহালের বিষয়টি নিয়ে সদর থানার অফিসার ইন-চার্জকে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ করেছি। এরপরও আমরা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করবো। সুনামগঞ্জের পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান জানান, বিষয়টি আমার জানা নেই। বিষয়টি নিয়ে ওসি সদরের সাথে কথা বলেন। তবে জলমহাল নিয়ে পুলিশের বিষয় নয়, এটা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বা জেলা প্রশাসনের দায়িত্ব। তারা এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিবেন।
সংবাদ টি পড়া হয়েছে :
১৮০ বার