ক্ষমতাকে জনগণের সেবা করার সুযোগ মনে করেছি বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ২১ বছর পর আমরা জনগণের ভোটে রাষ্ট্র পরিচালনার সুযোগ পাই। জনগণ আমাদের ওপর আস্থা রেখে বার বার ভোট দিয়ে সরকার গঠনের সুযোগ দিয়েছে। যার কারণে আজ আমরা উন্নয়নের মহাসড়কে। ১২ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছে। তিনি বলেন, ক্ষমতাকে জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনের সুযাগ মনে করি। দারিদ্র্যের হার ২০ শতাংশে নামিয়ে আনতে পেরেছি। করোনা মহামারি না থাকলে এটাকে ১৭ ভাগে নামিয়ে আনতে পারতাম।
বিশ্বব্যাপী মন্দার মধ্যেও আমরা দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী দেশ। বিশ্বের ৪১টি অর্থনৈতিক শক্তিশালী দেশের মধ্যে বাংলাদেশ একটি। একইসঙ্গে তিনি জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা বিশ্বে মাথা উঁচু করে চলবে বলে আশা প্রকাশ করেন। গতকাল স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষে জাতীয় সংসদে বিশেষ আলোচনার জন্য সাধারণ প্রস্তাব উপস্থাপনকালে তিনি এসব কথা বলেন। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে অধিবেশনের শুরুতে স্মারক বক্তৃতা দেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। এরপর অধিবেশন ২০ মিনিটের জন্য মুলতবি করেন স্পিকার। পরে সংসদের বৈঠক শুরু হলে সংসদের কার্যপ্রণালী বিধির ১৪৭ বিধিতে প্রস্তাব তোলেন সংসদ নেতা শেখ হাসিনা। ওই প্রস্তাবের ওপর সরকার ও বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা আলোচনায় অংশ নেবেন।
আজ বিশেষ আলোচনা শেষে প্রস্তাবটি কণ্ঠভোটে পাসের জন্য উপস্থাপন করা হবে। অতীতের রেওয়াজ অনুযায়ী বিশেষ আলোচনা শেষে প্রস্তাবটি সর্বসম্মতক্রমে গৃহীত হতে পারে। প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদ্যাপনের এ ঐতিহাসিক মাহেন্দ্রক্ষণে তারুণ্যদীপ্ত বাংলাদেশ সব চ্যালেঞ্জে উত্তরণ ঘটিয়ে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত, শোষণ ও বৈষম্যহীন, উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ- জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা রূপে বিশ্বসভায় মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হোক- এই হোক আমাদের প্রত্যয়। এ সময় তিনি বাংলাদেশকে এগিয়ে নেয়ার পরিকল্পনার কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ২০৪১ সালে বাংলাদেশকে কীভাবে দেখতে চাই সেই পরিপ্রেক্ষিতে পরিকল্পনাও আমরা করে রেখেছি।
জলবায়ু পরিবর্তন থেকে আমাদের প্রজন্মের পর প্রজন্ম যেন বেঁচে থাকতে পারে সে লক্ষ্যে এ ব-দ্বীপকে সুন্দরভাবে গড়ে তোলার জন্য ডেল্টা প্ল্যান-২১০০ আমরা গ্রহণ করে বাস্তবায়নে কাজ শুরু করেছি। তিনি বলেন, জলবায়ুর প্রভাব মোকাবিলার লক্ষ্যে ‘ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০’ প্রণয়ন করা হয়েছে। করোনা অতিমারির সংকট উত্তরণে ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ অর্থনীতির চালিকাশক্তি সচল রেখেছে। মেট্রোরেল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কর্ণফুলী টানেলসহ নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ বিশ্বে বাংলাদেশের সক্ষমতা প্রমাণ করেছে।
দীর্ঘদিন দেশ চালানোর অভিজ্ঞতা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রতিটি ক্ষেত্রে যখন কোনো কাজ করতে যাই, দেখতে পাই সেটার ভিত্তি জাতির পিতা তৈরি করে দিয়ে গেছেন। আমার কাছে বিস্ময় মনে হয়, এত অল্প সময়ে কীভাবে এত কাজ করে যেতে পারলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য, যখন তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ে তুলছিলেন তখন কিছু লোক অস্থিরতায় ভুগছিলেন। পাকিস্তান হানাদাররা সারেন্ডার করেছিল ঠিকই, কিন্তু তারা তাদের কিছু দালাল যুদ্ধাপরাধী রেখে যায়। তারা আমাদেরই মুক্তিযুদ্ধের অংশকে হাতিয়ে নিয়ে দেশে অরাজকতা সৃষ্টির চেষ্টা চালায়। এত অল্প সময়ের বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাটা তাদের সহ্য হয়নি। দেশ স্বাধীন হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াবে, তা পাকিস্তানি দোসররা মানতে পারেনি।
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বলেন, আমরা প্রতীক্ষায় ছিলাম কখন আমাদের পিতা ঘরে আসবেন। আমরা বাবাকে পাই পরে। জনগণ পায় আগে। তার কাছে জনগণই ছিল বড়। বঙ্গবন্ধুর আকাঙ্ক্ষা ছিল দেশটাকে গড়ে তুলবেন। বাংলাদেশকে সাজাবেন। যেন প্রতিটি মানুষ নাগরিক সুবিধা পান। জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য তিনি মাত্র সাড়ে তিন বছর সময় পেয়েছিলেন। দেশের উন্নয়নে তিনি স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করে কাজ করতে শুরু করেন। একটি প্রদেশ থেকে দেশে উন্নীত করার যত আইন, নিয়ম নীতিমালা সবই তিনি করে দিয়ে যান।
বঙ্গবন্ধুর সরকারের সময় নানা ষড়যন্ত্রের প্রসঙ্গ টেনে শেখ হাসিনা বলেন, চক্রান্ত মোকাবিলা করেই জাতির পিতা দেশকে গড়ে তুলছিলেন। যেন কারও কাছে হাত পাততে না হয় তার জন্য তিনি দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি দেন। ধনী দরিদ্রের বৈষম্য দূর করতে ক্ষমতাকে বিকেন্দ্রীকরণ করেন। স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করেন। বঙ্গবন্ধু যে কাজগুলো করতে চেয়েছিলেন-এর জন্য আরও পাঁচ বছর হাতে পেলে বাংলাদেশ উঠে দাঁড়াতো। আজ যে সম্মানজনক অবস্থানে আমরা আসতে পেরেছি, জাতির পিতা বেঁচে থাকলে সেই জায়গায় আমরা স্বাধীনতার ১০ বছরের মধ্যে পৌঁছে যেতে পারতাম।
সরকার প্রধান শেখ হাসিনা বলেন, যারা স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশ মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে যাক চায়নি, তারা এটা সহ্য করতে পারেনি। তারা নানা অপপ্রচার করেও যখন জনগণের সহায়তা পেলো না, তখনই পঁচাত্তরের ১৫ই আগস্ট নির্মমভাবে তাকে হত্যা করা হয়। তাকে হত্যার মধ্য দিয়ে দেশে বার বার ক্যু, মুক্তিযোদ্ধা, সাধারণ মানুষের মৃত্যু, সংবিধান ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। এতে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা ব্যাহত হয়েছে।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর আমাদের ভিক্ষুকের জাতিতে পরিণত করা হয়েছিল। দেশে প্রত্যাবর্তনের কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৮১ সালের ১৭ই মে নির্বাসন শেষে আমি আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সভাপতি হয়ে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করি। এরপর গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা, এদেশের মানুষের ভোট ও ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠাসহ আইনের শাসন ফিরিয়ে আনার সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করি। ফলে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয় গণতন্ত্র।
তিনি বলেন, ১৯৯৬ সালে সরকার গঠনের পর বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হয়। বিচার করা হয় যুদ্ধাপরাধীদের। ২০২১ সালের রূপকল্প বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশে স্বীকৃতি অর্জন করে। ২০০৮ সালের ঘোষিত ডিজিটাল বাংলাদেশ আজ বাস্তবতা। আমাদের স্বাধীনতার ফসল হচ্ছে এই সংসদ, এমনটা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা যে সংবিধান উপহার দিয়েছিলেন, সেই সংবিধানের ভিত্তিতে আমাদের নির্বাচন ও আজকের এই সংসদ। সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতের মধ্য দিয়ে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার সফল বাস্তবায়ন ও প্রত্যাশা পূরণে কার্যকর ভূমিকা রাখছে জাতীয় সংসদ। তিনি বলেন, আমরা ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারের রূপকল্প অর্জন করতে পেরেছি। জনগণ ভোট দিয়েছে বলে আমরা সুবর্ণ জয়ন্তী উদ্যাপন করতে পারছি।
রজতজয়ন্তী উদ্যাপনের সময়ও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল। এটাই আওয়ামী লীগের বড় প্রাপ্তি হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি। এর আগে ১৪৭ বিধিতে উত্থাপিত প্রস্তাবে বলেন, ‘সংসদের অভিমত এই যে, ২০২১ সালে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে সুবর্ণ জয়ন্তী উদ্যাপন বাঙালির জাতীয় জীবনে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। সমগ্র বিশ্বে বাংলাদেশ আজ এক ‘উন্নয়ন বিস্ময়’।’ প্রস্তাবটি তোলার আগে সংসদে ভাষণ দেয়ার জন্য রাষ্ট্রপতিকে ধন্যবাদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মহামান্য রাষ্ট্রপতির বক্তব্য সংসদের এ আলোচনাকে গৌরবান্বিত করেছে।
প্রধানমন্ত্রীর উত্থাপিত প্রস্তাবের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নেন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম, তোফায়েল আহমেদ, উপাধ্যক্ষ আবদুস শহীদ, মাহবুব-উল আলম হানিফ, র আ ম ওবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী, বেনজীর আহমেদ, সিমিন হোসেন রিমি, মীর মোস্তাক আহমেদ রবি, সাইমুম সরোয়ার কমল ও মো. ইকবাল হোসেন এবং জাতীয় পার্টির ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী।
সংবাদ টি পড়া হয়েছে :
১৫১ বার