মরিয়ম চম্পা-সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিনদেশিদের সঙ্গে পরিচয়। দুই-এক মাস, কখনো ৬ মাস কিংবা এক বছরের পরিচয়ের মাথায় হুট করে বাংলাদেশে আগমন। কখনো দিনমজুর, কখনো নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির ছেলে কিংবা মেয়েকে ঘটা করে বিয়ে করেন। চলতি বছরের জুলাই মাসেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি এবং মালয়েশিয়া থেকে বাংলাদেশে ছুটে  আসেন তিন তরুণ-তরুণী। তাদের কেউ আবার নিজ ধর্ম বদলে ঘটা করে বিয়ে করেছেন। তাদের অনেকেই সুখী জীবন-যাপন করলেও প্রতারণার নজিরও কম নেই। এটা এখন অনেকের কাছে স্বাভাবিক বিষয় বলে মনে হবে। কিন্তু এটা কী শুধুই প্রেমের টানে ছুটে আসা নাকি এর পেছনে কোনো ধরনের প্রতারণা লুকিয়ে আছে তা খোঁজার চেষ্টা করছে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, প্রচলিত আইনে এ ধরনের বিয়েতে কোনো বাধা না থাকায় কেউ কেউ আবেগের টানে প্রতারণার স্বীকার হচ্ছেন। বিয়ে করে কিছুদিন একসঙ্গে থেকে চলে যান নিজ দেশে।

এভাবে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন অনেকেই। এসব বিয়ের পাত্র-পাত্রীদের বেশির ভাগ পরিচয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কিংবা অনলাইনে। সাম্প্রতিক সময়ে বিদেশিরা এদেশে এসে বিভিন্ন ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়াচ্ছেন। তাদেরকে বেশির ভাগ সময় এখানকার তাদের সঙ্গী এবং ঘনিষ্ঠজনরা এ ধরনের অপরাধে সহায়তা করে থাকেন।  চলতি বছরের মাঝামাঝিতে প্রেমের টানে সুদূর ইতালি থেকে উড়ে এসেছেন আলী সান্দ্রে চিয়ারোমিন্তে নামে এক যুবক। গত ২৫শে জুলাই রাতে ঠাকুরগাঁওয়ের বালীয়াডাঙ্গীর ১৯ বছর বয়সী তরুণী রত্না রানী দাসের সঙ্গে সনাতন ধর্মের রীতি অনুযায়ী বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। রত্না রানীর বাড়ি ঠাকুরগাঁওয়ের বালীয়াডাঙ্গী উপজেলার চাড়োল ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের খোকোপাড়া গ্রামে। তার বাবা মারকুস দাস পেশায় একজন দিনমজুর। রত্নার পরিবার জানায়, তরুণীর এক চাচা ইতালি থাকেন। তার মাধ্যমেই ওই ইতালীয় নাগরিকের সঙ্গে মেয়ের পরিচয় হয়। অতঃপর মোবাইলফোনে তাদের কথাবার্তা হয়। বিয়ের আগের দিন দুপুর ১টায় বাংলাদেশে পৌঁছানোর পর তাদের বাড়িতে আসে সান্দ্রে। ধর্মীয় সব আইনকানুন মেনে ধুমধাম করে তাদের বিয়ে হয়। রত্না রানী জানান, সান্দ্রে তার চাচার মাধ্যমে মা-বাবাকে প্রস্তাব দেন। পরে তারা ইমোতে যোগাযোগ করেন। একে অন্যের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হয়। চাচা তাকে ইতালির কিছু ভাষা শিখিয়ে দিয়েছিলেন। সেগুলো দিয়ে তার সঙ্গে কথা হয়। এরপর বাংলাদেশে আসলে তাদের বিয়ে হয়। সান্দ্রে বাংলা ভাষা শেখার চেষ্টা করছে। এরআগে চলতি বছরের গত ১০ই জুলাই সুদূর আমেরিকা থেকে ঈদের দিন গাজীপুরের শ্রীপুরের যুবক ইমরানের কাছে ছুটে আসেন এক মার্কিন তরুণী। ইমরান গণমাধ্যমকে জানায়, ওই তরুণী আমেরিকান অঙ্গরাজ্য এরিজোনার বাসিন্দা। তার নাম লায়ডা এ লোজা (২৯)। বিয়ের পরে নাম রাখা হয়েছে লায়ডা এ লোজা খান। 

লোজা আমেরিকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। বাংলাদেশের যুবক ইমরান গাজীপুর জেলার শ্রীপুর উপজেলার বরমী ইউনিয়নের কুমারভিটা এলাকার মৃত জালাল উদ্দিন মাস্টারের ছেলে। তিনি ইস্ট ওয়েস্ট প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের চূড়ান্ত বর্ষের ছাত্র। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ফেসবুকের মাধ্যমে তার সঙ্গে পরিচয় হয়। সে থেকে পরিচয় ও প্রেমের সম্পর্কে গড়ায়। এরইমধ্যে লোজা একবার এ দেশে আসার চেষ্টা করলেও সমস্যা তৈরি হয়। সে সময় ইস্তাম্বুলে আটকা পড়েছিল কোভিড জটিলতায়। পরে তারা নেপালে দেখা করে সেখানে বিয়ে করেন। সে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে। ভিনদেশি লোজা মাঝেমধ্যে আমেরিকা যাবেন এবং বেশির ভাগ সময় স্বামী ইমরানের বাড়িতেই থাকবেন। শাশুড়ি সুস্থ হলে ইমরানকে নিয়ে আমেরিকায় বসবাস করবেন। একই মাসে মালয়েশিয়ান যুবতী এসেছেন গাজীপুর সিটির জোলারপাড় এলাকায়। বিয়ে করেছেন ধুমধাম করে। মসজিদে অনুষ্ঠিত এই বিয়েতে হাজির হয়ে গ্রামবাসী আনন্দ উল্লাস করেছেন। গোটা এলাকায় তাদের নিয়ে চলেছে উৎসবের আমেজ। মালয়েশিয়ার কামপুং কেলেওয়াক এলাকার বাসিন্দা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকুরে নুরকারমিলা বিনতে হামিদ গত ১৮ই জুলাই প্রেমের টানে ছুটে আসেন প্রেমিক গাজীপুরের জাহাঙ্গীর আলমের বাড়িতে। এখানে এসে মুগ্ধ তিনি। 

জাহাঙ্গীর মালয়েশিয়া থাকার সুবাদে তার প্রেমে পড়ে। নুরকারমিলার মতে, বাঙালি ছেলে জাহাঙ্গীর খুব ভালো, সৎ ও দায়িত্বশীল। একজন অপরজনকে গভীরভাবে চিনেছেন, জেনেছেন। তাই শুধু সবচেয়ে ভালো বন্ধু না ভেবে, জীবনসঙ্গী করতে এখানে ছুটে এসেছেন। ছেলের পরিবার বিয়ে দিয়েছেন ঘটা করে। এখন দু’জন স্থায়ী সংসার পাততে চান মালয়েশিয়াতে। একমাত্র ছেলে জাহাঙ্গীরের ইচ্ছা তার মাকেও নিয়ে যাবেন সে দেশে।  এরআগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্রাজিলের লুসি ক্যালেন ও বাংলাদেশের সাহেদ আহমেদের প্রণয়ের শুরু। ভালোবাসার টানে ব্রাজিল থেকে বাংলাদেশে চলে আসেন লুসি। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ধর্মান্তরিত হয়ে সাহেদকে বিয়ে করেন। বিয়ের কিছুদিন পর স্ত্রীর সঙ্গে ব্রাজিলে পাড়ি জমান সাহেদ। কিন্তু সেখানে গিয়ে ভিন্ন এক বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয় তাকে। জানতে পারেন, এর আগেও স্ত্রী লুসির বিয়ে হয়েছিল। এমনকি সন্তানও রয়েছে তার। সাহেদ বুঝতে পারেন, তিনি চরমভাবে প্রতারিত হয়েছেন। লুসির সঙ্গে সম্পর্কের ইতি টানেন তিনি। প্রেমের কারণে মালয়েশিয়া ছেড়ে টাঙ্গাইলের সখীপুরের মনিরুল ইসলামের কাছে ছুটে এসেছিলেন জুলিজা বিনতে কামিস।

 ফেসবুকে প্রেমের সূচনা। ২০১৭ সালে বিয়ে হয় তাদের। তবে মনিরুলের কপালে সুখ বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। বিয়ের সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে জানতে পারেন, মালয়েশিয়ায় জুলিজার আরও একটি সংসার রয়েছে। মালয়েশীয় তরুণী জুলিজার আগের স্বামীও একজন বাংলাদেশি। মনিরুল ও জুলিজার বিয়ের খবর বিভিন্ন গণমাধ্যমে এলে সেটি নজরে আসে জুলিজার প্রথম স্বামী আজগরের। এরপর আজগর ও তার পরিবার মনিরুলের সঙ্গে যোগাযোগ করে। মনিরুল জানতে পারেন, মালয়েশিয়ায় জুলিজার স্বামী ও চার সন্তানের সংসার। বাংলাদেশে আসার ১৭ দিনের মাথায় প্রথম স্বামীর কাছে ফিরে যান জুলিজা। এ বিষয়ে মহানগর গোয়েন্দা সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার তারেক বিন রশিদ মানবজমিনকে বলেন, ভিনদেশি অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পরিচয় থেকে প্রেমের টানে বাংলাদেশে আসেন। বিয়ে করেন। প্রাথমিকভাবে এটাকে ইতিবাচক মনে হলেও এর পেছনে অনেক সময় প্রতারণা কিংবা অসৎ উদ্দেশ্য থাকতে পারে। এ বিষয়ে পুলিশের সাইবার বিভাগ সবসময় সতর্ক অবস্থানে রয়েছে এবং মনিটর করছে।  

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn