শামীমুল হক-১২ বছর ধরে স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে থাকা পঙ্কজ দেবনাথের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির নানা অভিযোগ রয়েছে। ২০১৯ সালে আলোচিত ক্যাসিনো-কাণ্ডে তার জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে। সে সময় স্বেচ্ছাসেবক লীগের কার্যক্রম থেকে পঙ্কজ দেবনাথকে বাদ দেয়া হয়। নতুন কমিটি গঠন করা হয়। সে সময়ই সতর্ক হওয়া দরকার ছিল পঙ্কজ দেবনাথের। তখন সতর্ক হলে আজ হয়তো এমন পরিণতি ভোগ করতে হতো না। আসলে ক্ষমতার দম্ভ বলে একটা কথা আছে। এই ক্ষমতা পেলে কেউ কেউ নিজের অস্তিত্বই ভুলে যায়। মানুষকে মানুষ বলে মনে করে না। এই মানুষ না করার ফলে নিজেই হয়ে উঠে বেপরোয়া।
দিন দিন এর মাত্রা বাড়তেই থাকে। যার পরিণাম ভালো হয় না। এটাই প্রমাণিত ক্ষমতায় তখন বিএনপি। ২০০১ সালের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে চারদলীয় জোট। বিএনপি’র টিকিটে নির্বাচিত সংসদ সদস্য নাসিরউদ্দিন আহমেদ পিন্টু। লালবাগ এলাকার পিন্টু সারা দেশে তখন আলোচনায়। সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে তার নাম। সরকার তাকে নিয়ে বিব্রত। সে সময় একদিন গ্রেপ্তার করা হয় সংসদ সদস্য পিন্টুকে। সরকারি দলের এমপি গ্রেপ্তারের ঘটনা দেশে এটাই প্রথম। এ নিয়েও দেশজুড়ে নানা আলোচনা। সোমবার দুর্নীতি, দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ ও সন্ত্রাসের অভিযোগে সরকারদলীয় এমপি পঙ্কজ দেবনাথকে দলের সব পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। বরিশাল-৪ আসনে আওয়ামী লীগের টিকিটে তিনি দুইবারের এমপি। প্রভাবশালী একজন সংসদ সদস্য। হঠাৎ প্রভাবশালী এই এমপিকে দলীয় পদ থেকে সরিয়ে দেয়ায় চলছে নানা আলোচনা। পঙ্কজ দেবনাথকে অব্যাহতি দেয়ার পর মনে পড়ছে নাসির উদ্দিন পিন্টুর গ্রেপ্তারের ঘটনাটি। দুই জনকেই নিজ দল সরকারে থাকা অবস্থায় শাস্তির খড়গ নিতে হলো। তবে দুটি ভিন্ন উপায়ে। একজন হয়েছিলেন গ্রেপ্তার। অন্যজনকে অব্যাহতি। দুই জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ কিন্তু একই। তারপরও বলতে হয়, সরকারের এ অবস্থান প্রশংসার দাবি রাখে। যদি তা অব্যাহত থাকে। বিএনপি সেদিন কিন্তু তাদের অবস্থান ধরে রাখতে পারেনি।
পঙ্কজ দেবনাথকে অব্যাহতি দেয়ার পর সাংবাদিক হাসান শান্তনু আওয়ামী লীগ সরকারের আগামী দিনের কর্মসূচি পরিচিতি শিরোনামে তার ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন, আগামী সংসদ নির্বাচনের আগে সরকারে ও আওয়ামী লীগে ‘শুদ্ধি অভিযানের (যে নামেই হোক) চমক’ থাকছে। দুর্নীতি বিরোধী অভিযান। দলের কেন্দ্রীয় নেতা থেকে শুরু করে তৃণমূলের, মন্ত্রিসভার কয়েক সদস্য থেকে শুরু করে সংসদ সদস্যরাও অভিযানের আওতায় পড়বেন। কেউ কেউ বাদ পড়বেন দল থেকে, কারও কারও আশ্রয় হবে কারাগারে। রুই-কাতলা থেকে শুরু করে চুনোপুঁটি- কোনো সারিই অভিযানের আওতার বাইরে থাকবে না। অন্তত দশজন সংসদ সদস্যের ‘রাজনৈতিক ভাগ্যবিপর্যয়’ ঘটতে পারে ‘করুণভাবে’। সচিবালয় থেকে মাঠপর্যায়ের দুর্নীতিগ্রস্ত আমলা, কর্মকর্তারাও নিজের বেলায় শ্রীঘরে যাওয়া ঠেকাতে পারবেন না। আওয়ামী লীগের সভাপতি, সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা দুর্নীতি রোধ, অভিযুক্তদের বিচারের মুখোমুখি ও বিতর্কিতদেরকে দল থেকে বাদ দেয়ার বিষয়ে আরও কঠোর হবেন। এ বছরের আরও কিছু দিন গড়ানোর সঙ্গে অঘোষিত ওই অভিযান শুরু হবে। ওই অভিযানের বিশেষ চমক হচ্ছে- যারা শাস্তি, সাজার মুখোমুখি হচ্ছেন, তাদের মধ্যে অনেকে এখন তা ‘ভাবতে’ পারছেন না। আজকে সরকার ও সরকারি দলের ‘কেউকেটার’ হাতে কাল থাকবে হয় বহিষ্কারের চিঠি, না হয় হাতকড়া। ওই অভিযানের মধ্যদিয়ে পরবর্তী সংসদ নির্বাচনের আগে জনগণকে বার্তা দেয়ার চেষ্টা করবে আওয়ামী লীগ- অনিয়ম, দুর্নীতির প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুর তনয়া শেখ হাসিনার দৃঢ়তম অবস্থান। হাসান শান্তনুর এ লেখায় স্পষ্ট ভবিষ্যতে আরও চমক থাকছে।
আচ্ছা পঙ্কজ দেবনাথের বিরুদ্ধে কি কি অভিযোগ ছিল? পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে দেখা যায়-আওয়ামী লীগ থেকে তাকে বহিষ্কারের কারণ হিসেবে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের কথা বলা হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়, সংগঠনের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী অর্পিত ক্ষমতাবলে প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে আপনাকে আওয়ামী লীগের বরিশাল জেলা শাখার উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য পদসহ অন্যান্য পদ থেকে অব্যাহতি দিয়েছে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদ। উপরিউক্ত বিষয়ে আপনার লিখিত জবাব আগামী ১৫ দিনের মধ্যে কেন্দ্রীয় দপ্তর বিভাগে জমা দেয়ার জন্য সাংগঠনিক নির্দেশক্রমে অনুরোধ জানানো যাচ্ছে। পঙ্কজ দেবনাথ উত্তর দিলেই কি তিনি মাফ পেয়ে যাবেন? উত্তরে দল সন্তুষ্ট না হলে কি হবে? তাকে কি সাধারণ সদস্য পদ থেকেও অব্যাহতি দেয়া হবে? এমনটি হলে তো তিনি সংসদ সদস্য পদও হারাবেন। এরপর কী হয় সেটিই দেখার বিষয়। আওয়ামী লীগে পঙ্কজ দেবনাথের প্রভাব ছিল দৃশ্যমান। ২০১৪ ও ২০১৮ সালে তিনি আওয়ামী লীগের টিকিট পেয়ে বরিশাল-৪ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পত্র- পত্রিকার তখ্য অনুযায়ী হিজলা- মেহেন্দিগঞ্জকে তিনি নিজের রাজ্য বানিয়ে সেখানকার বাদশাহ রূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন। আধিপত্য বিস্তারে তিনি এতটাই বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন যে, গত এক মাসে তার কর্মীদের হাতে উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগ সেক্রেটারির দু’পায়ের রগ কেটে দেয়া হয়। হাসপাতালে ঢুকে চিকিৎসারত আওয়ামী লীগ কর্মীদের বেধড়ক কোপানো হয়। সহিংসতায় খুন হয় দু’জন কর্মী। আহতরা স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে না পেরে পালিয়ে বরিশাল এসে চিকিৎসা নিয়েছেন।
এ ছাড়াও বছর চারেক আগে এক অডিও ফাঁসে পঙ্কজ দেবনাথের বিরুদ্ধে সমালোচনা আরও জোরালো হয়। বিরোধীদলীয় নেতাদের নামে যে গাড়ি পোড়ানো মামলা ছিল, সেগুলো সাজানো, তার নিজের পরিবহনের গাড়ি নিজে পুড়িয়ে মামলা দেয়ার চাঞ্চল্যকর অডিও শুনে দেশবাসী হতবাক হয়। গত ইউপি নির্বাচনে হিজলা- মেহেন্দিগঞ্জে আওয়ামী লীগের ভরাডুবির অন্যতম কারণ হিসেবে পঙ্কজ দেবনাথের বিদ্রোহকে চিহ্নিত করা হয়। ৯টি ইউপি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ হেরেছে বিদ্রোহী প্রার্থীর কাছে। আর এসব বিদ্রোহী প্রার্থীরা ছিলেন পঙ্কজ দেবনাথের সমর্থিত প্রার্থী। হিজলায় উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান প্রার্থী ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক, হিজলা আওয়ামী লীগের সদস্য এডভোকেট মুনসুর আহমেদ। তিনি জানান, সে নির্বাচনে তিনি ঘর থেকেই বের হতে পারেননি। তার কর্মীরা ছিল সব পালিয়ে। আওয়ামী লীগের প্রার্থী হওয়ার পরও তিনি হেরেছেন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য পঙ্কজ দেবনাথের প্রার্থীর কাছে। গত ২০শে জুলাই তার একটি অডিও ফাঁস হয়। সেখানে ওসি’র সঙ্গে তার বক্তব্য ছিল- মেয়রকে সামনে পেলে তাকেও কোপানো হবে। পৌর মেয়র কামাল উদ্দিন খান ছিলেন আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ’র অনুসারী এবং পঙ্কজ দেবনাথের ঘোরবিরোধী। ১২ বছর ধরে স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে থাকা পঙ্কজ দেবনাথের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির নানা অভিযোগ রয়েছে। ২০১৯ সালে আলোচিত ক্যাসিনো-কাণ্ডে তার জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে। সে সময় স্বেচ্ছাসেবক লীগের কার্যক্রম থেকে পঙ্কজ দেবনাথকে বাদ দেয়া হয়। নতুন কমিটি গঠন করা হয়।
সে সময়ই সতর্ক হওয়া দরকার ছিল পঙ্কজ দেবনাথের। তখন সতর্ক হলে আজ হয়তো এমন পরিণতি ভোগ করতে হতো না। আসলে ক্ষমতার দম্ভ বলে একটা কথা আছে। এই ক্ষমতা পেলে কেউ কেউ নিজের অস্তিত্বই ভুলে যায়। মানুষকে মানুষ বলে মনে করে না। এই মানুষ না করার ফলে নিজেই হয়ে উঠে বেপরোয়া। দিন দিন এর মাত্রা বাড়তেই থাকে। যার পরিণাম ভালো হয় না। এটাই প্রমাণিত। রাজনীতির জন্য অনেকেই অনেক কিছু করে। কেউ নিজের সবকিছু বিলিয়ে দেয়। কেউবা অন্যের সবকিছু লুটে নেয়। আবার এই রাজনীতির জন্য সারাজীবনের আদর্শও অনেকে ত্যাগ করে। মনে পড়ছে রাজশাহীর পোড় খাওয়া আওয়ামী লীগ নেতা ডা. আলাউদ্দিনের কথা। যার শরীরে জন্ম থেকেই আওয়ামী লীগের রক্ত। যার ধ্যান-জ্ঞানে আওয়ামী লীগ। সে সময় তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য। সেই আলাউদ্দিন ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের টিকিট না পেয়ে বিএনপিতে যোগ দেন। হয়ে যান জাতীয়তাবাদী সৈনিক। উপহার হিসেবে পান বাঘা-চারঘাট মিলে রাজশাহী-৫ আসন থেকে বিএনপি’র টিকিট। আর সে নির্বাচনে জীবনে প্রথম বারের মতো ধানের শীষ প্রতীকই তাকে জয় এনে দেয়।
নামের পাশে সংসদ সদস্য শব্দ বসানোর অধিকার পান। বিএনপি’র এমপি হয়ে সংসদে যান। বিএনপি’র পক্ষে সরব সংসদে। কিন্তু সরকারে তখন আওয়ামী লীগ। দুই বছর না পেরুতেই ১৯৯৮ সালে ফের আলাউদ্দিন যোগ দেন আওয়ামী লীগে। আওয়ামী লীগ থেকে উপহারস্বরূপ তাকে দেয়া হয় প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রীর পদ। কিন্তু আইন অনুযায়ী তার সংসদ সদস্য পদ চলে যায়। ফের উপনির্বাচনে ডা. আলাউদ্দিন আওয়ামী লীগের টিকিটে নৌকা প্রতীক নিয়ে জয়ী হন। ধানের শীষের এমপি হন নৌকার এমপি। একই সময় ঘটে আরেক ঘটনা। সিরাজগঞ্জ-৬ আসনের সংসদ সদস্য হাসিবুর রহমান স্বপনও দল বদলান। একসময় জাসদের ডাকসাইটে নেতা স্বপন বিএনপিতে যোগ দিয়ে এমপি হন। পরে তিনিও যোগ দেন আওয়ামী লীগে। উপহার হিসেবে পান শিল্প উপমন্ত্রীর পদ। তার বেলায়ও ঘটে একই ঘটনা। সংসদ সদস্য পদ চলে যায়। তিনিও উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকে লড়াই করে জয়ী হয়ে আসেন। রাজনীতি আমাদের অনেক কিছুই শিখিয়ে যাচ্ছে। তারপরও রাজনীতিই দেশের পথ প্রদর্শক। রাজনীতিকরাই দেশকে এগিয়ে নিয়ে যান সামনের দিকে। রাজনীতি রাজনীতিই।
সংবাদ টি পড়া হয়েছে :
১৫৬ বার