বার্তাডেক্সঃ অবতরণ করতে গিয়ে প্রথমে একটু টালমাটাল দুলে ওঠে বিমানটি। একবার বামদিকে। পরক্ষণেই ডানদিকে কাত হয়ে চলতে থাকে। তারপর মুহূর্তের মধ্যেই তা খাড়া নিচের দিকে ‘নোজ’ বা সামনের অংশ নামিয়ে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে ৫ বছরের মধ্যে নেপালে সবচেয়ে ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনা ঘটে। এতে বিভিন্ন হিসাবে নিহতের সংখ্যা ভিন্ন ভিন্ন বলা হচ্ছে। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত সর্বোচ্চ ৬৭ জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। দেশটিতে একের পর এক বিমান দুর্ঘটনা। সঙ্গে প্রাণহানি। তবে কি বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের মতো নেপালের আকাশসীমা এক রহস্যময় মৃত্যুপুরীতে রূপ নিয়েছে! ভাগ্যের চাকা সামান্য দুলে উঠলেই ধসে পড়ে বিমান।
কেড়ে নেয় প্রাণ। সে খবর শিরোনাম হয় বিশ্বজুড়ে। রোববার ৭২ জন আরোহী নিয়ে পোখারা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ইয়েতি এয়ারলাইন্সের বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পর এসব আলোচনা নতুন করে উঠে এসেছে। গতকালের দুর্ঘটনায় বিভিন্ন সংবাদ সংস্থার হিসাবে প্রাণ হারিয়েছেন কমপক্ষে ৬৭ জন। এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন পুলিশ কর্মকর্তা একে ছেত্রী। তিনি বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেছেন, ৩১টি মৃতদেহ নেয়া হয়েছে হাসপাতালে। ঘটনাস্থলে তখনো পড়ে ছিল ৩৬টি মৃতদেহ। নিহতদের মধ্যে ৫ জন ভারতীয়, ৪ জন রাশিয়ান। একজন আইরিশ এবং ২ জন দক্ষিণ কোরিয়ার নাগরিক। বাকিদের কী খবর সে বিষয়ে বিস্তারিত জানা যায়নি। ওই ফ্লাইটে শিশু, নারীও ছিলেন। পোখারা রিজিওনাল ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের প্রধান বিক্রম গৌতম মিডিয়াকে জানিয়েছেন, আরোহীদের মধ্যে কোনো বাংলাদেশি ছিলেন না। এর আগে ঢাকা থেকে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের একটি বিমান সেখানকার ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিধ্বস্ত হয়েছিল। তাতে কয়েকজন বাংলাদেশি নিহত হন। এবার আরোহীদের ভাগ্য কতোটা নির্মম! তাদেরকে বহনকারী বিমানটি অবতরণ করতে গিয়ে বিধ্বস্ত হয়েছে। এর কিছু অংশ একটি পাহাড়ের ওপর পড়েছে। বাকি অংশ পড়েছে দুই পাহাড়ের মাঝে গিরিখাদে। আর একটু হলেই এর আরোহীরা নিরাপদে অবতরণ করতেন। বিমান সংস্থাটির মুখপাত্র সুদর্শন বারতুউলা বলেছেন, মাত্র ১০ থেকে ২০ সেকেন্ডের ব্যবধান। এতটুকু সময় পেলেই বিমানটি মাটি স্পর্শ করতো। নিরাপদে যে যার ঘরে ফিরতে পারতেন। তিনি জানান, ককপিট থেকেও কোনো বিপদের বার্তা পাঠানো হয়নি। ফলে কি কারণে দুই ইঞ্জিনবিশিষ্ট বিমানটি বিধ্বস্ত হয়েছে তা তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি। সামান্য সময়ের মধ্যে ঝরে গেছে এতগুলো প্রাণ। কারণ, ওই যে ভাগ্য! জীবনের চাকার গতি যতদূর সেখানে গিয়ে থেমেই যায়। ফলে তাদেরকে বহনকারী বিমানটি বিমানবন্দরেই স্থানীয় সময় সকাল ১১টায় ধসে পড়েছে।
ওদিকে সেনাবাহিনীর একজন মুখপাত্র কৃষ্ণ প্রসাদ ভাণ্ডারী বলেছেন, বিমানটি গিরিখাদে বিধ্বস্ত হওয়ায় মৃতদেহগুলোর তল্লাশি ও উদ্ধার অভিযান খুব কঠিন হয়ে পড়েছে। তিনি জানান, জীবিত কারও সন্ধান মেলেনি তখন পর্যন্ত। নেপালের বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (সিএএএন) মতে, স্থানীয় সময় সকাল ১০টা ৩৩ মিনিটে রাজধানীর কাঠমান্ডু ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ৭২ আরোহীকে বহন করে আকাশে ওড়ে ইয়েতি এয়ারলাইন্সের ৯এন-এএনসি এটিআর-৭২। কিন্তু পোখারা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণের পূর্ব মুহূর্তে তা সেতি নদীর তীরে পুরনো ও নতুন বিমানবন্দরের মধ্যবর্তী এক গিরিখাদে বিধ্বস্ত হয়। আরোহীদের মধ্যে ৬৮ জন যাত্রী এবং ৪ জন ক্রু ছিলেন। ইয়েতি এয়ারলাইন্সের এক মুখপাত্র এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন। দুর্ঘটনার পরপরই মন্ত্রিপরিষদের জরুরি বৈঠক আহ্বান করেছেন নেপালের প্রধানমন্ত্রী পুষ্প কমল দাহাল। তিনি কার্যকর উদ্ধার অভিযানে নির্দেশনা দিয়েছেন। ঘটনা তদন্তে ৫ সদস্যের একটি কমিশন গঠন করেছে সরকার। ওদিকে দুর্ঘটনার পর পরই অস্থায়ীভিত্তিতে বন্ধ করে দেয়া হয় ওই বিমানবন্দর। সিএএএনের মুখপাত্র জগন্নাথ নিরোলা বলেছেন, এদিন আবহাওয়া ছিল পরিষ্কার। ভারতীয় যে ৫ জন মারা গিয়েছেন তাদের নাম হলো- অভিষেক খুশওয়াহা, বিশাল শর্মা, অনিল কুমার রাজভর, সোনু জৈশওয়াল এবং সঞ্জয় জৈশওয়াল। এ দুর্ঘটনায় চার রাশিয়ান মারা যাওয়ার তথ্য নিশ্চিত করেছেন নেপালে রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত অ্যালেক্সি নোভিকভ।
তিনি বলেছেন, নেপালের কর্তৃপক্ষগুলোর সঙ্গে আমরা অব্যাহতভাবে যোগাযোগ রাখছি। নিহত রাশিয়ানদের আত্মীয়দের প্রয়োজনীয় সব সহযোগিতা দেবো আমরা। ওদিকে দু’জন কোরিয়ান নিহত হওয়ার কথা নিশ্চিত করেছে দক্ষিণ কোরিয়ার দূতাবাস। নেপাল হলো পাহাড়ের দেশ। এভারেস্টকে ধারণ করে এখানে আছে বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু আটটি পাহাড়। ফলে দেশটিতে বিমান দুর্ঘটনার একটি রেকর্ড আছে। ২০২২ সালের মে মাসে ২২ আরোহী নিয়ে বিধ্বস্ত হয় তারা এয়ারপ্লেন। এতে চার ভারতীয় সহ যাত্রীদের সবাই নিহত হন। একই বিমান সংস্থার একটি বিমান একই রুটে উড়ে যাওয়ার সময় দুর্ঘটনায় পড়ে ২০১৬ সালে। এতে আরোহীদের ২৩ জনের সবাই মারা যান। বিমানটি উড্ডয়নের পর বিধ্বস্ত হয়। ২০১৮ সালের মার্চে ঘটে আরেক বড় দুর্ঘটনা। এ সময় ইউএস-বাংলা এয়ারের একটি বিমান ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিধ্বস্ত হয়। এতে আরোহীদের ৫১ জন মারা যান। তার মধ্যে কয়েকজন বাংলাদেশিও ছিলেন। ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে সীতা এয়ারের একটি ফ্লাইট বিধ্বস্ত হয়। এ সময় বিমানটি ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে জরুরি অবতরণের চেষ্টা করছিল। এতে মারা যান ১৯ জন। একই বছর মে মাসে পোখারা থেকে জমসম যাওয়ার পথে জমসম বিমানবন্দরের কাছে বিধ্বস্ত হয় একটি বিমান। এতে মারা যান ১৫ জন।
সংবাদ টি পড়া হয়েছে :
৬৬ বার