ফয়সল আহমদ রুহেল:: মোহা. নেজামিয়া সংসারে হাল ধরার জন্য শিক্ষকতার মহান পেশায় নিয়োজিত হন। তিনি নিজ কর্মদক্ষতা, সততা ও নিষ্ঠাবান হিসাবে নিজেকে সকল মহলে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। শিক্ষকতা একটা মহান আদর্শিক পেশার প্রতীক হিসেবে দীর্ঘ ৩৯ বছর কাজ করেন। তিনি সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর উপজেলার জগদীশপুরের সফাত উল্লাহ উচ্চ বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক।
জন্ম : মোহা. নেজামিয়া সুনামগঞ্জ জেলা সদরে অবস্থিত প্রসিদ্ধ গ্রাম আরফিননগরে ১৯৫৪ ইং সনের পহেলা এপ্রিল এক সম্ভান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মরহুম মছরব আলী খাঁ ও মাতা মরহুমা মোছা. সৈয়দুন নেছা চৌধুরী। মোহা. নেজামিয়ার চার ভাই ও তিন বোন। ভাইদের মধ্যে তিনি সবচেয়ে বড়। তিন বোনের মধ্যে বড় দু’বোন মারা গেছেন। ছোট বোন এখনও জীবিত আছেন। তার পাঁচ সন্তান। ভাইয়েরা সবাই বিবাহিত ও স্ব-স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। ভাইদের মধ্যে এক ভাই সমাজ সেবা অধিদপ্তরের অধীনে সিলেট বাঘবাড়িতে অবস্থিত সরকারী শিশু পরিবারে কর্মরত। আর এক ভাই স্বপরিবারে সরকারি প্রাইমারি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় নিয়োজিত। অন্যভাই ব্যবসার সাথে জড়িত।
পারিবারিক : মোহা. নেজামিয়ার কোন সন্তানাদি নেই। তাই অনাথ দুইটি মেয়েকে ছোট বেলা থেকে লালন পালন ও লেখাপড়া করানোর পর এক মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। মেয়েটির দুটি পুত্র সন্তান রয়েছে। অন্য মেয়েটি বর্তমানে সুনামগঞ্জ সরকারী মহিলা কলেজ থেকে বিএ ১ম বর্ষের পরীক্ষার্থী।
শিক্ষাজীবন : মোহা. নেজামিয়া প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন ১৯৬৩ইং সনে সুনামগঞ্জ শহরস্থ রাজ গোবিন্দ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় হতে। এরপর সুনামগঞ্জ এইচএমপি উচ্চ বিদ্যালয় হতে ১৯৬৯ইং সনে মাধ্যমিক, সিলেট এমসি বিশ্ববিদ্যালয় হতে ১৯৭১ইং সনে উচ্চ মাধ্যমিক ও সুনামগঞ্জ সরকারী কলেজ থেকে ১৯৮৩ইং সনে স্নাতক ডিগ্রী কৃতিত্বের সাথে অর্জন করেন। অত:পর কর্মজীবনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় হতে ১৯৮৭ইং সনে ১ম শ্রেনীতে বিএড ডিগ্রী লাভ করেন।
উল্লেখ্য, মোহা. নেজামিয়া ১৯৭৪ইং সনে সুনামগঞ্জ সরকারী কলেজের একজন বিএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন। ঐ বৎসর স্মরণ কালের কালের ভয়াবহ বন্যা হয়। যার কারনে দুদিন পরীক্ষা হওয়ার পর পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। পরবর্তীতে কয়েকমাস পর স্থগিত পরীক্ষাগুলো অনুষ্ঠিত হয়। সকল পরীক্ষার্থী মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ে ও পরীক্ষার প্রস্তুতি এলোমেলো হওয়ায় দুর্ভাগ্যবসত: পরীক্ষায় সুনামগঞ্জ সরকারী কলেজ, এমসি কলেজ, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজসহ ৩৫টি কলেজের কোন পরীক্ষার্থী বিএসসি পরীক্ষা পাশ করে নাই। ওই বৎসর বিএসসি পরীক্ষার পাশের হার ছিল ১.৫%। যার কারনে সংসারে হাল ধরার জন্য মোহা. নেজামিয়া শিক্ষকতার পেশায় নিয়োজিত হন। এর পরবর্তীতে ১৯৮৩ইং সনে তিনি স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন।
কর্মজীবন :
কর্মজীবনের শুরুতে মোহা. নেজামিয়া বিশ্বনাথের ঐতিহ্যবাহী চান্দভরাং উচ্চ বিদ্যালয়ে ০১/০১/১৯৭৫ ইং হতে সহকারী শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন। অত:পর ০১/১০/১৯৭৬ইন হতে সহকারী শিক্ষক হিসাবে সফাত উল্লাহ উচ্চ বিদ্যালয়, জগদীশপুর, জগন্নাথপুর, সুনামগঞ্জে, অত:পর একই বিদ্যালয়ে পর্যায়ক্রমে ০১/০৯/১৯৮৭ইং হতে সহকারী প্রধান শিক্ষক ও পরে ১৩/০১/১৯৯৩ইং হতে ৩১/০৩/২০১৪ইং পর্যন্ত প্রধান শিক্ষক হিসাবে সাফল্যের সাথে অত্র প্রতিষ্ঠান হতেই ৩৯ বৎসর ৩ মাস কর্মজীবন শেষে অবসর গ্রহণ করেন। অবসরে যাবার পর এলাকাবাসী অভিভাবকবৃন্দ, শিক্ষক-কর্মচারীবৃন্দ ভালোবেসে, শ্রদ্ধা করে, হিতাকাঙ্খী হিসাবে আবারও শ্রদ্ধেয় মোহা. নেজামিয়া স্যারকে বিদ্যালয়ে একজন গেস্ট টিচার হিসাবে যতদিন মনে চায় ততদিন অত্র বিদ্যালয়ে থাকার জন্য অনুরোধ জানান। তিনি তাদের ভালোবাসাকে প্রত্যাখ্যান না করে সাদরে গ্রহণ করে অদ্যাবধি ইংরেজি শিক্ষক হিসাবে নিয়োজিত আছেন। তিনি ২০২২ইং সনে জগন্নাথপুর উপজেলার শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক নির্বাচিত হন। তিনি বিদ্যালয়ে কর্মরত থাকা অবস্থায় ২০১২ইং সনে পবিত্র হজব্রত পালন করেন।
বিদায় সংবর্ধনা :
মোহা. নেজামিয়া দীর্ঘ ৩৯ বৎসর শিক্ষকতার মহান পেশায় সম্পৃক্ত ছিলেন। শিক্ষকের বিদায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় সিক্ত হয়েছেন। একজন দায়িত্ব সচেতন শিক্ষকের কী যে সম্মান তা তিনি এখনো অনুভব করেন। মোহা. নেজামিয়া বিদ্যালয় হতে অবসর গ্রহণ উপলক্ষে বিগত ২২/০৬/২০১৪ইং তারিখে বিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারী, ছাত্র-ছাত্রীবৃন্দ, পরিচালনা কমিটি ও এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে এক বিরাট বিদায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। এতে বাংলাদেশ সরকারের বর্তমান পরিকল্পনামন্ত্রী জনাব এম,এ মান্নান মহোদয় প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন। বিশেষ অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন জগন্নাথপুর উপজেলার নির্বাহী অফিসার, উপজেলা চেয়ারম্যান, শাহজালাল মহাবিদ্যালয়ের প্রিন্সিপাল, বিভিন্ন স্কুল থেকে আগত শিক্ষকবৃন্দ ও গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গ। বিদায়ী অনুষ্ঠানে দেশ ও বিদেশের আমার প্রাণপ্রিয় প্রাক্তন ও অধ্যায়নরত শিক্ষার্থীরা। সহকর্মী শিক্ষক ও কর্মচারীবৃন্দ, পরিচালনা কমিটির সদস্যবৃন্দ ভালবাসার ও শ্রদ্ধার নিদর্শন স্বরূপ টাকা পয়সা ও বিভিন্ন উপহার সামগ্রী প্রদান করেন।
সংসারের হাল : ১৯৮৩ইং সনে মোহা. নেজামিয়ার বাবার মৃত্যুর পর তাঁকে একা সংসারের হাল ধরতে হয়। তাঁর প্রচেষ্ঠায় ভাইদের লেখাপড়া করিয়ে মানুষের মত মানুষ করেছেন। এটাই বড় পাওনা। শিক্ষকতা জীবনে তিনি বিভিন্নভাবে শিক্ষার্থীদের টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য সহযোগিতা করেন। বই কিনে দিয়ে, ফরম ফিলাপের টাকা দিয়ে স্কুল ড্রেস তৈরি করে দিয়ে উপকার করতে পেরে তিনি খুবই আনন্দিত।
স্যারের যত প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা :
মোহা. নেজামিয়ার সুযোগ্য প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা তাদের স্ব স্ব ক্ষেত্রে আজ দেশে বিদেশে সুপ্রতিষ্ঠিত। প্রাক্তন ছাত্রদের মধ্যে বর্তমানে ২জন এমসি বিশ্ববিদ্যালয়ে, একজন বিয়ানীবাজার সরকারী ডিগ্রী কলেজে, একজন তাজপুর ডিগ্রী কলেজে সহযোগী অধ্যাপক হিসাবে কর্মরত আছেন। অসংখ্য প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন কলেজ, মাধ্যমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক/শিক্ষিকা হিসাবে কর্মরত আছেন। সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলা বারে কয়েকজন প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রী উকালতি পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন। প্রশাসন বিভাগ, ডাক্তারী পেশায়, পুলিশ প্রশাসনে অনেকেই আছেন।
মোহা. নেজামিয়ার অবসরে যাবার পর অত্র বিদ্যালয়ে যিনি প্রধান শিক্ষক, সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেছেন। তাঁরাই অত্র বিদ্যালয়ের প্রাণপ্রিয় মেধাবী ছাত্র শিক্ষকের। অন্য দুইজন সিনিয়র শিক্ষক তারাও মোহা. নেজামিয়ার ছাত্র। মোহা. নেজামিয়া প্রধান শিক্ষক থাকাকালীন অবস্থায় অত্র বিদ্যালয়ে উক্ত চারজন শিক্ষকই শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৭১ইং সনে মুক্তিযুদ্ধে মোহা. নেজামিয়ার বয়স ছিল ১৭। সাহসের অভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ না করলেও পরোক্ষভাবে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে বিভিন্নভাবে সাহায্য সহযোগিতা করেন তিনি।
২০২২ সালে অবসরপ্রাপ্ত গুণী শিক্ষকদের নিয়ে কাজ করা হবিগঞ্জ সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের স্বনামধন্য শিক্ষক সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার উপজেলার কৃতি সন্তান জনাব টি, আলী স্যারের নামে প্রতিষ্ঠিত যুক্তরাজ্য ভিত্তিক চ্যারেটি সংস্থা টি,আলী স্যার ফাউন্ডেশন সুনামগঞ্জ জেলার প্রত্যেক উপজেলায় অবসরপ্রাপ্ত দুইজন আদর্শ শিক্ষককে সম্মাননা পদকে মনোনয়নে জরিপ চালিয়ে যাচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় জগন্নাথপুর উপজেলার অবসরপ্রাপ্ত আদর্শ শিক্ষকের সম্মাননার স্বীকৃতি হিসেবে টি, আলী স্যার ফাউন্ডেশন সম্মাননা পদকের মনোনয়ন পেয়েছেন তিনি।
সুনামগঞ্জ জেলার ১১ উপজেলার ২২ জন মনোনয়নপ্রাপ্ত শিক্ষকদের জীবনী ধারাবাহিকভাবে লিখছেন ফাউন্ডেশনের সভাপতি টি, আলী স্যারের পুত্র বৃটেনের জনপ্রিয় চ্যানেল এস টেলিভিশনের সাংবাদিক ফয়সল আহমদ (রুহেল)।
উল্লেখ্য, ২২ জন মনোনয়নপ্রাপ্ত অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের মধ্যে থেকে আর্থিক দিক থেকে পিছিয়ে থাকা ৫ জনকে আর্থিক সহযোগিতা এবং জেলার আদর্শ শিক্ষকের স্বীকৃতি হিসেবে ৫ জন শিক্ষককে টি আলী স্যার ফাউন্ডেশন সম্মাননা পদকে ভুষিত করবে সংস্থাটি।
শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মোহা. নেজামিয়ার শিক্ষার্থীদের আদর্শের জীবন অনুসরণের শিক্ষা দিয়েছেন। লোভ-লালসা থেকে দূরে থেকেছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে নিজের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে দেখেছেন। শিক্ষকতা জীবনের সাফল্য ছাত্রছাত্রীরা। দেশে-বিদেশে সুপ্রতিষ্ঠিত মোহা. নেজামিয়ার স্নেহের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা। এই গর্ববোধের আত্মতৃপ্তি একজন শিক্ষকের জীবনের পরম প্রাপ্তি। শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মোহা. নেজামিয়ার সুস্থ ও মঙ্গল কামনা করি।
সংবাদ টি পড়া হয়েছে :
১৫৬ বার