ইসরায়েলকে নিজেদের ভূমি মনে করে ইহুদিরা। সেখানে আসলেই ইহুদিদের নাগরিকত্ব দেয় ইসরায়েল। গত বছরের এই সময় থেকে রাশিয়া ইউক্রেনে উত্তেজনা ও যুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁকে ঝাঁকে ইহুদি ইসরায়েলে চলে এসেছিল। তবে যুদ্ধের বছর না ঘুরতেই সেই চিত্র বদলাতে শুরু করেছে। হাজার হাজার ইহুদি ইসরায়েল ছাড়ছেন।
আল জাজিরার খবরে বলা হয়েছে, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেনে আক্রমণ করার পর হাজার হাজার রাশিয়ান ও ইউক্রেনিয়ান ইহুদি ইসরায়েলে আসেন। সেসময়ে বিমানবন্দরে তাদেরকে লাল গালিচা সংবর্ধনা দেওয়া হয়। ইহুদি স্লোগানে মুখরিত হয়েছিল চারপাশ। রাশিয়া ও ইউক্রেনে থাকা সব ইহুদিদের স্বাগত জানিয়েছিল ইসরায়েল। এই দেশ দুটি বৃহৎ ইহুদি সম্প্রদায়ের আবাসস্থল। এমন অবস্থা সোভিয়েত যুগকে মনে করিয়ে দিচ্ছিল। কারণ, এমন হাজারে হাজারে ইহুদি নব্বই দশকে ফিলিস্তিনের অধিকৃত অঞ্চলে অবতরণ করেছিল।
মনে করা হয় সোভিয়েত যুগে আসা লাখ লাখ ইহুদির কারণেই ইসরায়েলের সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তন দ্রুত হয়েছিল। সেই সঙ্গে তারা কট্টর ইহুদিপন্থী রাজনৈতিক পরিবর্তনে অবদান রেখেছিলেন। তারই ফলস্বরূপ এবার কট্টরপন্থী ইহুদিরা ক্ষমতার সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছেছে। ২০২২ সালের শেষের দিকে ইসরায়েলের সমর্থনে ইহুদিবাদী কার্যকলাপের জন্য বৃহত্তম বৈশ্বিক সংস্থা ইসরায়েলে নতুন অভিবাসীদের তথ্য প্রকাশ করে গর্ব করে। গত ২৩ বছরের মধ্যে ইসরায়েলে গত বছর সর্বোচ্চ সংখ্যক ইহুদি অভিবাসী এসেছিল। এর সংখ্যা ছিল ৭০ হাজার। যাদের বেশিরভাগই রাশিয়া বা ইউক্রেন থেকে আসে। ২০২১ সালে ইসরায়েলে আসা ইহুদির সংখ্যা ছিল ২৮ হাজার।
ইউক্রেন-রাশিয়া থেকে আসা ইহুদিরা সরকারের অর্থায়নে ইসরায়েলে আসছে। তাদের সেখানে বসবাস করতে সহায়তা করার জন্য আর্থিক সহায়তা পাচ্ছে এবং স্থায়ী আবাসন না পাওয়া পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় খরচে ইসরায়েলের হোটেলে অবস্থান করছে। তবে সেই পরিসংখ্যান গত কয়েক মাসে ঘুরতে শুরু করেছে। শত শত ইহুদি তাদের নিজের শহরে ফিরে যাচ্ছেন, যেখানে তাদের আত্মীয় স্বজন রয়েছে। অনেকের চাকরিও রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ইসরায়েলি পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে যে- ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর দুই মাস পরে ৫,৬০০ জন রুশ ইহুদির মধ্যে গত নভেম্বরের নির্বাচনের পর প্রায় ১,৮০০ জন তাদের ইসরায়েলি পাসপোর্ট নিয়ে মস্কোতে ফিরে এসেছে। এর মানে রাশিয়া থেকে আসা প্রায় এক তৃতীয়াংশ ইহুদি আবার তাদের আগের জায়গায় ফিরে গেছেন।
এছাড়া ইউরোপীয় বিভিন্ন দেশে নাগরিকত্ব পেতে ইসরায়েলিদের আবেদনের সংখ্যা বেড়ে গেছে। সাধারণ সময়ের তুলনায় গত দুই মাসে ফ্রান্সে ইসরায়েলিদের নাগরিকত্বের আবেদন ১৩ শতাংশ বেড়ে গেছে। এছাড়া পর্তুগালে এমন আবেদন বেড়েছে আগের তুলনায় ৬৮ শতাংশ। পোল্যান্ড ও জার্মানিতে এটি বেড়েছে ১০ শতাংশ। তবে ইসরায়েল থেকে ইহুদিদের প্রস্থান নতুন বিষয় নয়। চল্লিশের দশকের শেষের দিকে এটি প্রতিষ্ঠার পর ১৯৪৮-৫০ সালের মধ্যে ১০ শতাংশ ইহুদি ইসরায়েল ছেড়েছিল। এটির মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় সেই সময় বহির্গমনে জারি করা হয়েছিল নিষেধাজ্ঞা। এমন নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও ১৯৫৮ সালে এক দশকের মধ্যে প্রায় এক লাখ ইসরায়েলি বিভিন্ন দেশে অভিবাসী হয়েছিল। ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত এই সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৮০ হাজার।
২০১৭ সালে দক্ষিণ আমেরিকার ভেনিজুয়েলার জীবনযাত্রার অবস্থার দারুণ অবনতি হয়। প্রচণ্ড সংকট দেখা দেওয়ায় অভিবাসী হওয়ার রাস্তা খুঁজতে থাকেন ভেনেজুয়েলার রাজধানী কারাকাসে বসবাসকারী ইহুদি মহিলা মার্লেন অ্যানিচিয়ারিকো বেনডায়ান। সেই সময় তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে পছন্দ করেছিলেন। কিন্তু তখনকার ডোনাল্ড ট্রাম্প সরকার অভিবাসীদের বিষয়ে কঠোর নীতি আরোপ করেছিলেন। তাই পরবর্তী পছন্দ হিসেবে ইসরায়েলকে বেছে নেন তিনি।
ইসরায়েলে অভিবাসী হওয়ার জন্য হিব্রু ভাষা শেখেন মার্লেন অ্যানিচিয়ারিকো বেনডায়ান। একটি বিয়ের মেকআপের কোর্সও করেন। শেষ পর্যন্ত ইসরায়েলে এসে কাজ শুরু করেন। কিন্তু যেখানে তিনি থাকতেন সেখানে প্রতারিত হন ও হতাশ হয়ে পড়েন। শেষ পর্যন্ত তিনি মেক্সিকোর রাজধানী মেক্সিকো সিটিতে বোনের কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তার মতে, হাজার হাজার ইহুদি, যারা পেশাগত ও আর্থিক চ্যালেঞ্জের কারণে ইসরায়েল ছেড়ে চলে যেতে প্ররোচিত হয়েছিল। গত এক বছরে রাশিয়া এবং ইউক্রেনের শত শত অভিবাসীদের ক্ষেত্রেও এমটি ঘটেছে, যারা ইসরায়েলি ব্যাংকের আরোপিত বিধিনিষেধের শিকার হয়েছিলেন।
আমেরিকান-ইসরায়েলি ব্যবসায়ী মোর্দেচাই কাহানে বর্তমানে ইসরায়েল থেকে ইহুদিদের অপসারণে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন। তিনি ‘চলুন একসাথে দেশ ছেড়ে যাই’ আন্দোলনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। এই সংস্থাটি হাজার হাজার ইসরায়েলি ইহুদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্থানান্তর করার পরিকল্পনা করেছে। অতি কট্টরপন্থী সরকার আসার পরই তারা এমন কার্যক্রম শুরু করেন। তিনি বলে, ‘ইয়েমেন, আফগানিস্তান, সিরিয়া এবং ইউক্রেনের যুদ্ধ অঞ্চল থেকে ইহুদিদের ইসরায়েলে পাচার করার কয়েক বছর পর, আমি ইসরায়েলিদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন করতে সাহায্য করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ইসরায়েলের পরিস্থিতির অবনতি অব্যাহত থাকলে ইহুদিবাদী আন্দোলনের বিকল্প প্রস্তাব করার সময় এসেছে।’খবরে বলা হয়েছে, যেসব কারণে ইহুদিরা ইসরায়েল ছাড়ছেন তার মধ্যে অন্যতম হলো- নিরাপত্তা উদ্বেগ, আবাসন ও অর্থনৈতিক সমস্যা নিয়ে হতাশা এবং সেখানকার সমাজে একীভূত হওয়ার অসুবিধা।
সম্প্রতি ইসরায়েলে অতিকট্টরপন্থী সরকার ক্ষমতায় আসার পর উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে। বন্দুক হামলায় প্রাণ গেছে অনেকের। এছাড়া সামাজিক অস্থিরতাও দেখা দিয়েছে। এসব বিষয়ই ইসরায়েল ছাড়তে বাধ্য করছে ইহুদিদের। এছাড়া ইসরায়েল পাসপোর্ট আইনও কিছুটা কঠোর করেছে, যেগুলো ইহুদিদের ইসরায়েল ছাড়তে নিরুৎসাহিত করে।
সংবাদ টি পড়া হয়েছে :
১১২ বার