মনজুরুল আহসান বুলবুল-বাংলাদেশকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বশেষ ভিসা নীতি দেখে ছোটকালের সেই কথাটাই মনে পড়ল। সেই যে স্কুলে স্যারদের কাছে, বাড়িতে বা পাড়ার মুরব্বিদের কাছ থেকে শোনা পুরোনো কথা। ছোটদের মুরব্বিরা সবাই বলতেন, ‘বাচ্চারা, ভালো হও (এই ভালোর নানা রকম ছিল: ক্লাসে ফার্স্ট হও, আউট বই পোড়ো না, সন্ধ্যার পর বাইরে থাকবা না, খারাপ ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মিশবে না ইত্যাদি, ইত্যাদি), তাহলে চকলেট দেব।’ এই চকলেটের আশায় কতই না ভালো থাকার চেষ্টা করেছি!
যুক্তরাষ্ট্র যেন এখন সেই মুরব্বিদের মতোই। তারা বলছে: ভালো একটি নির্বাচন করো, না হলে সেই চকলেটের মতো, আমেরিকান ভিসা পাবে না। যাঁদের এই ‘চকলেটের’ দিকে নজর, তারা একটু গা ঝাড়া দিয়েছেন বা দিচ্ছেন। বিশেষ করে যাঁরা পরিবারের সদস্যদের পাচার করেছেন বা প্রক্রিয়ায় আছেন, তাঁদের কপালে ভাঁজ দেখছি। শুধু বর্তমানের নয়, অতীতেরও যাঁরা ওই পথে ছিলেন, তাঁদেরও হিসাব–নিকাশ শুরু হয়েছে। এই সরকার কেন যাচ্ছে না—এ নিয়ে প্রহর গুনছেন যাঁরা, তাঁরাও খুশিতে বগল বাজাচ্ছেন দেখতে পাচ্ছি।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মি. ব্লিঙ্কেন তাঁদের নয়া ভিসা নীতি সম্পর্কে বলেছেন, এই নীতির আওতায় যেকোনো বাংলাদেশি ব্যক্তি যদি সে দেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের প্রক্রিয়া ব্যাহত করার জন্য দায়ী হন বা এ রকম চেষ্টা করেছেন বলে প্রতীয়মান হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র তাঁকে ভিসা দেওয়ার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারবে। অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বুধবার এ কথা ঘোষণা করেন। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, এর আওতায় পড়বেন বর্তমান এবং সাবেক বাংলাদেশি কর্মকর্তা, সরকার-সমর্থক ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্য, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিচার বিভাগ ও নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর সদস্যরা
গণতান্ত্রিক নির্বাচনপ্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে, এমন কাজের মধ্যে রয়েছে ভোট কারচুপি, ভোটারদের ভয় দেখানো, জনগণকে সংগঠিত হওয়ার স্বাধীনতা এবং শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকারচর্চাকে সহিংসতার মাধ্যমে বাধাদান। এর পাশাপাশি রাজনৈতিক দল, ভোটার, নাগরিক সমাজ এবং গণমাধ্যমকে তাদের মতামত প্রচার করা থেকে বিরত রাখতে বিভিন্ন ধরনের কর্মকাণ্ড নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করার পদক্ষেপের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত।
এর দফাওয়ারি বিস্তারিত ব্যাখ্যা মিলবে ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের ব্যাখ্যায়।
এসব ভিসা বিধিনিষেধ কার বা কাদের জন্য প্রযোজ্য হবে?
উত্তর: এই নীতি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচনপ্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত যেকোনো ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। অন্য অনেকের সঙ্গে বাংলাদেশের বর্তমান বা সাবেক কর্মকর্তা-কর্মচারী, সরকারের সমর্থক এবং বিরোধীদলীয় সদস্যরা এর অন্তর্ভুক্ত। এ ধরনের ব্যক্তিদের নিকটতম পরিবারের সদস্যরাও এর অন্তর্ভুক্ত থাকবেন।
এখন কি এই নীতিমালার আওতায় কোনো ভিসা বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে?
উত্তর: না। সেক্রেটারি অব স্টেট যেমনটা বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ভিত্তিতে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে একটি শক্তিশালী অংশীদারত্ব গড়ে তুলতে অঙ্গীকারবদ্ধ। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গীকারকে আমরা স্বাগত জানাই।
এই ভিসা বিধিনিষেধ কি সরকার বা আওয়ামী লীগের দিকে নির্দেশ করছে?
উত্তর: না, যুক্তরাষ্ট্র কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করে না। এই নতুন নীতির অধীনে বিধিনিষেধগুলো সংশ্লিষ্টতা–নির্বিশেষে সেই ব্যক্তিদের লক্ষ্য করে পরিচালিত, যাঁরা গণতান্ত্রিক নির্বাচনপ্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে এমন আচরণে/কর্মকাণ্ডে জড়িত।
যাঁদের ভিসা প্রত্যাহার করা হয়েছে, আপনারা কি তাদের অবহিত করবেন?
উত্তর: যাঁদের ভিসা প্রত্যাহার বা বাতিল করা হয়েছে, তাঁদের অবহিত করা একটি সাধারণ রীতি।
উচ্চ স্তরের আদেশ অনুসরণ করে যারা অপরাধ করে, তাদের জন্য ভিসা বিধিনিষেধ কীভাবে প্রযোজ্য হবে? আদেশ পালনকারীদের সঙ্গে উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদেরকে যুক্ততার বিষয়টি প্রমাণ করা যদি কঠিন হয়, তবে কী হবে?
উত্তর: বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচনপ্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত যেকোনো ব্যক্তির ক্ষেত্রে এই নীতি প্রযোজ্য।
রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের নিরাপত্তা হ্রাস করার বাংলাদেশ সরকারের ১৪ মের সিদ্ধান্তের প্রতিশোধ হিসেবে কি এই ঘোষণা?
উত্তর: বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আমাদের নিবিড় সহযোগিতার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা গত ৩ মে এই নীতিগত সিদ্ধান্ত সম্পর্কে তাদেরকে অবহিত করেছি।
বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র কেন এত চিন্তিত?
উত্তর: যুক্তরাষ্ট্র সর্বত্র অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনকে সমর্থন করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তাঁর সরকার বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনকে সমর্থন করার অঙ্গীকার করেছে। এই নীতিটি সেই প্রচেষ্টাকে এবং বাংলাদেশের জনগণকে সাহায্য করার জন্য প্রণীত হয়েছে, যাতে তাঁরা তাঁদের নেতা বেছে নেওয়ার জন্য নির্বাচন করতে পারেন।
মার্কিন কূটনীতি নানা ধাঁধায় ভরা। কাজেই এই নতুন কূটনীতির ভাষা বুঝতে হলে সেই ধাঁধাটি বুঝতে হবে। এর প্রতিটি শব্দ এবং প্রতিটি লাইনের মাঝখানে লুকিয়ে আছে নানা বার্তা ও নানা ব্যাখ্যা। সময়ই বলে দেবে কোন ব্যাখ্যায় কে খুশি বা কে বেজার হন। কাজেই বিষয়টি পরিষ্কার। যারা ‘নানা কৌশলে’ নির্বাচনী বৈতরণি পার হতে চান, আবার মার্কিন ভিসা ‘চকলেটের’ স্বাদও নিতে চান, তাঁদের জন্য এই ভিসা নীতি অস্বস্তিকর বটে। সরকার নয় শুধু, নির্বাচন পরিচালন পদ্ধতির সঙ্গে জড়িত সবাই, এমনকি সরকারবিরোধী অবস্থানে থেকেও যাঁরা নির্বাচনপ্রক্রিয়াকে বাধা দিতে চান, তাঁদের জন্যও বার্তা আছে এই নীতিতে।
মার্কিন এই মুরব্বিয়ানা নিয়ে নানা বিতর্ক আছে। একটি স্বাধীন দেশের প্রতি তাদের এই ‘ভিসা অস্ত্রের’ প্রয়োগ কতটা যুক্তিসংগত, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলা যায়।
তবে এই ‘চকলেটের’ লোভে না হলেও আমাদের ভালো নির্বাচনের দিকে যেতেই হবে। প্রধানমন্ত্রী নিজে যখন যুক্তরাজ্যে যেভাবে নির্বাচন হয়, সে ধরনের নির্বাচনের কথা বলেন, তখন আমরা আশাবাদী হই। খারাপ নির্বাচনের যত পদ্ধতি আছে, স্বাধীন বাংলাদেশের ৫২ বছরের দিকে তাকালে আমরা কমবেশি সব কটিরই উদাহরণ পাব। আমরা ভুয়া ভোটার দিয়ে সয়লাব ভোটার তালিকা যেমন দেখেছি, তেমনি ‘নিজেরা নির্বাচন করব না আবার কাউকে করতেও দেব না’ দর্শনের আলোকে জ্বালাও-পোড়াও-সংখ্যালঘু নির্যাতনের চিত্রও দেখেছি। সেসব নিয়ে আলোচনা এই লেখার উদ্দেশ্য নয়।
একটি ভালো নির্বাচন বলতে কী বোঝায়
প্রথমত, একটি স্বচ্ছ ভোটার তালিকা, যে তালিকায় ভোট দেওয়ার যোগ্য সবাই তালিকাভুক্ত হবেন, বাদ যাবেন না কেউ, বাড়তি কেউ যুক্ত হবেন না।
দ্বিতীয়ত, এই তালিকা মেনে নিয়েই সব দল নির্বাচনে অংশ নেবে।
তৃতীয়ত, নির্বাচনে দলগুলো পরিচ্ছন্ন প্রক্রিয়ায় প্রার্থী মনোনয়ন দেবে, মনোনয়ন–বাণিজ্য হবে না। রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত যোগ্যরাই মনোনয়নের জন্য বিবেচিত হবেন। অবসরপ্রাপ্ত সামরিক-বেসামরিক আমলা বা লুটেরা ব্যবসায়ী, গাছেরটা খেয়ে তলারটা কুড়ানোর মতো সুযোগসন্ধানীরা ঢালাওভাবে সুযোগ পাবেন না। কারণ, এঁরাই রাজনীতিকে কলুষিত করেন।
চতুর্থত, অংশগ্রহণকারী সব দল ও প্রার্থী প্রচারণার সমান সুযোগ পাবেন।
পঞ্চম, নির্বাচনের দিনে সব ভোটার নির্বিঘ্নে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে, পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে নিরাপদে বাড়ি ফিরতে পারবেন।
ষষ্ঠ, ভোটের পর সব দল ও সব প্রার্থী নির্বাচনের ফলাফল মেনে নেবেন।
সপ্তম, এসব প্রক্রিয়ায় সংবাদমাধ্যম যাতে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে পারে, তা নিশ্চিত করা হবে।
ভালো নির্বাচন অনুষ্ঠানের এই যে প্রক্রিয়া, তাতে শুধু একক কোনো দল, গোষ্ঠী বা সংস্থা নয়, দায়িত্ব পালন করতে হবে ওপর থেকে নিচে সংশ্লিষ্ট সবাইকে। সরকার ও বিরোধী দল সবাইকে।
শেষ করতে চাই আবারও যে কথা বলে, আমাদের একটি ভালো নির্বাচন করতে হবে দেশের জন্যই, ভালো রাজনীতির স্বার্থেই। আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা বলে, যখন রাজনীতি হারে, তখন দেশটিই হেরে যায়। সেই সুযোগে অপরাজনীতির হাত ধরে অরাজনীতির সুযোগসন্ধানীরা দেশের কাঁধে চড়ে বসে। এদের নামাতে দেশ ও রাজনীতিকে স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদে চরম মূল্য দিতে হয়।
কাজেই মার্কিন ‘ভিসা চকলেটের’ স্বাদ পেতে বা না পাওয়ার আশঙ্কা বা পেয়ে হারানো আতঙ্কে নয়, আমাদের ভালো একটি নির্বাচন করতে হবে আমাদের দেশ ও সুস্থ রাজনীতির স্বার্থেই। এই প্রতিশ্রুতিই প্রধানমন্ত্রী দিয়েছেন, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীও তা উল্লেখ করেছেন।
মনজুরুল আহসান বুলবুল সিনিয়র সাংবাদিক
সংবাদ টি পড়া হয়েছে :
১৭৮ বার