ফয়সল আহমদ রুহেল:: শ্রদ্ধেয় শিক্ষক এ.এফ. মসয়ূদুল হাসান মসরুর। তাঁর ছাত্ররা ডাকতেন ‘বাচ্চু স্যার’। তিনি সুনামগঞ্জের সরকারী জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক। কর্মজীবনে অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। পেয়েছেন প্রিয় শিক্ষকের সম্মাননা। নিষ্ঠার সঙ্গে অতিবাহিত করেছেন চাকরি জীবনের প্রথম থেকে শেষ দিন পর্যন্ত। শিক্ষক পিতা বাসা ভর্তি লোকজনের অন্নের চাহিদা মেটাতে গিয়ে মাঝে মধ্যে হিমশিম খেতেন। বড় সন্তানের কলেজের ফরম ফিলাপের টাকা জোগাড় করা অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। পরিবারের নিদারুন সেই কষ্টগুলো আজও পীড়া দেয়। সেই থেকে বদলে যান মানুষ গড়ার কারিগর শ্রদ্ধেয় এ শিক্ষক। যার ফলে বাকি পথটুকু নির্বিঘ্নে কেটেছিল। এই গুণী শিক্ষক দীর্ঘ ৩৫ বছর শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার পাশাপাশি তাদের জীবন গঠনে কাজ করে গেছেন অবিরত।
জন্ম : তিনি ১৯৪৩ সালের ২ এপ্রিল সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক উপজেলার মল্লিকপুর গ্রামের ‘দারুস সালাম’ এ জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মরহুম আবুল হাসান, মাতা ফয়জুন্নেছা চৌধুরী। পিতার পেশা ছিল শিক্ষকতা। এ.এফ. মসয়ূদুল হাসান সাত ভাই ও দুই বোনের মধ্যে চতুর্থ সন্তান। এই গুণী শিক্ষক বর্তমানে ‘আজিজ মনজিল’, হাসন নগর, সুনামগঞ্জে বসবাস করছেন।
তাঁর জন্মের সময় দাদী ও নানী উপস্থিত ছিলেন। জন্মের পর নাতীর নাড়ি দেখে নানী বলেছিলেন, ‘আমার নাতী বড় হয়ে অনেক বড় ব্যক্তি হবে। ইনশা আল্লাহ ওর সুখ্যাতি চারপাশে ছড়িয়ে পড়বে।’ যতদিন বেঁচে ছিলেন তিনি তাঁর এই নাতীকে অন্যদের চেয়ে যেন একটু বেশিই ভালোবেসেছেন। দোয়া করেছেন।
পিতৃ পরিচয় : শ্রদ্ধেয় শিক্ষক এ.এফ. মসয়ূদুল হাসান এর পিতা মো. আবুল হাসান ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের ১ জানুয়ারি সুনামগঞ্জ জেলার ছাতকের মল্লিকপুর গ্রামের ‘দারুস সালাম’ এ এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর শিক্ষা জীবন শুরু হয় মামা বাড়ি হবিগঞ্জে, সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে ৩য় শ্রেণীতে ভর্তির মাধ্যমে। সেখানে তিনি ডাবল প্রমোশন পান। ভর্তি হন সিলেট সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে। এই স্কুল থেকেই ১৯২৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অনুষ্ঠিত ম্যাট্রিকুলেশন এক্সামিনেশনে অংশ নিয়ে কৃতিত্বের সাথে ১ম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনেই এম.সি. কলেজ সিলেট থেকে ১৯২৫ সালে ইন্টারমিডিয়েট ইন-আর্টস পাশ করেন। একই কলেজ থেকে ১৯২৮ সালে কৃতিত্বের সাথে বি.এ. পাশ করেন। ফার্সি ছিল তখনকার সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারগুলোর পারিবারিক ভাষা। বিশেষ ভাষা হিসেবে ‘আরবী’ পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত থাকা সত্ত্বেও পিতার ফার্সি চর্চার ধারাবাহিকতায় তাঁরও ছিল ফার্সির প্রতি অগাধ ভালোবাসা। ছিল গণিত প্রীতি। বলতেন, ‘বোকারা অংক বুঝে না!’ বি.এ. ক্লাসে পড়তে গিয়ে অবসরের অধিকাংশ সময়ই তাঁর কেটে যেত গণিত ক্লাসে। যদিও সেটা সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত কোনো বিষয় ছিল না। শিক্ষা বিভাগের চাকরীতে যোগদান করেন ১৯৩৫ সালের ১২ নভেম্বর। প্রথমে তিনি সাব-ইন্সপেক্টর অব স্কুলস (হালিয়াকান্দি, করিমগঞ্জ) হিসেবে এবং পরে শিলচর নরমাল স্কুলে শিক্ষাদান শুরু করেন। পরবর্তীতে ১৯৩৭ সালের ১৮ মে শিলচর উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক পদে যোগদান করেন। ১৯৩৬-৩৭ শিক্ষাবর্ষে আসামের শিলং-এ অবস্থিত সেন্ট এন্ড মান্ডস কলেজ থেকে বি.টি. (ব্যাচলর অব টিচিং) প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এরই মধ্যে বিয়ে করেন ফয়জুন্নেছা চৌধুরীকে। তিনি শিলচরে অবস্থিত Physical Training camp-এ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এছাড়াও স্কাউটিং এ Wood Badge সনদপ্রাপ্ত হন। ১৯৪২ সালের ৬ মার্চ আসাম ব্রাঞ্চ কর্তৃক আয়োজিত Indian Red Cross Society থেকে Junior Red Cross প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। সরকারী জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয়, সুনামগঞ্জে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন ১৯৪২ এর দিকে। সুদীর্ঘ ২৩ বছর তিনি এই বিদ্যালয়ে অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে শিক্ষাদানে সম্পৃক্ত ছিলেন। বাংলা পড়াতে বসলে মনে হত তিনি বাংলার শিক্ষক। ইংরেজি পড়াতে বসলে ইংরেজির। আর গণিত তো ছিলই। দক্ষতা ছিল ভূগোল-এও। (ছাত্রদের ভাষ্য)। এই স্কুল থেকেই ১৯৬৫ সালের ডিসেম্বরে তিনি সরকারী চাকুরী থেকে অবসরে যান। পরবর্তীতে ১৯৬৭-১৯৬৮ সালের দিকে জামালগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ে কয়েক মাস প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন।
স্যারের পিতার বর্ণাঢ্য জীবন : আবুল হাসান স্যারের বড় ভাই খুব বেশি পড়াশুনা করতে পারেননি। কিন্তু তার ভাইদের আরাম ও চাহিদার দিকে তিনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতেন। তিনি তার ভাইদের কলেজ হোস্টেলে খাবার এবং টাকা নিয়ে মাঝে মাঝে যেতেন। তিনি আবুল হাসানের সাফল্যকেও উপভোগ করতেন। ১৯৫০ সালের মাঝামাঝির দিকে হাসান তাঁর শিলচরের বাংলোতে বসে আছেন। তিনি তাঁর নিজের জেলা সুনামগঞ্জে ফিরে জুবিলী স্কুলে যোগ দেওয়ার পরিকল্পনা করছেন। তখনকার সময় তাঁর বন্ধুরা যারা আইসিএসে যোগ দিয়েছে তারা বড় সরকারী অফিসার হিসাবে ভারতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তার সমস্ত আইসিএস বন্ধুরা তাকে পাগল মনে করতেন। তিনি বরং শিক্ষা দিয়ে সমাজকে আলোকিত করতে চান। হাসান স্যার জানেন যে তিনি সঠিক এবং ১০০ বছর ধরে তার নাতি-নাতনি এবং আগামী প্রজন্ম তার সিদ্ধান্তে গর্বিত হবে। তার আরেক স্কুল বন্ধু আব্দুল ওয়াদুদও তাদের স্থানীয় স্কুলে শিক্ষকতা করেন। হাসান স্যার, এই সুন্দর শহর শিলচর এবং গাছে ঘেরা সবুজ বাংলো পছন্দ করতেন। তিনি শিলচর থেকে ফিরে আসার সময় অনুরূপ একটি বাংলে নির্মাণের পরিকল্পনা করেন। তিনি বাড়ির জন্য একটি নামকরনের পরিকল্পনা করেন সেটা ‘আজিজ মঞ্জিল’…তার বাবার নামে। বছর দু’য়েক পরে তিনি তার নিজ জেলায় ফিরে আসেন। সব ছেলেমেয়ে, ভাতিজা-ভাতিজী ও বড় ভাগ্না তাঁর সাথে থেকে স্কুলে পড়াশোনা করতো। তিনি তাঁর বাচ্চাদের এবং অন্যান্য বাচ্চাদের ভাল শিক্ষা পেতে দেখে গর্ববোধ করেন। তিনি তার এক ছেলে একই স্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করতে অনুপ্রাণিত করেন। ছেলে মসরুর তার বাবার পায়ের ধাপ অনুসরণ করেছেন, তাঁকে গর্বিত করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ফজরের আযানের পূর্ব মুহুর্তে গুণী শিক্ষক মো. আবুল হাসান না ফেরার দেশে চলে যান। মরহুম আবুল হাসান শিক্ষকতা জীবনে তার ছাত্রদের অসম্ভব ভালোবাসতেন। ভালোবাসতেন সুনামগঞ্জকে।
শিক্ষাজীবন : এই গুণী মানুষটি ১৯৫১ সালে সরকারী জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয়, সুনামগঞ্জে ৩য় শ্রেণীতে ভর্তির মাধ্যমে তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু করেন। একই বিদ্যালয় হতে ১৯৫৯ সালে তিনি ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর সুনামগঞ্জ কলেজ থেকে ১৯৬১ সালে ইন্টারমিডিয়েট ও ১৯৬৩ সালে একই কলেজ থেকে বি.এ. পাশ করেন। ১৯৬৫ সালে টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, ময়মনসিংহ থেকে কৃতিত্বের সাথে বি.এড. সম্পন্ন করেন।
কর্মজীবন : এই গুণী শিক্ষক বি.এড. করার পূর্বে দরগা পাশা উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রথম কর্মজীবন শুরু করেন। সেখানে বেশ কিছুদিন স্কুলের পাশের একটি বাড়িতে লজিং থেকেছেন। টিচার্স ট্রেনিং শেষ করে রাজানগর উচ্চ বিদ্যালয়, দিরাই এ অল্প কিছুদিন শিক্ষকতা করেন। এসময় চট্টগ্রামের জেলা শিক্ষা অফিসার আকিকুর রেজা চৌধুরী সাহেবের অনুপ্রেরণায় চট্টগ্রাম শিক্ষা অফিসে ‘সাইফুদ্দিন আহমদ পীর’ সহ যোগাযোগ করেন। চট্টগ্রাম শিক্ষা অফিসের ডি.ডি. সরাসরি চাকুরির আদেশনামা দেন। সুনামগঞ্জে ফিরে এসে স্কুলে পিতার মাধ্যমে কাগজপত্র জমা দেন। স্কুলে তখন শিক্ষক সংকট। সরকারি জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ আবদুল গণি পরদিনই স্কুলে যোগদানের অনুরোধ জানান। পিতার দেখানো পথ অনুসরণ করে শিক্ষকতার মহান পেশায় এ.এফ. মসয়ূদুল হাসান ১৯৬৫ সালের ১২ জুন সরকারী জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয়, সুনামগঞ্জে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। বয়স তখন মাত্র বাইশ বছর। নিজের পিতাকে যেমন শিক্ষক হিসেবে পেয়েছেন, তেমনই কিছুদিন সহকর্মী হিসেবে পেয়েছেন। নিজের শিক্ষকদের ও পিতৃতুল্য সহকর্মীদের স্নেহধন্য হয়েছেন সব সময়। বয়স কম থাকায় ও শিক্ষকের ছেলে হিসেবে নিজের নাম না হওয়া সত্ত্বেও ছাত্ররা তাকে ‘বাচ্চু স্যার’ নামে ডাকতে শুরু করে। পরবর্তীতে নিজের নামকে ছাপিয়ে তিনি ‘বাচ্চু স্যার’ নামেই ছাত্রদের মধ্যে পরিচিতি লাভ করেন।
তিনি ১৯৮৯ সালে সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে পদোন্নতিপ্রাপ্ত হয়ে লক্ষ্মীপুর আদর্শ সামাদ উচ্চ বিদ্যালয়ে বদলি হন। তারপর কিছুদিন সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে সরকারী এস.সি. বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, সুনামগঞ্জ এবং পরবর্তীতে সরকারী জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয়, সুনামগঞ্জে বদলি হন। ১৯৯৩ সালে প্রধান শিক্ষক হিসেবে আবারও পদোন্নতি হয়। তাঁর তখনকার কর্মস্থল রাজার বাজার সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়, হবিগঞ্জ। সেখান থেকে ১৯৯৪ সালে সরকারী এস.সি. বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, সুনামগঞ্জ এবং একই বছর সরকারী জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয়, সুনামগঞ্জে প্রধান শিক্ষক হিসেবে বদলি হন। দীর্ঘ ৬ বছর সরকারী জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন শেষে ২০০০ সালের এপ্রিলে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। তখনকার সময় তিনি কয়েক মাস জেলা শিক্ষা অফিসারের দায়িত্ব পালন করেন। যে স্কুলে শিক্ষা জীবন শুরু করেছিলেন সেই স্কুল থেকেই অবসর গ্রহণের এমন ঘটনা বিরল।
কৃতিত্ব : মানুষ ও জাতি গঠনের কারিগর এই শিক্ষক ১৯৯৪ সালে শ্রেষ্ট সমবায়ী হিসেবে ‘জাতীয় সমবায় পদক’ সনদপ্রাপ্ত হন ১৯৯৭ সালে। ১৯৯৪-২০০৫ সাল পর্যন্ত জেলা স্কাউট কমিশনারের দায়িত্ব পালন করেন। দীর্ঘদিন তিনি স্কাউটের সহ সভাপতি পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। এছাড়া স্কাউট থেকে মেডেল অব মেরিট সনদপ্রাপ্ত হন ২০০৫ সালে। ২০১২ সালের ১০ জানুয়ারি ’দৈনিক কালের কণ্ঠ’ আয়োজিত প্রিয় শিক্ষক সম্মাননায় ভূষিত হন। শিক্ষকতায় অসামান্য অবদানের জন্য ‘বন্ধু এক্সপ্রেস সুনামগঞ্জ’ থেকে ২০১৯ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ‘শিক্ষক সম্মাননা’ পান। একই বছর সারেগামাপা ‘আলোকিত বাতিঘর’ হিসেবে ‘শিক্ষা গুরু’ সম্মাননা প্রদান করে।
শৈশব : তিনি জুবিলী স্কুলে যখন ৩য় শ্রেণীতে ভর্তি হন তখন পরীক্ষা নেন আব্দুল মান্নান পীর স্যার। ভর্তির সময়ের কথা এখনও মনে পড়ে এই শিক্ষকের। স্যার চক হাতে ধরিয়ে ব্ল্যাক বোর্ডে লিখতে বলেছিলেন। ‘অ’, ‘আ’, ‘ঈ’। দুরু দুরু বক্ষে লিখা কালো বোর্ডে ধবে ধবে সাদা রঙের অক্ষরগুলো দেখে স্যার মুগ্ধ হয়ে বলেছিলেন ‘বেশ! তুমি পাশ করেছো। তৃতীয় শ্রেণীতে তোমাকে ভর্তি করা হলো।’
শিক্ষা জীবনের স্মরনীয় ঘটনা : শিক্ষক পিতা গণিতে ছিলেন দুর্দান্ত। পিতার অংক প্রীতি থাকলেও মসরুর নিজে ছিলেন অংক-ভীতু। ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষার সময় আগের রাতে বাবার কাছে সরল অংক, ঐকিক নিয়মের অংক, জ্যামিতি যা যা পড়েছিলেন সবই প্রশ্নপত্রে হুবহু চলে এসেছিল। পরীক্ষার খাতায় তাই সরল অংকই প্রথমে সমাধান করেছিলেন তিনি। এটা নিয়ে পিতার উচ্ছ্বাসের সীমা ছিল না। পাশ করে সুনামগঞ্জ কলেজে ভর্তি হন। কলেজ তখন ছিল বেসরকারী। বাজারের পয়েন্টে।
বি.এ. শেষ করে আইন শাস্ত্রে পড়ার উদ্দেশ্যে তিনি ও সহপাঠী দিলীপ লাহিড়ি এক সাথে চলে যান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। অভিভাবক ছিলেন বড় ভাই। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে দেখলেন ভর্তি পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে। দর্শন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান তখন গোবিন্দ চন্দ্র দেব (শহীদ বুদ্ধিজীবী জি.সি দেব)। তারা স্যারের কাছে অনুরোধ করতে গিয়েছিলেন। উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘দেখ হে বাপু, পরীক্ষা তো শেষ। তোমরা বরং বাসায় ফিরে গিয়ে লেখা পড়া কর। আর কোনো প্রাইভেট স্কুলে চাকরি নিয়ে পড়াতে থাক। টাকাও রুজি হবে আর জ্ঞানেরও চর্চা হবে।’
ট্রেনিংয়ের দিনগুলো : তিনি বি.এড. করেছেন বড় ভাইয়ের সহপাঠী ‘সাইফুদ্দিন আহমদ পীর’ এর সাথে। সুনামগঞ্জ থেকে এই ব্যাচে তখন তারা দু’জন। ট্রেনিং এর পাশাপাশি তারা দু’জনে অনেক সুন্দর সময় কাটিয়েছেন। কখনও বন্ধু হিসেবে, কখনও বড় ভাই হিসেবে সাইফুদ্দিন পাশে থেকেছেন। পরীক্ষায় ক্লাস নেওয়ার সময় কলেজের স্যারেরা ক্লাস পর্যবেক্ষন করতেন। মন্তব্য লিখতেন। কলেজের প্রিন্সিপাল ও ভাইস প্রিন্সিপাল তাঁর ক্লাস দেখে মুগ্ধ হয়ে লিখেছিলেন, ‘The Teacher talks less but works actively with the students which is very good.’ সহপাঠীদের অনেকে মন্তব্য দেখে বলেছিলেন, ‘তোমার প্রথম শ্রেণী পাওয়া কেউ আটকে রাখতে পারবে না।’
কষ্টের দিনগুলো : আদর্শ এই শিক্ষকের কলেজে পড়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা ছিলো তার বড় ভাই ‘ছৈয়দুল হাসান’ এর। তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। পরিবারের সদস্যদের অন্নের চাহিদা মেটাতে গিয়ে আই.এস.সি.পরীক্ষার আগে কলেজের ফরম ফিলাপের সময় শিক্ষক পিতার জন্য টাকা জোগাড় করা অসম্ভব হয়ে গিয়েছিল। সেই দু:খটুকু মনে রেখে ছোট ভাইয়ের পড়া যাতে মাঝপথে বন্ধ হয়ে না যায় সেজন্য প্রথম থেকেই প্রতিমাসে অল্প অল্প করে টাকা জমিয়ে রেখেছিলেন তিনি। তাঁর জন্যই বাকি পথটুকু নির্বিঘ্নে কেটেছিল। ছৈয়দুল হাসান ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও ছাতক থানা সংগ্রাম কমিটির সেক্রেটারী।
পাঠশালা থেকে পলায়ন : শ্রদ্ধেয় শিক্ষক এখনও শৈশবের গল্প বলতে গিয়ে হাসতে হাসতে পুলকিত হন! প্রথম পাঠশালা থেকে পালিয়ে আসার গল্প যারা আশেপাশে থাকেন তারাও মন্ত্রমুগ্ধের মতো গল্পগুলো শুনেন!
বড় ভাইসাহেব তয়ফুরের পিছু পিছু চলেছেন ছোট দুই ভাই; তয়মুর আর মসরুর। গন্তব্য সুনামগঞ্জের স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান ‘রাজগোবিন্দ মধ্যবঙ্গ প্রাথমিক বিদ্যালয়।’ পিতার উপদেশ পালনে সদা নিবিষ্টি তয়ফুর। বাবার মুখ-নি:সৃত বাণীই যেন আদেশ, শিরোধার্য! বিদ্যালয়ের আঙ্গিনায় প্রবেশ করতেই বুকের টিপটিপানি টের পেলেন তয়মুর, মসরুর। বুকে যত সাহসই থাকুক না কেন, প্রথম পাঠশালায় ভর্তি হওয়া বলে কথা! বড় ভাই সাহেব মাস্টার মশাইয়ের সাথে কিছুক্ষণ আলাপ করলেন। সব শেষে ছোট দুই ভাইয়ের ভর্তি নিশ্চিত করে মনের আনন্দে বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলেন। অন্যদিকে, শ্রেণীকক্ষে তখন সেনবাবু মাত্র প্রবেশ করেছেন। ভেতরে ঢুকার সাথে সাথেই ছাত্রদের চোখ-মুখ অন্ধকার হতে শুরু করলো।
রাশভারী, হালকা পাতলা গড়নের মাস্টার মশাইয়ের হাতে ইয়া বড় বেত। সেই বেত দিয়ে তিনি একের পর এক ছাত্রকে পিটুনি দিয়েই চলেছেন। তয়মুর আর মসরুরের তখন গলা শুকিয়ে কাঠ! ছাত্রদেরই কারো মুখে শুনেছেন, মাস্টার মশাই কানে কম শোনেন! এখন উপায়! দুই ভাই মিলে ফন্দি আটলেন। এ বন্দিশালা থেকে যে করে হোক মুক্তি পেতেই হবে। কিন্তু, সমস্যা হলো কে গিয়ে মাস্টার বাবুর সামনে দাঁড়াবেন? তয়মুর না মসরুর! মেজ ভাই সাহেবের পীড়াপীড়িতে মসরুর গেলেন মাস্টার মশাইয়ের সামনে। দুরুদুরু বুকে গড়গড় করে বলতে লাগলেন, ‘মাস্টার বাবু! আমরা তো আজই প্রথম পাঠশালায় এসেছি! আমাদের সাথে কোনো বই নেই, শ্লেট পেনসিলও নেই। আমরা না হয় আগামীকাল থেকে ইশকুলে আসবো।’ কি মনে করে মাস্টার বাবু তাদের দুই ভাইকে ছুটি দিয়ে দিলেন। পাঠশালার বাইরে এসে দুই ভাই হাফ ছেড়ে বাঁচলেন! এদিকে, তয়ফুর ফেরার আধ ঘন্টার মধ্যে তয়মুর, মসরুর পাঠশালা থেকে কোনো রকমে পালিয়ে আসায় পিতা আবুল হাসান সাহেব হতবাক হয়ে গেলেন। কী বৃতান্ত! ছেলেদের কাছে শোনা পাঠশালার মাস্টার বাবুর আচরণের জন্য কুণ্ঠাবোধ করলেন। সেবারের মতো ইসকুল পালানো দুই ছেলে পাঠশালার নির্দয় পরিবেশ থেকে মুক্তির স্বাদ নিলেন।
পারিবারিক জীবন : শ্রদ্ধেয় শিক্ষক বিয়ে করেন বড়লেখা মহবন্দ নিবাসী মরহুম মঈনুদ্দিন চৌধুরীর বড় মেয়ে মরিয়ম চৌধুরীকে। স্ত্রীর পিতাও একজন শিক্ষক ছিলেন। গুণী এই শিক্ষক দুই ছেলে ও দুই মেয়ের জনক।
২০২২ সালে অবসরপ্রাপ্ত গুণী শিক্ষকদের নিয়ে কাজ করা হবিগঞ্জ সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের স্বনামধন্য শিক্ষক সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার উপজেলার কৃতি সন্তান জনাব টি, আলী স্যারের নামে প্রতিষ্ঠিত যুক্তরাজ্য ভিত্তিক চ্যারেটি সংস্থা টি, আলী স্যার ফাউন্ডেশন সুনামগঞ্জ জেলার প্রত্যেক উপজেলায় অবসরপ্রাপ্ত দুইজন আদর্শ শিক্ষককে সম্মাননা পদকে মনোনয়নে জরিপ চালিয়ে যাচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার অবসরপ্রাপ্ত আদর্শ শিক্ষকের সম্মাননার স্বীকৃতি হিসেবে টি, আলী স্যার ফাউন্ডেশন সম্মাননা পদকের মনোনয়ন পেয়েছেন তিনি। সুনামগঞ্জ জেলার ১২ উপজেলার ২৪ জন মনোনয়নপ্রাপ্ত শিক্ষকদের জীবনী ধারাবাহিকভাবে লিখছেন ফাউন্ডেশনের সভাপতি টি, আলী স্যারের পুত্র বৃটেনের জনপ্রিয় চ্যানেল এস টেলিভিশনের সাংবাদিক ফয়সল আহমদ (রুহেল)। উল্লেখ্য, ২২ জন মনোনয়নপ্রাপ্ত অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের মধ্যে থেকে আর্থিক দিক থেকে পিছিয়ে থাকা ৫ জনকে আর্থিক সহযোগিতা এবং জেলার আদর্শ শিক্ষকের স্বীকৃতি হিসেবে ৫ জন শিক্ষককে টি আলী স্যার ফাউন্ডেশন সম্মাননা পদকে ভুষিত করবে সংস্থাটি।
গুণী শিক্ষক এ.এফ মসয়ূদুল হাসান দীর্ঘ ৩৫ বছর শিক্ষকতা জীবনে শিক্ষার্থীর ভেতরের সত্ত্বাকে জাগিয়ে তুলেন। তাঁর মেধা, প্রজ্ঞা, সহমর্মিতা, উদারতা, নৈতিকতা দিয়ে শিক্ষার্থীদের হৃদয় জয় করেন। এক শিক্ষকের বিদায় ও তদস্থলে অন্য শিক্ষকের আগমন ঘটে। প্রকৃতি শূন্যস্থানে বিশ্বাস করে না। কিন্তু শূন্যস্থানে কারো কারো অভাব অনুভব করে দীর্ঘকাল। শ্রদ্ধেয় মসরুর স্যার এর অভাব অনুভব করবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। আমরা এই গুণী শিক্ষকের দীর্ঘায়ূ ও সুস্বাস্থ্য কামনা করি।
সংবাদ টি পড়া হয়েছে :
৮৯৮ বার