২০০৬ সালে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে শান্তিতে নোবেল পান ক্ষুদ্রঋণের প্রবক্তা হিসেবে পরিচিত গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের তদবিরের কারণেই ইউনূস নোবেল পেয়েছিলেন বলে চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ করেছে মার্কিন একটি দৈনিক। ডেইলি কলার নামের ওই দৈনিকের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে অভিযোগ এনে বলা হয়েছে, ইউনূসের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তিতে হিলারি ক্লিনটন গোপনে তদবির করেছিলেন। শুধু তাই নয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি উপদেষ্টা ও ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের বিরুদ্ধে আর্থিক হিসাব তদন্তের হুমকি দিয়েছিল মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর। মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে তদন্ত ঠেকাতে হিলারি ক্লিনটন নেতৃত্বাধীন তৎকালীন পররাষ্ট্র দফতরের কর্মকর্তারা এ হুমকি দিয়েছিলেন।

২০১২ সালের মে মাসে বাংলাদেশ সরকার ইউনূসের বিরুদ্ধে গ্রামীণ ব্যাংকের অর্থনৈতিক অনিয়মের বেশ কিছু অভিযোগ তদন্তে একটি কমিশন গঠন করে। ক্লিনটন ফাউন্ডেশনের অন্যতম দাতা ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত সজীব ওয়াজেদ জয় সেই সময় মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর থেকে আর্থিক হিসাব তদন্তের হুমকি পেয়েছিলেন বলে স্বীকার করেছেন ডেইলি কলারের কাছে। এই প্রথম মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর দেশটির অভ্যন্তরীণ রাজস্ব বিভাগকে ব্যবহার করে ক্লিনটন ফাউন্ডেশনের ঘনিষ্ঠ এক দাতাকে বাঁচানোর চেষ্টা করে।

সজীব ওয়াজেদ জয় ডেইলি কলারকে বলেছেন, ইউনূসের বিরুদ্ধে কমিশনের তদন্ত আটকাতে তার মায়ের ওপর প্রভাব খাটাতে ২০১০ এবং ২০১২ সালের মাঝে বারবার মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের কর্মকর্তারা চাপ প্রয়োগ করেছিলেন। ২০১৩ সালের শুরুর দিকে তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে কমিশন। জয় বলেন, তারা আমাকে অভ্যন্তরীণ রাজস্ব বিভাগের তদন্তের মাধ্যমে হুমকি দিয়েছিলেন। আমি যুক্তরাষ্ট্রে গত ১৭ বছর ধরে বৈধভাবে বসবাস করে আসছি এবং কখনই সমস্যা দেখা দেয়নি। কিন্তু ওই কর্মকর্তারা আমার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরুর হুমকি দেয়। সজীব ওয়াজেদ জয় বলেন, ‘তারা বার বার বলতেন, ইউনূসের প্রভাবশালী অনেক বন্ধু আছে এবং সবাই হিলারি ক্লিনটনের বিষয়টি তো জানেই। প্রত্যেকেই জানে যে হিলারিও তার বন্ধু।’ ছেলের ওপর চাপ প্রয়োগের বিষয়টি গত ফেব্রুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জার্মানির মিউনিখে এক অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানে প্রকাশ্যে আনেন। মুহাম্মদ ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে বহাল রাখতে সজীব ওয়াজেদ জয় কে চাপ প্রয়োগ করে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর।

শেখ হাসিনা বলেন, হিলারি ক্লিনটন আমাকে ফোন করেছিলেন এবং একই ধরনের চাপ দিয়েছিলেন। এমনকি মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর আমার ছেলেকে তিনবার তলব করেছিল। আমরা সমস্যায় পড়তে যাচ্ছি বলে তাকে (জয়কে) বলা হয়েছিল। হাসিনা বলেছেন, ইউনূসের ব্যাপারটিকে হিলারি হালকাভাবে নেবে না বলে জয়কে জানিয়েছিল পররাষ্ট্র দফতর। তারা বলেছিল, তোমার মাকে রাজি করো। তবে এ বিষয়ে বিস্তারিত কোনো তথ্য দেননি প্রধানমন্ত্রী।

২০১২ সালে জয়ের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের রাজস্ব বিভাগের চাপের সময়ই বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুতে ১২০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ বাতিল করে। কানাডার দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ঘুষের অভিযোগ এনে ওই ঋণ বাতিল করলেও দেশটির একটি আদালত উভয়ের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের প্রমাণ পায়নি উল্লেখ করে খালাস দেয়। সেই সময় মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারির সঙ্গে দু’বার সাক্ষাৎ করেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি। ডেইলি কলারকে দীপু মনি বলেন, বিশ্বব্যাংকের ঋণ বাতিলের সঙ্গে ইউনূসের সংশ্লিষ্টতা ছিল। তবে যুক্তরাষ্ট্র সরকার অথবা পররাষ্ট্র দফতরের কোনো চাপ ছিল কিনা তা বলতে পারব না। তিনি বলেন, আমি শুধু দুটি বিষয় বলতে পারি : প্রথমটি হচ্ছে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর পক্ষ থেকে যোগাযোগ এবং অপরটি বিশ্বব্যাংকের ঋণ প্রত্যাহার। বিশ্বব্যাংকের ঋণ বাতিলে ইউনূসের ভূমিকা সরাসরি ছিল বলে মন্তব্য করেছেন দীপু মনি। তিনি বলেন, অধ্যাপক ইউনূস শাস্তি দিতে চেয়েছিলেন অথবা প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলেন। বাংলাদেশ সরকারকে শাস্তি দিতে চেয়েছিলেন বিশেষ করে শেখ হাসিনাকে।

‘ইউনূস জানতেন পদ্মা সেতু আমাদের অর্থনীতি ও সরকারের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। দেশের দক্ষিণাঞ্চলকে পুনরুজ্জীবিত করবে এই সেতু।’ দীপু মনি বলেন, অবশ্যই ইউনূস যে পরিস্থিতিতে পড়েছিলেন তা থেকে বাঁচতে চেয়েছিলেন এবং সরকারকে শাস্তি দিতে চেয়েছিলেন। তিনিও মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর থেকে হুমকি পেয়েছিলেন বলে দাবি করেছেন। জয় বলেছেন, সব স্তর থেকে হুমকি এসেছিল। বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন দূতাবাস থেকে শুরু করে পররাষ্ট্র দফতরের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের কাছ থেকেও হুমকি এসেছিল। যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানীতে বসবাস করার কারণে প্রতিনিয়ত পররাষ্ট্র দফতরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে তার দেখা হতো। তিনি অনেককেই বন্ধু এবং সহকর্মী হিসেবে মনে করতেন। কিন্তু ২০১০ সালের শুরু দিকে হঠাৎ করেই তাদের সুর পাল্টে যায়। জয় বলেন, আগে আমরা ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতি ও জাতীয় নিরাপত্তার মতো বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলতাম। কিন্তু এরপর তারা শুধুমাত্র ইউনূসের বিষয়টি সামনে আনত। ইউনূসকে বাঁচানোই তাদের ঘোরে পরিণত হয়েছিল।

২০১৬ সালের আগস্টে বার্তাসংস্থা এপির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে ইউনূসের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরুরপর ক্লিনটন গ্রামীণ ব্যাংকের এই পরিচালকের বিরুদ্ধে অন্তত তিনবার সাক্ষাৎ করেন। তদন্ত চলাকালীন হিলারির কাছে পাঠানো বার্তায় সহায়তা চান ইউনূস। এরপর ইউনূসকে কীভাবে সহায়তা করা যায় সে বিষয়ে উপায় খুঁজতে কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন হিলারি। ক্লিনটনের ফাঁস হওয়া ই-মেইলে দেখা যায়, পররাষ্ট্র দফতরের কর্মকর্তা মেলানি ভারভির প্রতিনিয়ত ইউনূসের বিষয়ে হিলারিকে হালনাগাদ তথ্য অবগত করতেন। অন্য পথেও ইউনূসকে সহায়তা করতেন হিলারি। ২০০৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিষয়ক সংস্থা গ্রামীণ ফাউন্ডেশনের একটি প্রকল্পে এক কোটি ৬২ লাখ ডলার অর্থায়ন করে। এছাড়া পৃথকভাবে আরো ২২ লাখ ডলার দেয়া হয় ইউনূসের এই ফাউন্ডেশনে।-আওয়ার নিউজ

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn