ইশতিয়াক রুপু–

সকাল হতে অঝোর ধারায় বৃষ্টি। ম্যানহাটানের সতর তলার স্টুডিও এপার্টমেন্ট হতে তাই দেখেছেন সাইফুল আলম। এক কাপ কফি হলে মন্দ হতো না। কিন্তু বৃষ্টি ঝরার এই নন্দন রূপ হতে চোখ সরাতে ইচ্ছে করছে না। বৃষ্টির সাথে এ ভালোবাসা আজকালের নয়। শৈশবে নিজ শহরের বৃষ্টির স্মৃতি কখনো ভুলবার নয়। ভীষন বৃষ্টি হতো ছোট এই শহরে। মনে হতো মেঘালয় পাহাড় হতে ভেসে আসা সব মেঘ বুঝি ভেঙ্গে পড়বে শহরের আধ পাকা রাস্তায়। বিরামহীন ভাবে চলতো। থামলে পড়ে দেখা গেলো পুরো শহর আধডোবা হয়ে আছে।  সেই মায়ার শহর ছাড়তে হলো মধ্য বয়সে।  ঠিকানা বদল করতে হলো সন্তান দের নিরাপদ  ভবিষৎ ভেবে।  সরকারী অফিসের খুটিতে টাংগানো পতাকার রঙ ডিজাইন সব বদলে গেলো। লাল সবুজ আর দেখা যায় না। সাদা আর নীল রঙের মধ্যে গুনে গুনে পন্চাশ টি তারা। যার একটি তে আপন নিবাস। মাঝে মাঝে মনে হয় বিশাল এই দেশে হারিয়ে গেলেন কিনা।  একাকি কষ্ট পান যখন দেখেন না। মোড়ে শুনশান দুপুরে কিক্সাওয়ালা ভাই রিকসার নীচে বসে হাতের পুরানো গামছা দিয়ে বাতাস করছে। চোখে পড়ে না পাড়ার মাস্টার বাবু সকালে তড়িগড়ি করে বাজারের ব্যাগ নিয়ে ছুটে আসছেন বাড়ীর দিকে। স্কুলের সময় হয়ে গেলো বোধকরি।  মোড়ের চত্তরে পাশের রেলিং এ বসা ছোট খাটো শরীরের মহিলা পুলিশ দের।  মাথার চুল টান টান করে আছড়ানো। তবে কোন ফুল নেই আছড়ানো চুলের ডান কিম্বা বাম পাশে। দেখলেই বুঝা যায়। মফস্বল শহরের মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। পরিবারের সবার মন জুগিয়ে। সুযোগ করে। স্বপ্ন মাথায় রেখে। ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেই এ চাকুরী তে ঢুকে পড়া।  পাশের গার্লস হাই স্কুলে পড়ুয়া বোনদের প্রটেকশন ডিউটি। যাতে বাজে ছেলে গুলি ইভটিজিং না করতে পারে। অথচ আপন বোন টি পাশের গ্রামের স্কুলে যেতে বাবাকে সাথে নিয়ে যায়।

ফিরে এলেন সাইফুল নিজের মাঝে। বাবার সখে শহর ছেড়ে বড় শহরে গিয়ে পড়াশুনা। আয়েশি ঢংগে হাল্কা বিলাসিতায় শিক্ষা শেষ করে প্রিয় শহরে ফেরত। সাহিত্য, উপাসন,  প্রেম, খেলা ধূলা সব সাবজেক্টের ক্লাশে নাম ছিলো। সাথের বন্ধু সহপাঠীরা হিসেব করেই পদবী হাসিলের পথে হাঁটলেও। সাইফুল ভাবলো, বেশতো আছি। এতো কিসের প্রয়োজন। ছোট জীবনে আনন্দ থাকা টাই জরুরী। আর কি চাই।  দেশের বাইরে আসতে হবে জানা ছিলো। মনে মনে নিজেকে তৈরী রেখেছিলেন। তাই সব অনুকূল প্রতিকুল সব সময়কে সামনা করলেন সফল ভাবেই।  প্রথমে অন্য রাজ্যে থিতু হতে চেয়েও দুয়ে দুয়ে চার হলো না। চলে আসতে হলো নিউইয়র্কে।
স্বপ্নের শহর। দিন রাত জেগে থাকবার শহর। কিন্তু আসতে হলো বড্ড অসময়ে। সারা আমেরিকার মন্দার ঢেউ নিউইয়র্কে। চাকরী যেনো সোনার হরিন। যে যেদিকে বলেন সেদিকে যান। চেস্টা করেও ভালো কিছু না পেয়ে শুরু করেন অড জব। সব কিছু মানিয়ে নিয়ে সংসারের দেখভাল করলেন গুনে গুনে পনরটি বৎসর। সন্তান দুজন নতুন জীবন কে শুধু মেনেই নেয়নি। বেশ মনোযোগ দিয়ে পড়া শুনা শেষ করে উন্নত জীবন বেছে নিলো। ভালই আছে সন্তান দুজন। বিয়ে থা করে স্বামীদের চাকুরীর সুবাধে দুজনই নিউইয়র্কের বাহিরে।  বাবাকে নিয়ে যেতে দুজনের কতই না যুক্তি অনুরোধ শেষমেশ কান্না কাটি।  না এর কোন কিছুই আর কাজে আসেনি। সাইফুল আলম থেকেই গেলেন নিউইয়র্কে।

মনের সংগে একাকী কথা বলেন। কি করে মেয়েদের বুঝাবেন। এই শহরে যে আছে এক টুকরো বাংলাদেশ। সেখানে বাতাসে বাংলাদেশ । হৃদয়ে বাংলাদেশ। এই ছোট্ট বাংলা দেশে বেড়াতে আসেন হাজারো অভিবাসী। দেশের স্বাধ নিতে। যখন ওখানে আসেন সারাক্ষন দেশেই থাকেন। দোকানে গিয়ে দেশ হতে আসা টোস্ট বিস্কুটের দিকে অবাক হয়ে তাকান। আচারের বোয়ামে লেখা খুঁজেন একটি শব্দ। বাংলাদেশ। সাইফুল তো ওদেরই একজন। মেয়েদের কি করে বলেন এই শহরে কবিরা জড়ো হয়ে কবিতা পাঠ করেন। লাল সবুজের গান হয়। দেশের প্রিয় শিল্পীরা দর্শক শ্রোতাদের মন নাচিয়ে গেয়ে উঠেন।

প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলা দেশ
জীবন বাংলাদেশ আমার মরন বাংলাদেশ।

বাংলাদেশের এক তুখোড় কলম সৈনিক গর্ব করে বলেন। আমি শুধু নির্মল আড্ডা দিতে নিউইয়র্কে আসি। সেই ভাইটি এসে যদি কাউকে জিজ্ঞেস করে* সাইফুল ভাইকে দেখছি না! তিনি কি নিউইয়র্ক ছেড়ে গেলেন?

আগে ভাগে অবসরে চলে যেতে হলো। যাবার পূর্বে লটারী তে পেয়ে গেলেন সল্প ভাড়ার ম্যানহাটানের এই স্টুডিও এপার্টমেন্ট। শুধু জরুরী দুচার খানা আসবার পত্র দিয়ে সাজানো এপার্টমেন্ট একাই উঠে গেলেন।  ফিরে গেলেন যেনো সেই ফেলে আসা দিনে। প্রতিদিন আসেন বাঙালী পাড়াতে। আড্ডাতে মেতে খুঁজেন একলা জীবনের কিন্চিৎ অম্ল মধুর স্বাধ। কখনো মেলে কখনো নয়। তারপর ও ভাবেন আমিতো বাংলাদেশ হতে মাত্র আধঘন্টা দূরে। সপ্তাহের মাঝামাঝিতে হঠাৎ মনে পড়ল  সপ্তাহ শেষে যেতে হবে একটি প্রকাশনা অনুষ্টানে। সেখানেই দেখা হলো তিশার সাথে। ছোট ছোট আলাপে জানা গেলো। শুধু কবিতা প্রেমি নয় লিখেন ও ভালো। ব্যাগ হতে বের করে দিলেন নিজের লেখা কবিতার বই। শ্যামলা রঙের চেহেরাতে। সব কিছু হাসি মুখে মেনে নেবার অভিব্যক্তি। তেমন ভাব নিয়ে চলা তরুনী। পুরো অনুষ্ঠানেই টুক টুক কথা চললো। প্রানবন্ত মনে হলো বেশ। অনুষ্ঠান শেষে বাইরে বেরুতে যেয়ে দেখা গেলো আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নেমেছে। যারা গাড়ী করে এসেছিলেন বৃষ্টি মাথায় নিয়েই বাড়ী চলে গেলেন। সাইফুল সহ আরো কয়জন বৃষ্টি থামার অপেক্ষায়।

তিশা কবিতার বইটি হাতে নিয়ে প্রথম পাতায় লেখে দিলো। *হঠাৎ করে ভালো লাগলো বলেই নিজের কয়টি ভালো লাগার কবিতা উপহার। সাথে ফোন নাম্বার টি নিলেন। নাম্বার টি অচেনা মনে হলো। মানে বাহিরের রাজ্যের বোধকরি। ভালো লাগলো হঠাৎ করে! কাকে? কখন? কি ভাবে? আর এতো জলদি?  সব কয়টি প্রশ্ন মনে জড়ো হলো কিন্তু উত্তর আর এলো না। কথা বলার এক পর্য়ায়ে তিশা একটি কবিতার লাইন বললো।

আমি দাড়িয়ে থাকতে চাই নি:শব্দে
তোমাকে আন্দোলিত করতে।

সাইফুল তাকাতে তিশা বললো পরে লাইন টি বলুন!
দাঁড়ানো দেখতে চাই না,হাই হীলে খট খট
আওয়াজ তোলে তোমাকে চলে যেতে দেখতে ভালোবাসব।

সাইফুল পুরো বিষয় টি উপভোগ করলেন বটে। কিন্ত মনের কোনে অনেক প্রশ্নের উদয় হলো।  বৃষ্টি থেমে এলে দুজন দুদিকে। সাইফুল সাবওয়েতে। তিশা টেক্সি ডেকে ঘরমুখি।

কয়দিন পর সকালে বেরুতে চাইলো সাইফুল। রাস্তার অপর পার্শে ডেলিতে যাবে। ওভার কোট পড়ে ডানদিকের পকেটে হাত দিতেই হাতে লাগলো সাধারন মানে একটি ভিজিটিং কার্ড। অপর পৃষ্টায় গোটা অক্ষরে পরিস্কার করে লেখা তিশার ফোন নাম্বার। ভাবলো ফোন করে জেনে নেবে ভালো লাগার উপহার তার ভাগ্যে জোটে যাবার রহস্য। এমন মন ছুঁযে যাবার কাব্যিক কেমেস্ট্রী কেন তৈরী হলো। সাইফুল সেই রহস্য জানতে চায়। প্রথমে ১ দিয়ে শুরু করে ডায়াল করলো সাইফুল।
তিশাই ফোন ধরলো। সাইফুল হ্যালো বলতেই উত্তর দিলো তিশা।

–ভাই কেমন আছেন? শেষমেশ মনে পড়লো আমাকে।
-চলছে একরকম! আর আমাদের আর ভালো থাকা। ভালো মন্দ মিলিয়েই তো আছি। বাই দি ওয়ে! তিশা আমার কিছু প্রশ্ন ছিলো। কেমন লেগেছে নিউইয়র্কের সেই বর্ষন মুখুর সন্ধা ? আমি কিন্তু দারুন উপভোগ করেছি।বলতে পারো আগাগোড়া পুরো সময় টি ছিলো দারুন এক সুখকর মূহুর্ত। তরুনী কবি সাথে আনকোড়া অসমাপ্ত কবিতা। বলতে পারো আমার জন্য নতুন এক অভিজ্ঞতা।

সব শুনে তিশা হু হু করে হেসে উঠে।

— সাইফুল ভাই আমার সেই অসমাপ্ত কবিতা। সাথে কবির এই নিবিড়তার প্রশংসা আমার প্রয়াত স্বামী কবির ও করতো। আজ চার বছর হলো কবির না ফেরার দেশে। আমাদের একমাত্র মেয়েকে দেখতেই আমাকে প্রায়শ: নিউইয়র্কে যেতে হয়। শুধু আপনি নন আমার বর্তমান আমেরিকান স্বামী যে ছিলো আমার সহকর্মী। সে ও আজকাল কবিতার বুনো আবেদন যেমন বুঝতে শিখেছে।  তেমনি কবিদের সকল ব্যাকরণের চুড়ান্ত অনুবাদ। সাইফুল ভাই, আপনি ও কিন্তু একজন উচু মাপের কবিতা প্রেমিক। তাই বলেই কিনা কবিতার পরের লাইন টি তাৎক্ষণিক বলে দিলেন।  তবে শেষ পর্যন্ত কিন্তু একটি রহস্য আপনি নিজেই নিজের কাছে রেখে দিলেন। কবিতার বাকী অংশ নিয়ে আপনি আর এগুলেন না। সাথে আমিও।

তিশার সে কি উদ্দাম হাসি। যা শুনে সাইফুলের যোগ বিয়োগের হিসাবে ভুল ফল আসতে লাগলো। আর মনে হলো সে হাসি কখনো থামবার নয়।

ইশতিয়াক রুপু–

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn