বন্ধ হয়ে গেছে সিলেটের ছয়টি সিনেমা হল
মানসম্পন্ন সিনেমা ও দর্শকদের চাহিদামতো সিনেমার অভাবসহ উন্নত তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারে একে একে বন্ধ হয়েছে সিলেটের সিনেমা ব্যবসা। সিনেমা হলে বিভিন্ন সমস্যা থাকায় এখন হলবিমুখ হয়ে পড়েছেন দর্শকরা। এর ফলে ধস নেমেছে সিনেমা হল ব্যবসায়। সিলেটের ৯টি সিনেমা হলের মধ্যে এখন টিকে আছে মাত্র ৩টি। প্রায় এক যুগ আগেও দর্শকদের পদচারণায় মুখর ছিল নন্দিতা, দিলশাদ, অবকাশ, লালকুঠি, রঙমহল, মণিকা ও কাকলী। এছাড়াও আখালিয়ায় বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (বিজিবি) মিলনায়তন এবং জালালাবাদ সেনানিবাসে ‘সৈনিক’ নামে দুটি সিনেমা হল রয়েছে। বিজিবি ও সৈনিক অডিটোরিয়াম সিনেমা হল বাদ দিলে নগরীতে এখন চালু আছে শুধু ‘নন্দিতা’।
দর্শকের অভাবে ছয়টি সিনেমা হল বন্ধ হয়ে গেছে। ‘নন্দিতা’ কোনো রকম টিকে থাকলেও দর্শকের অভাব। নন্দিতা, বিজিবি ও জালালাবাদ সৈনিক অডিটোরিয়ামের ভেতরের অবস্থা খুবই করুণ। তাই মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের দর্শকরা এসব হলে সিনেমা দেখতে যান না। বন্ধ হওয়া ছয়টির মধ্যে ‘অবকাশ ও রংমহল’ সিনেমা হল দুটি ভেঙে ফেলা হয়েছে অনেক আগেই। সেখানে নির্মাণ করা হয়েছে বহুতল ভবন ও মার্কেট। বন্ধ হওয়া অপর চারটির একটি ‘দিলশাদ’ সিনেমা হলে ঝুলছে ‘বিক্রয় হবে’ বিজ্ঞপ্তি। এছাড়াও বন্ধ রয়েছে লালকুঠি, মণিকা ও কাকলী সিনেমা হল।
ব্রিটিশ আমলেই সিলেটে সিনেমা ব্যবসা চালু হয়। সিলেটে বঙ্গ বিহারী দাশ নামের এক বণিক প্রথম রংমহল ও পরে লালকুঠি সিনেমা হল দিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। সিলেট টকিস নামে তা পরিচিত ছিল। এরপর ধীরে ধীরে অপর সিনেমা হলগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু কালের পরিবর্তনে সিনেমা হল বন্ধ হওয়ার কারণ হিসেবে দেশে স্যাটেলাইট চ্যানেলের বিপ্লব ঘটে যাওয়াকেও দায়ী করেছেন অনেকে। ঘরে বসেই এখন দর্শকরা দেশি-বিদেশি চ্যানেলগুলোতে বাঙলাসহ বিভিন্ন রকমের সিনেমা দেখতে পারছেন।
সিলেট নগরের প্রাণকেন্দ্র বন্দরবাজার এলাকায় ছিল লালকুঠি ও রংমহল নামে দুটি সিনেমা হল। রংমহল ভেঙে সেখানে করা হয়েছে রংমহল টাওয়ার। রংমহল নাম থাকলেও আর সিনেমা হল নেই। আর লালকুঠি ভবন আছে, নেই সিনেমা হল। তালা দেয়া অবস্থায় রয়েছে হলের প্রধান গেইট। গেটের সামনে পানের দোকানের একজন ব্যবসায়ী জাকির হোসেন বলেন, এই সিনেমা হলের মালিক বিজিত লাল দাস। বছর চারেক আগে হলটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তালতলা এলাকায়ই পাশাপাশি ছিল তিনটি সিনেমা হল। কয়েক বছর আগেও সেখানে ভালো ব্যবসা হয়েছে। দর্শক সমাগমও ছিল অনেক। এখন শুধু নন্দিতা সিনেমা হলই টিকে আছে। এই হলের অবস্থাও ভালো নয়; দেখে মনে হয় গুদামঘরের মতো।
নন্দিতা সিনেমা হলের প্রতিষ্ঠা থেকে ম্যানেজারের দায়িত্বে থাকা মোস্তফা চৌধুরী জানান, ব্যবসায়ী বাদশা মিয়া লস্কর ১৯৮৬ সালে এই হলের যাত্রা শুরু করেন। বর্তমানে ঢাকার এক মালিক সিনেমা হলটি লিজে নিয়ে ব্যবসা করছেন। তবে হলটি বন্ধ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এখনো কিছু দর্শক আছেন, যাদের হলে এসে সিনেমা না দেখলে মন ভরে না। হলপ্রিয় দর্শকদের কথা চিন্তা করে হলকে আরো সুসজ্জিত করা হবে।
কথা হয় নন্দিতা সিনেমা হলে ছবি দেখতে আসা আশিক উদ্দিনের সাথে। তিনি বলেন, আগের মতো এখন আর ছবি দেখতে আসেন না। একটা সময় ছিল ভালোমানের ছবি ছিল আর প্রতিদিনই হলে আসা হতো তাঁর। এখনকার অনেক ছবি হিন্দি ও ইংরেজি ছবির ‘হুবহু অনুকরণ’ বা কাটপিস ঢোকানো হয়। যে-কারণে ছবি দেখার মন-মানসিকতা থাকে না।
তিনি বলেন, কয়েক বছর আগে শহরে পাশাপাশি বেশ কয়েকটি সিনেমা হল ছিল। হলগুলোতে ছিল ভালো মানের ছবি পরিবেশনের একটা প্রতিযোগিতাও। কিন্তু এখন একটি মাত্র হলেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। অনেক দর্শক আছেন, যারা ডিশলাইন বা ইন্টারনেট ব্যবহারে এখনো অভ্যস্ত নন। তাই আরামদায়ক কক্ষ, উন্নতমানের বসার ব্যবস্থা ও উন্নত সাউন্ড সিস্টেম না থাকলেও সেই সকল দর্শক হলে এসে ছবি দেখার সুযোগ পান।
নন্দিতার পাশেই ছিল আরেকটি সিনেমা হল ‘অবকাশ’। এটিকে ভেঙে স্থাপন করা হয়েছে জননী মার্কেট। ‘দিলশাদে’র দেয়ালে চারজনের নামোল্লেখ করে ঝুলছে মালিকানা সাইনবোর্ডসহ ‘বিক্রয় হবে’ বিজ্ঞপ্তি। ১৯৫২ সালে ৬৮ ডেসিমেল ৫৬ পয়েন্ট জায়গাজুড়ে প্রতিষ্ঠিত হয় এই হল। সিনেমা হলের মালিক মামুনুর রশীদ চৌধুরী মারা যাওয়ার পর কয়েক বছর আগে হলটি বন্ধ হয়ে যায় বলে জানান জায়গার মালিক পক্ষের প্রতিনিধি মীর মখলুদ আহমদ। এ অবস্থায় সিলেটে সিনেমা ব্যবসাকে আরো রাঙিয়ে তুলতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। মানসম্পন্ন চলচ্চিত্র ও ছবি নির্মাণের মাধ্যমে হলের সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি করা গেলে আবারো সিনেমা হলগুলো দর্শকদের পদচারণায় মুখরিত হবে বলে মনে করেন দর্শকসহ সংশ্লিষ্টরা।