পাত্র বিশেষে ধর্ষণ ও অপরাধ
দেশের স্বনামধন্য জুয়েলারি প্রতিষ্ঠান আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদ সেলিমের পুত্র ধর্ষণ মামলায় এখন রিমান্ডে রয়েছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া দুই ছাত্রীর অভিযোগের প্রেক্ষিতে দেশজুড়ে প্রতিবাদের ঝড়ই উঠেনি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী রীতিমতো চিরুনি অভিযান চালিয়ে তাদের দ্রুত গ্রেফতার করে। এদিকে, নারীরা আপন জুয়েলার্স বয়কটের ঘোষণা দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তুফান তুলেন। কয়েকদিন আগেই গাজীপুরে গরিবের শিশুকন্যা আয়েশা এক বখাটের কাছে ধর্ষিতা হলে তার পিতা হযরত আলী দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে বিচার না পেয়ে ট্রেনের নিচে সন্তানসহ আত্মহুতি দিয়েছেন। মেয়েটি বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া নয়, ওর পিতা নেহায়েত গরিব তাই নারীবাদীসহ গণমাধ্যম থেকে বিবেকবান মহলের প্রতিবাদের ভাষা জোরালো, সুসংগঠিত হয়ে উঠেনি। সেই লম্পট দু’টি জীবনের আত্মহুতির পরও আটক হয়নি।
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাদ্রাসা, মক্তবে, কলেজ, স্কুলে ছাত্রীরা ধর্ষিতা হয়। কর্মক্ষেত্রে পোশাক কারখানা থেকে গৃহকর্মীরা পর্যন্ত ধর্ষিতা হয়। পুলিশের আশ্রয় নেবার সাহস হয় না অনেকের। বিচার চেয়ে অনেকে পথে পথে ঘুরে। তবুও বোধহীন সমাজ কিংবা নারীবাদীগণ অথবা সমাজসেবী ও রাজনৈতিক গোষ্ঠী প্রতিবাদের ঝড় তুলে না। ভিকারুননেসার ছাত্রী ধর্ষণ মামলায় কেবল পরিমলেরই বিচার হয়েছে, দণ্ডিত হয়ে জেল থাকছেন। অথচ প্রতিটি ধর্ষকের, প্রতিটি নারী নির্যাতনকারীর, প্রতিটি আইন লঙ্ঘনকারীর, প্রতিটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে যেমন প্রতিবাদের ঝড় উঠা উচিত তেমনি তাদের বিচারপ্রাপ্তি মৌলিক অধিকার, সাংবিধানিক অধিকার।
রাষ্ট্র, সমাজ কেউ নাগরিকের ইজ্জত ও জীবনের গ্যারান্টি দিতে পারছে না। আপন জুয়েলার্স যেহেতু বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্ত যেহেতু বিত্তশালীর বখাটে, বখে যাওয়া, বেপোরোয়া সন্তান; অন্যদিকে মালিকের দম্ভোক্তি নীতিবোধহীন অতিকথন সমাজের সবার গায়ে ফোসকা ফেলেছে, তখন প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। গণমাধ্যম যেহেতু এই ইস্যুকে বড় করে সামনে এনেছে; তাই নারীবাদী ও সমাজপতিগণ প্রতিবাদী হয়েছেন। বিবেকের তাড়নায়, মানবিক দায়বদ্ধতা থেকে কে কতটা প্রতিবাদী হয়েছেন তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। তবুও মন্দের ভালো ঘুমন্ত সমাজ প্রতিবাদের ঝড় তুলেছে। তবুও মন্দের ভালো, একজন দিনমজুর সন্তান নিয়ে আত্মহুতি দেয়ার পরও গণমাধ্যম বিষয়টিকে সিরিয়াসলি না নিলেও হোটেল রেইন ট্রির মতো তারকা হোটেলকে বালাখানা বানিয়ে একদল লম্পট টাকার গরমে দুই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রী ধর্ষণ করায় বিষয়টিকে বড় করে সামনে এনেছে এবং প্রতিবাদের ঝড় তোলায় আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর টনক নড়েছে। বড় লোকের সন্তানরা ধর্ষণের অভিযোগে গ্রেফতারই হননি, তাদের বেপোরোয়া জীবনের চিত্রপটের মধ্য দিয়ে ঢাকা নগরীর অভিজাত পাড়ায় পাড়ায় মূল্যবোধহীন ক্ষয়ে যাওয়া সমাজের অন্দরমহলে কি ঘটছে তার চিত্র উঠে এসেছে।
এই ঘটনার পর গণমাধ্যমে একের পর এক দেশের বিভিন্ন জায়গায় ধর্ষণের খবর উঠে আসছে। হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ে গোধুলী লগ্নে বাড়ির উঠোনে খেলাধুলায় মগ্ন একটি শিশুকে স্কুলের প্রধান শিক্ষক অঞ্জন দেব যেভাবে নিজগৃহে ডেকে নিয়ে ধর্ষণ করেছেন তার লোমহর্ষক বর্ণনাও উঠে এসেছে। সকল ধর্ষকের বিরুদ্ধে সমাজ প্রতিবাদী হোক। সকল ধর্ষককে পাকড়াও করে আইনের হাতে সোপার্দ করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সফল হোক।
আপন জুয়েলার্সের প্রতিটি শো-রুমে শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগ তল্লাশি চালিয়ে সিলগালা করছে। ১৮০ কোটি টাকার স্বর্ণ আটক করে বলছে, বিনাশুল্কে আমদানি হয়েছে। সরকারের রাজস্ব চুরি হয়েছে। এতদিন আপন জুয়েলার্সের এই অবৈধ সোনা-হীরার খবর শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগ খবর রাখেনি। মালিক-পুত্র ধর্ষণের মামলায় গ্রেফতার না হলে তারাও নাক ডেকে ঘুমাতেন। তার মানে তারা জানতেন না, এ ধরনের ঘটনা ঘটে যাচ্ছে; এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যেখানে দুর্নীতির আগ্রাসন সেখানে তারাও এর বাইরে ছিলেন না। শুধু তাই নয়, গোয়েন্দা অভিযানের ও স্বর্ণ-হীরা আটকের পূর্ব পর্যন্ত স্বর্ণ ও হীরক ব্যবসায়ীরা নিরবেই ছিলেন। ভাবখানা এরকম ছিল, আপন জুয়েলার্সের ব্যবসার পতন ঘটলে ডায়মণ্ড ওয়ার্ল্ডসহ নামকরা জুয়েলারি প্রতিষ্ঠান একচেটিয়া রাজত্ব করে দু’হাতে মুনাফা লুটবেন। কিন্তু শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগের অভিযানে আপন জুয়েলার্সের শোরুমে খাতা পত্রে হিসাবের মিল না থাকা অবৈধ অনেক সোনা হীরার সন্ধান মিললে বাকিদেরও ভয় তাড়া করে। তারা এখন সম্মিলিতভাবে বৈঠক করে বিবৃতি দিচ্ছেন-গোয়েন্দা অভিযান ও সোনা-হীরা আটকানোর বিরুদ্ধে।
আমাদের কথা একটাই, সকল ধর্ষকের গ্রেফতার ও বিচার হোক। আমাদের কথা একটাই, আবাসিক এলাকায় গড়ে ওঠা যেসব হোটেল আইন লঙ্ঘন করে অন্ধকার জগতকে প্রশ্রয় দিয়ে রাত নামলেই রঙ মহল বানিয়ে তুলছেন, তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়া হোক। আমাদের কথা একটাই শুধু আপন জুয়েলার্স নয়; সবার সোনা-হীরা তল্লাশি চালিয়ে আটক করা হোক যদি বেআইনিভাবে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে এনে থাকেন। আটক করা হোক সবার সোনা, আটক করা হোক সবার হীরা। যদি জাল জালিয়াতি করে তা বিক্রি করে ক্রেতাদের ঠকানো হয়। আসল সোনা-হীরার বিপরীতে নকল সোনা-হীরা বিক্রি হয়। বিনাশুল্কে তা আনা হয়। আইন, বিধি, বিধানের ঊর্ধ্বে কেউ নন। আমরা চাই সবার সোনা-হীরায় তল্লাশি চালানো হোক।