হাওর : উর্বর পলিমাটির এক বিপন্ন স্বপ্ন
লেখক : আলমগীর শাহরিয়ার-
হাওর বললেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে বিশাল, বিস্তীর্ণ জলরাশির এক সীমাহীন প্রান্তরের ছবি। বরষায় সেই জলরাশির বিচিত্র রূপ। কখনো নিপাট নীরব, নৈশব্দে ভরা সূর্যাস্তের সোনালী আভার রঙে ঢেউ খেলে যাওয়া, কখনো রুদ্র-রোষে জেগে উঠা আফালের (ঢেউয়ের) শুধু বিরামহীন হুঙ্কার। বর্ষার নতুন জলে হাওরে ভেসে আসা কচুরিপানার বিশাল মিছিল, বড় বড় মহাজনি নাও, ছোট ছোট নাইরি নৌকা, শম্বুক গতিতে স্রোতের টানে চলা বাঁশের চাইল, দুরন্ত কিশোরের কলাগাছের ভেলা, হাওরের আকাশে সাদা মেঘের উড়াউড়ি, জলের উপরে ভেসে থাকা বুনো ফুল, পানিফল, রঙিন শাপলা, বরষা শেষে ফসল বোনার পর মাইলের পর মাইল দিগন্ত বিস্তৃত সবুজের সমারোহ, সোনালি ফসলের হাতছানি – সে এক ঐশ্বরিক নান্দনিক নৈসর্গিক দৃশ্য – শৈশব কৈশোরের হাওরের এসব সোনালি স্মৃতি নাগরিক জীবনের কোনো এক ক্লান্ত দুপুরে আজো প্রবলভাবে উদ্বেলিত করে। হাওর অধ্যুষিত এক জেলায় জন্মেছিলাম। তাই হাওরের সাথে জন্মাবধি পরিচয় ও সুনিবিড় সখ্য । বিস্তৃত জলরাশির বুক চিরে নিয়ত ধাবমান কোন জলযান আমাকে কবে কোন দ্বি-প্রহরে সভ্যতার অনুঘটক মঞ্চে পৌঁছে দিয়েছিল সে স্মৃতি আজ বিস্মৃতপ্রায়।
তবে হাওর পাড়ে প্রোথিত নিজের শিকড়ের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা স্মৃতি ও সমৃদ্ধ সংস্কৃতির মহাকাব্য মনের গহীনে আজো খুব যতনে লালন করে চলি । তাই হাওর নিয়ে কাটখোট্টা নৈর্ব্যক্তিক লেখা অসম্ভবপ্রায়। হাওরের জল-জোছনা, মানুষ, পরিবেশ, প্রতিবেশের প্রতি নিরঙ্কুশ পক্ষপাত দুষ্ট হওয়াই স্বাভাবিক। বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে আজ বাংলাদেশের নাম আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জোরেশোরে উচ্চারিত ঠিক সে মুহূর্তে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অফুরন্ত সম্ভাবনা ও অগণিত সমস্যার আবর্তে নিপতিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি হাওর নিয়ে বিস্তৃত পরিসরে আলোচনা খুবই সময়োপযোগী ও প্রাসঙ্গিক।
হাওর নিয়ে তথ্য উপাত্ত ও গবেষণা খুবই অপ্রতুল, নেই বললেই চলে। এ যাবত সর্বজন স্বীকৃত হাওরের কোন সংজ্ঞাও নেই। উইকিপিডিয়ায় বলা আছে- হাওর বা হাওড় হল সাগরসদৃশ পানির বিস্তৃত প্রান্তর। হাওরের সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো, প্রতি বছরই মৌসুমি বর্ষায় বা স্বাভাবিক বন্যায় হাওর প্লাবিত হয়। বছরের কয়েক মাস পানিতে নিমজ্জিত থাকে এবং বর্ষা শেষে হাওরের গভীরে পানিতে নিমজ্জিত বিল জেগে উঠে। হাওর অনেকটা গামলা আকারের জলাভূমি। বছরের সাত মাস হাওরগুলো পানির নিচে অবস্থান করে এবং শুষ্ক মৌসুমে হাওরের পুরো প্রান্তর জুড়ে ঘাস গজায় এবং গবাদি পশুর বিচরণকেন্দ্র হয়ে ওঠে। বর্ষাকালে সাগরসদৃশ হাওরগুলোর মধ্যে অবস্থিত গ্রামগুলোকে দ্বীপ বলে প্রতীয়মান হয়।
এ প্রসঙ্গে প্রাসঙ্গিক এক ব্রিটিশ কালেক্টরের স্মৃতি রোমন্থন করা যেতে পারে। রবার্ট লিন্ডসে ১৭৭৮ সালে সিলেটের কালেক্টর নিযুক্ত হন। লিন্ডসে তাঁর আত্মজীবনীতে বলেছেন, “ঢাকা থেকে নৌকায় যাত্রা করে প্রথমে কুঁড়ি মাইল দূরে ফিরিঙ্গি বাজারে পৌঁছি। এখান থেকে মেঘনা নদী উজিয়ে সিলেটের দিকে যাই। পথে অযত্মবর্ধিত সবুজ ধানক্ষেতের মাঝ দিয়ে আমাদের নৌকা অগ্রসর হয়। ধানগুলি নুয়ে নুয়ে নৌকার পথ করে দিচ্ছিল; নৌকা এগিয়ে গেলে তারা পুনরায় মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল। এ দৃশ্য বড়ই মনোহর। এর পরেই আমরা প্রায় একশো মাইল জলাভূমিতে পড়ি। আপনারা হয়তো বিশ্বাস করবেন না যে, এই হাওরের দিক নির্ণয়ের জন্য আমাদের সামুদ্রিক কম্পাস ব্যবহার করতে হয়েছিল। ঢাকা থেকে ক্রমাগত সাতদিন চলার পর সিলেট থেকে ত্রিশ মাইল দূরে ছাতকে আমলারা সুসজ্জিত তরীসহ অভ্যর্থনা জানায়।”
‘হযরত শাহজালাল ও সিলেটের ইতিহাস’ গ্রন্থে লিন্ডসের স্মৃতিচারণে যে সাগরসদৃশ হাওরের বর্ণনা দিয়েছেন তার অবস্থান কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা ও সুনামগঞ্জে।
IUCN-এর তথ্য মতে, বাংলাদেশে প্রায় ৪০০ হাওর রয়েছে। ভূ-তাত্ত্বিক অবস্থান বা এলাকার বৈশিষ্ট্যভেদে হাওরকে ৩ ভাগে ভাগ করা হয়-
১. পাহাড়ের পাদদেশে বা পাহাড়ের কাছাকাছি অবস্থিত হাওর।
২. প্লাবিত এলাকায় হাওর।
৩. গভীর পানি এলাকায় হাওর।
বাংলাদেশে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ময়মনসিংহের গারো-খাসিয়া পাহাড়ের পাদদেশ থেকে শুরু করে নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও সুনামগঞ্জ অর্থাৎ কুশিয়ারা-সুরমা অববাহিকার যে বিশাল নিম্নভূমি সেটাই হাওর অঞ্চল।
বৃহত্তর সিলেট বিভাগের প্রধান হাওরগুলোর অবস্থান সুনামগঞ্জ জেলায়। সুনামগঞ্জকে তাই হাওরের রাজধানী বলা হয়। তারপরেই মৌলভীবাজার ও সিলেট জেলার একাংশ জুড়ে রয়েছে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় হাওর খ্যাত হাকালুকি হাওর। এছাড়া হবিগঞ্জেও অসংখ্য হাওর ও জলাশয় রয়েছে । হাওর নিয়ে আরো কিছু প্রাসঙ্গিক তথ্য জানা যেতে পারে নিচের কয়েকটি হাওর নিয়ে আলোচনা থেকে ।
হাওর রাজ্য সুনামগঞ্জ
বলা হয়ে থাকে-‘মৎস্য-পাথর-ধান, সুনামগঞ্জের প্রাণ।’ বাংলাদেশের সপ্তম বৃহত্তম জেলা সুনামগঞ্জ দেশের উত্তর-পূর্ব সীমান্তে খাসিয়া জৈন্তা পাহাড়ের কোলঘেঁষে অবস্থিত। হাওর বিধৌত ৩,৬৭০বর্গ কি.মি. আয়তনের এ জেলায় ছোট, বড়, মাঝারি মিলিয়ে মোট ৩৭টি হাওর আছে। তার মধ্যে জাতিসংঘের ইউনেস্কো ঘোষিত ১০৩১এম ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ’ ‘টাঙ্গুয়ার হাওর’ এর অবস্থানও এখানে।
• টাঙ্গুয়ার হাওর
তাহিরপুর, ধর্মপাশা উপজেলার উত্তর পশ্চিম সীমান্তে বিস্তৃত ৫১টি বিলের সমন্বয়ে টাঙ্গুয়ার হাওর। বৈচিত্রময় জলজ উদ্ভিদ, প্রকৃতি, ধান, মাছ ও অতিথি পাখির অভয়াশ্রম হিসেবে বিখ্যাত এ হাওর। সারি সারি হিজল-করচ শোভিত, পাখিদের কলকাকলিতে মুখরিত এ হাওরের দৃশ্য সত্যিই নৈসর্গিক।
টাঙ্গুয়ার হাওরের মোট আয়তন হেমন্তকালে ৬,৯১২ একর। তবে নলখাগড়া, হিজল, করচ-বনসহ বর্ষাকালে সমগ্র হাওরটির আয়তন দাড়ায় প্রায় ২০,০০০ একরের মতো। হাওরটি দৈর্ঘ্যে ১১ এবং প্রস্থে ৭ কি.মি. বিস্তৃত। এই হাওরের ৫১টি ছোট বড় বিলের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিল হচ্ছে, রূপবাই, শ্যামসাগর, আলংজোয়ার, এরাইল্লকোণা, গজারিয়া, রৌয়া, আইন্না, হাতিয়াগাতি প্রভৃতি। টাঙ্গুয়ার প্রাণ প্রবাহ হিসেবে খ্যাত নদীগুলো হলো-সুরমা, সুমেশ্বরী, পাটলাই, রক্তি, কংশ এবং ধন।
টাঙ্গুয়ার জীব বৈচিত্র্য
হাওরের অবারিত জলে ভেসে থাকা হিজল করবের দৃষ্টি নন্দন সারি এবং বিপুল পরিমাণে অতিথি পাখির মুখরিত সমাগম ও হাওরের সৌন্দর্যকে করেছে মোহনীয়। নল খাগড়া, দুধিলতা, নীল শাপলা, শোলা, হেলেঞ্চা, শতমূলি, শীতল পাঠি, স্বর্ণলতা, বনতুলসী ইত্যাদিসহ দুশো প্রজাতিরও বেশি উদ্ভিদ ও গাছ-গাছালী রয়েছে এ প্রতিবেশ অঞ্চলে। এ হাওরে ১৪১ প্রজাতির মাছ এছাড়াও ২০৮ প্রজাতির পাখি, ১১ প্রজাতির উভচর প্রাণী, ৩৪ প্রজাতির সরীসৃপ, ৭ প্রজাতির গিরগিটি, ২১ প্রজাতির সাপ রয়েছে।
২০৮ প্রজাতির উদ্ভিদের মধ্যে অনেক দুর্লভ উদ্ভিদও আছে। ২০০৪ সালে সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসন পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, টাঙ্গুয়ার হাওরে ৩০ লক্ষ পাখির সমাগম হয়েছে। বিলুপ্ত প্রায় প্যালাসেস ঈগল, বৃহদায়কায় গ্রে-কিস্টর্ক, শকুন ইত্যাদি প্রজাতির পাখির সরব উপস্থিতি ছিল। স্থানীয় জাতের পানকৌড়ি, কালেম, বৈদর, ডাহুক, নানাপ্রকার বালিহাঁস, গাংচিল, বক, সারস প্রভৃতি পাখির উপস্থিতি এখনো আছে।
• দেখার হাওর
সুনামগঞ্জ জেলার দ্বিতীয় বৃহত্তম হাওর হচ্ছে দেখার হাওর। বোরো ফসল উৎপাদনে এ হাওরের অবস্থান সবার উপরে। ছাতক-দেয়ারা, জগন্নাথপুর, সুনামগঞ্জ সদর পর্যন্ত বিস্তৃতি এ হাওরের। এ হাওরে ধান চাষ ৮,৯১০ হেক্টর জমিতে, স্বাধীনতার পূর্বে পানি সংরক্ষণের জন্য দোয়ারা উপজেলা থেকে দক্ষিণ সুনামগঞ্জের পাগলা পর্যন্ত বাঁধ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে সে বাঁধের কোনো সংস্কার কাজ আজ পর্যন্ত হয়নি। যার ফলে বহু পুরনো সে বাঁধটি বিলীনপ্রায়। উল্লেখ্য, এ হাওরের উত্তরে বহুল আলোচিত টেংরাটিলা গ্যাস ফিল্ডের অবস্থান। মাছ ও বোরো ধানের জন্য বিখ্যাত এ হাওর।
• হাকালুকি: বাংলাদেশের বৃহত্তম হাওর
সিলেট ও মৌলভীবাজার জেলা জুড়ে বিস্তৃত বাংলাদেশের বৃহত্তম হাওর হাকালুকি। এর আয়তন ১৮,১১৫ হেক্টর, তন্মধ্যে শুধুমাত্র বিলের আয়তন ৪,৪০০ হেক্টর। মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা (৪০%), কুলাউড়া (৩৩%), সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ (১৫%), গোলাপগঞ্জ (১০%) এবং বিয়ানীবাজার (৫%) জুড়ে এর বিস্তার।
এই হাওরে ৮০-৯০টি ছোট বড় মাঝারি বিল রয়েছে। হাকালুকি হাওরে ‘Swamp Forest’ ছিল। এখন আর নেই।
• হাইল হাওর
প্রবাসী অধ্যুষিত বৈচিত্রময় সৌন্দর্যের অপরূপ ভূমি মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে হাইল হাওর অবস্থিত। হাইল হাওরে প্রচুর পরিমাণে জলজ উদ্ভিদ, লতা গুল্মের উপস্থিতি রয়েছে। এ হাওরের অন্যতম আকর্ষণ ‘বাইক্কা বিল’। ‘বাইক্কা বিল’-কে সরকার ইতোমধ্যে অভয়াশ্রম ঘোষণা করেছে। হাওরে উল্লেখযোগ্য যেসব পাখি রয়েছে তন্মধ্যে মেঠে রাজহাঁস, গিরিয়াহাঁস, ল্যাঞ্ছা হাঁস, মরচে রং, ভূমিহাঁস, পাতি সরালি ও রাজসরালি প্রধান। দেশীয় পাখিদের মধ্যে পানকৌড়ি, নেউপিপি, বেগুনি কালেম, বালিহাঁস, কুড়া ও শঙ্খচিল। এ হাওরে পরিযায়ি পাখিদের আগমন শুরু হয় নভেম্বর থেকে।
হাওরের উর্বর শিল্প ও সংস্কৃতি
বাঙালির হাজার বছরের নিজস্ব যে শিল্প সংস্কৃতি তার এক বিশাল অংশজুড়ে রয়েছে হাওর পাড়ের মানুষের সুখ-দুঃখের গল্প,আনন্দ-বেদনা ও উৎসবের গল্প। বাউল, ভাটিয়ালি, জারি, সারির মূল উৎপত্তিস্থল এ হাওরাঞ্চল। হাওরের উর্বর মাটির বুকে জন্ম নিয়েছেন মরমি গায়ক হাছন রাজা, দার্শনিক দেওয়ান আজবফ, বাউল সম্রাট আব্দুল করিম, রাধারমণ, দুর্বিন শাহ, শেখ ভানু, শীতালং শাহ, পণ্ডিত রাম কানাই দাশ, সাহিত্যিক শাহেদ আলী, উকিল মুন্সির মতো যুগস্রষ্টা শিল্প, সাহিত্যিক, মনিষীগণ।
শাহ আব্দুল করিম তার ‘ভাটির চিঠি’ নামক গ্রন্থে ঐ জনপদের মানুষের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সহজ সরল বর্ণনা দিচ্ছেন এভাবে-
‘বর্ষাকালে ভাসান জলে মাছ ধরে খাইত।
মনের আনন্দে মানুষ গান গীত গাইত ॥
হিন্দু মুসলমান মিলে গ্রামে করি বাস।
গান বাজনার প্রচলন ছিল বারমাস ॥
নৌকা বাইচ হইত যখন বিভিন্ন স্থানে।
জনমনে আনন্দ তখন দিত সারিগানে ॥’
অকাল বন্যা ও হাওরের মানুষের বিপন্ন জীবন
বিগত কয়েক বছরে ধরে জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তন, পানি উন্নয়ন বোর্ড এর কর্মকর্তাদের লাগামহীন অনিয়ম দুর্নীতি, জনপ্রতিনিধিদের দায়বদ্ধতা ও উদাসীনতা, এবং অবহেলার পরিণতিতে নীরব দুর্ভিক্ষে নিপতিত হচ্ছে অভাগা কৃষকরা। এভাবে সহায় সম্বলহীন হয়ে পড়ছে কৃষক ।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে লাগাতার পাহাড়ি ঢল, ভারী বৃষ্টিপাতে বাঁধ ভেঙে হাওর তলিয়ে গিয়ে ফসলহানীর পরিমাণ বেড়েছে কয়েকগুণ। বিগত দশ বছরের মধ্যে পরপর তিনটি বড় এবং দুটি মাঝারি (২০০৪ ও ২০০৬) বন্যা ও ক্ষয়ক্ষতির পরও ঘুম ভাঙেনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। ২০১১ সাল থেকে ২০১৬ আংশিকভাবে এ ধারা অব্যাহত থাকে। অন্যান্য বছর আংশিক তুলতে পারলেও এ বছর অর্থাৎ ২০১৭ সালে স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসে হাওরের বুকে । সব কটি হাওর চৈত্র মাসের প্রথমার্ধেই তলিয়ে যায় । কোন কৃষকই ঘরে ফসল তুলতে পারেন নি ।
হাওরের মঙ্গা
মঙ্গা বললেই আমাদের চোখে ভেসে উঠে উত্তরবঙ্গের কথা। কিন্তু হাওরাঞ্চলের মঙ্গা পরিস্থিতিও কোনো অংশে উত্তরবঙ্গ থেকে কম নয়। ‘Campaign for Sustainable Rural Livelihoods/CSRL নামে একটি বেসরকারি সংগঠন তাদের যৌথ গবেষণায় জানাচ্ছে, হাওরাঞ্চলে প্রতি বছরের কার্তিক ও চৈত্রমাসে যে ভয়াবহ মঙ্গা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, তা অনেকাংশেই অজানা। তখন ক্ষেতের ফসল ফুরিয়ে আসে এবং বিকল্প কোনো কাজের সংস্থানও থাকে না সে সময় । ২০১৭ সালে এ পরিস্থিতি অন্য যে কোন বহরের চেয়ে ভয়াবহ হবে তাতে সন্দেহ নেই।
জলবায়ু পরিবর্তনে প্রভাব ও হাওরাঞ্চলের ভবিষ্যৎ
ক্রমাগত বিশ্ব উষ্ণায়নের মাত্রা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তন মানুষের বসবাসের পরিবেশ ও প্রতিবেশকে নিয়ত ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। ব্রিটিশ সমাজবিজ্ঞানী Anthony Giddens তাঁর ‘The Environmnt and Risk’নিয়ে আলোচনায় বলেছেন, আমাদের সময়ের পরিবেশগত সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ যদি সত্যি হয় তাহলে উষ্ণায়নের ফলে জলবায়ু পরিবর্তনে পরিবেশকে অর্থাৎ মানবগোষ্ঠীকে একের পর এক বিধ্বংসী ও ভয়ংকর পরিণতির সম্মুখীন করে তুলবে। আর এ বিধ্বংসী ফলাফল কোন নির্দিষ্ট এলাকা নয় বরং বিশ্বব্যাপী অনুমিত হবে। তিনি আরো বলেছেন, উষ্ণায়নের ফলে ক্ষতিকর প্রভাবগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো-
১. সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়া;
২. বিশাল পরিমাণ উর্বর ভূমি মরুভূমিতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা (যার মধ্যে হাওর পড়ে);
৩. মহামারি আকারে রোগ-বালাই বৃদ্ধি;
৪. ফসল উৎপাদন কমে যাওয়া। দক্ষিণ এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। উল্লেখ্য, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে সমতল ভূমি, জলাভূমি, হাওড়-বাওর ফসল উৎপাদনের প্রধান ক্ষেত্র;
৫. বন্যা, খরা ও দুর্যোগ বৃদ্ধি (অকাল বন্যা ও খরা হাওরের মানুষের জন্য বিশাল হুমকি হিসেবে দেখা দিবে);
৬. ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা বৃদ্ধি।
গিডেন্স মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগের এক রিপোর্টের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার মানুষজন ব্যাপকহারে নিরাপদ এলাকায় অভিবাসন ও স্থানান্তর হবে। যা নিরাপদ এলাকার মানুষের জন্যও দুশ্চিন্তার বিষয়।
এসব বড় আকারের পরিবর্তন ও ঝুঁকির হুমকি ছাড়াও বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কায় ইতোমধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে গেছে। যেমন-
বাংলাদেশে প্রাপ্ত ২৬০ প্রজাতির মাছের মধ্যে ১৩০ প্রজাতির মাছ পাওয়া যায় মিঠা পানি বা হাওর অঞ্চলে। কীটনাশক, রাসায়নিক সারের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার বৃদ্ধি, পানির স্বাভাবিক প্রবাহে অপরিকল্পিত উন্নয়নের নামে বাধার ফলে মাছসহ অসংখ্য জলজ
প্রাণীজ উদ্ভিদের অস্তিত্ব আজ বিপন্ন
বৃষ্টির পানি কমে যাওয়ার ফলে হাওরেও পানির পরিমাণ কমে গেছে।
মাছের স্বাভাবিক প্রজনন ব্যাহত। অন্যদিকে অতিবৃষ্টি হওয়ার ফলে হাওর পানিতে ভরে গেলেও তা স্থায়ী হয় না;
হাওরাঞ্চলের উদ্ভিদের সাথে বৃষ্টির সম্পর্ক নিবিড়, স্বাভাবিক বৃষ্টি ব্যাহত হলে হিজল, করচ, বরুণসহ অন্যান্য উদ্ভিদ বিলীন হয়ে যাবে;
হাওর অঞ্চলে এক সময় গভীর জঙ্গল (Swamp Forest) ছিল; সেখানে এখন ধু ধু করছে উদাস হাওর।
[চলবে…]