আমেরিকার হায় আর বাই এর মধ্যে জীবন
মনিজা রহমান –
প্রত্যাশা আর প্রত্যাশা ভঙ্গের সেই গল্পটা অনেক পুরনো। ছেলে কি করে? আমেরিকা থাকে। আ-মে-রি-কা! মেয়ের বাবা-মায়ের মাথা নষ্ট। তড়িঘড়ি করে পাত্রস্থ করা হয় কনেকে। তারপর স্বপ্নের আমেরিকায় এসে মেয়েটা জানতে পারে, তার স্বামী এখানে সাদামাটা একটা কাজ করে। অর্জিত অর্থে একার পক্ষে বাসা ভাড়া দিয়ে থাকা সম্ভব হয় না। তাই হয়তো সাবলেট নিয়ে থাকে। কিংবা নিজেই সাবলেট দেয়। একটা ছোট বাথরুম-একটা ছোট রান্নাঘর ভাগ করে নিতে হয় অচেনা মানুষদের সঙ্গে। তারপর কিছুদিন পরে নিজেকেও কাজে ঢুকতে হয়। সারাদিন হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের পরে বাসায় ফিরে আবার ভাত রাঁধো, মাছ পরিষ্কার কর…লন্ড্রি কর, বাজার কর…কত কি? স্ত্রী দিনে কাজ করে। স্বামী এই সময় সন্তানদের রাখে। আবার স্ত্রী বাড়ি ফেরার পরে, স্বামী রাতে কাজ করতে বের হয়। দুজনের সম্পর্কটা হয় ‘হাই’ আর ‘বাই’-এর মধ্যে সীমাবদ্ধ। নিজের আনন্দের জন্য, বিনোদনের জন্য আর কোনো সময় অবশিষ্ট থাকে না। কোনো কোনো নারী হয়তো এই নিয়ে বিষণ্নতায় ভোগে। তবে বেশির ভাগই ঘুরে দাঁড়ায়। দেয়ালে যখন পিঠ ঠেকে যায় তখন নিজের অস্তিত্বের প্রশ্নে জেগে ওঠে তারা। এভাবে কাহিনীর শেষটুকু হয়ে ওঠে সাফল্য দিয়ে মোড়া। নিউ ইয়র্ক তথা পুরো আমেরিকায় ঘরে-বাইরে সমান তালে কাজ করছে বাঙালি নারী। সন্তানদের স্কুলে আনা- নেয়া, তাদের খাওয়ানো-গোসল করানো, হোমওয়ার্ক সব দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করছে তারা। বাজার করা, রান্না করা, বাসন মাজা, রান্নাঘর পরিষ্কার থেকে বাথরুম পরিচ্ছন্ন রাখা কোনোটাই বাদ রাখছে না তারা। আবার বাইরেও কাজ করছে। যে মেয়ে চা বানাতে পারতো না, সে এখানে এসে ১৫/২০ পদের রান্না করে আপ্যায়ন করছে অতিথিদের। যারা খুব ছোটবেলায় এই দেশে এসেছে কিংবা এখানেই জন্ম তাদের অবস্থা তো আরো ভালো। আমেরিকায় মূলধারার এমন কোনো পেশা নেই যেখানে তারা নিজেদের জয় পতাকা ওড়ায়নি। পুরুষদের চেয়েও তারা অনেক ক্ষেত্রে এগিয়ে গেছে। মেধায়-মননে বাঙালি নারীরা যে ভিন্ন লিঙ্গ, ভিন্ন সংস্কৃতির মেয়েদের চেয়ে যেকোনো অংশে কম নয়, সেটা তারা করে দেখিয়েছে। যারা বেশি বয়সে আমেরিকায় এসেছে, তারাও পেশাগত যোগ্যতা অর্জন করে স্বীয় ক্ষেত্রে উজ্জ্বল প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছে।
‘নারীকে নিজেই নিজের অবস্থান পাল্টাতে হবে। সব সময় আপোষ করলে চলে না।’ এমনটাই মতামত বিশিষ্ট সমাজকর্মী রোকেয়া আকতারের। তার কথা, ‘আমি এক মেয়েকে চিনি যারা শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়স্বজন ছাড়া এখানে কারো সঙ্গে মেশে না। মানে তার সেই অনুমতি নেই। তার খালার বান্ধবী হিসেবে আমি মেয়েটিকে নিয়ে একবার ঘণ্টাখানেকের জন্য ঘুরতে বের হয়েছিলাম। মেয়েটির স্বামীর অনুমতি ছিল। কিন্তু বাসায় ফিরে তার শ্বশুর তাকে প্রচণ্ড বকাঝকা করে। কেন তারও অনুমতি নেয়া হয়নি এজন্য! এভাবে তারা বিদেশে এসে দেশের চেয়েও বেশ পরাধীন হয়ে পড়ে। আবার কোনো শিক্ষিত পরিবার আছে, যারা হয়তো নিউ ইয়র্কের বাইরে অন্যান্য রাজ্যে বিশাল প্রাসাদ বানিয়ে বাস করে। তারা একজন শিক্ষিত মেয়েকে বউ করে আনে, একজন শিক্ষিত গৃহকর্মী পাবার জন্য।’
রোকেয়া আখতার সেই সঙ্গে যুক্ত করেন, ‘যে দুটি দৃষ্টান্তের কথা বললাম এটা ব্যতিক্রম মাত্র। আসল কথা হলো, হাজারো প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও বাঙালি নারীরা উঠে আসছে। আর এখানে স্বামী-সন্তানরাও তাদের অনেক ক্ষেত্রে সহায়তা করছে। যেমন আমার নিজের ভাই কিংবা আমার বোনের স্বামীর কথা বলবো, যারা খুব ভালো রান্না করে। এবং নিয়মিত সেই কাজটা তারা করে।’
স্ত্রী কাজ করে। স্বামী সন্তানদের দেখাশুনা ও ঘরের কাজ করে। এমন পরিবার আমেরিকায় অনেক দেখা গেলেও, বাঙালিদের মধ্যে বিরল। আজন্ম সংস্কার থেকেই বাঙালিরা ধরে নেয়, পুরুষ সংসারের কর্তা। সুতরাং তারাই মূল উপার্জনের কাজটা করবে। আর যারা সেটা করে না, তাদের ‘আকাইম্যা’ পুরুষ বলে ধরা হয়। এখানেও ব্যতিক্রম আছে। নার্গিস আহমেদ নিউ ইয়র্কে এসে ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরস নিয়ে এসোসিয়েট ডিগ্রি নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করছেন। তার স্বামী একজন নামকরা ফার্মাসিস্ট। স্বামীকে পড়াশুনা করার সুযোগ দিতে তিনি কাজ করেছেন। সংসার সামলেছেন। স্বামী পেশাগত জীবনে সাফল্যপ্রাপ্তিকে ভেবেছেন নিজের সাফল্য। নার্গিস আহমেদ বলেছেন, এভাবে স্বামী-স্ত্রীর বোঝাপড়ার মাধ্যমে এগিয়ে যেতে হবে নারীকে। তবে সব নারীর স্বামী স্ত্রীকে এভাবে মূল্যায়ন করতে পারে না।
আমেরিকার মূলধারার একজন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ মাজেদা আক্তার উদ্দিন। উনি দুঃখ করে বলেন, ‘আমি কত কষ্ট করে পাঁচ জন সন্তানকে লালনপালন করেছি, আমি নিজেই জানি। কেউ আমাকে সাহায্য করেনি। কেউ না। এখনো করে না। কোথাও কি লেখা আছে, সংসারের যাবতীয় কাজের দায়িত্ব শুধু স্ত্রীদের। কোথাও নেই।’ পারিবারিক বাধা দমাতে পারেনি মাজেদা উদ্দিনকে। তিনি হয়েছেন নিউ ইয়র্ক সিটির বোর্ড অব ইলেকশন কাউন্সিলের একমাত্র বাঙালি। মাজেদা উদ্দিন বলেন, ‘আমি আমার কাজের স্বাধীনতাকে সৎপথে ব্যয় করেছি। সব মেয়েকে এভাবে ভাবতে হবে। স্বেচ্ছাচারিতার পথে পা বাড়ানো ঠিক নয়। আমাদের সংস্কৃতি ধরে রাখতে হবে। সন্তানের গতিবিধির ওপর লক্ষ্য রাখতে হবে। অনেক বাঙালি নারী কাজের কারণে ঠিকভাবে খোঁজ রাখতে পারে না, তার সন্তান কাদের সঙ্গে মিশছে। এটা ঠিক না।’ ঘরে-বাইরে সব কাজে স্ত্রীকে সমর্থন দিতে হবে স্বামীকে, নয়তো সংসার সুখের হতে পারে না বলে মনে করেন মাজেদা উদ্দিন। তিনি দুটি ঘটনার কথা বলেন। একজন রেস্টুরেন্টের ওয়েট্রেস, যার স্বামী জায়রোর গাড়িতে কাজ করে। স্বামী তার স্ত্রীর আয়ের অর্থ নিজের একাউন্টে রাখে। স্ত্রীকে জয়েন্ট একাউন্ট বা আলাদা একাউন্ট করতে দেয় না। আবার আরেক রেস্টুরেন্টের ওয়েট্রেস, যার স্বামী সরকারি চাকরি করেন, যিনি প্রায় রাতে মদ্যপ অবস্থায় বাড়িতে ফেরেন। মাজেদা উদ্দিন দুই ঘটনার প্রেক্ষিতে বলেন, ‘নিজের আয়ের অর্থে নিজের অধিকার না থাকাটা যে কত কষ্টের সেটা বলার নয়। আবার সন্তানদের সামনে প্রতিদিন মদ্যপ স্বামীকে সহ্য করাও কঠিন বিষয়। সংসারের শান্তির জন্য স্বামীকে এই বিষয়ে সচেতন হওয়া জরুরি।’ মাজেদা উদ্দিন যেমন বলেছিলেন নিজের ইচ্ছা শক্তির কথা, তেমনিভাবে মেহেরুন্নেসা জোবায়দা বলে ওঠেন, দেখুন আমেরিকা এমন একটা দেশ যেখানে কোনো নারী যদি নিজের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য স্থির রাখতে পারে, তবে তার জন্য কোনো বাধাই বাধা নয়। টাইম টেলিভিশনের প্রোগ্রাম বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্বরত মেহেরুন্নেসা জানান, ‘এখানে মধ্য বয়সে পড়াশুনা করার ও সরকারি-বেসরকারি সব ধরনের চাকরিতে ঢোকার সুযোগ আছে। বাংলাদেশে যেমন সমাজ সব ঠিক করে দেয়, একজন মায়ের চরিত্র কেমন হবে কিংবা একজন প্রেমিকার, আবার দাদী বা নানী হলে কি করতে হবে, এখানে কোনো ধরা-বাধা নিয়ম নেই। দাদী-নানী হয়ে গেলেন বলে ঘুরতে পারবেন না, বাইরে কাজ করতে পারবেন না আমেরিকায় এটা কেউ ভাবে না।’ তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশে উচ্চবিত্ত ও নিম্নবিত্তের কথা আলাদা। সেখানে নারীর অবস্থানে অনেকটাই উন্নতি হয়েছে। কিন্তু মধ্যবিত্ত সমাজের দিকে তাকান। ভালো স্ত্রী কে? যে সবচেয়ে বেশি সহ্য করে, সেই না? ’
আমেরিকায় নারীরা তাদের স্বাধীনতার অপব্যবহার করছে কিনা জানতে চাইলে মেহেরুন্নেসা বলেন, ‘এখানে অনেক নারী তাদের পছন্দ অনুযায়ী জীবন বেছে নিচ্ছেন, যেটা অনেকের সহ্য হচ্ছে না। কোনো বাঙালি নারী যদি বলে, সে স্বামী কর্তৃক ধর্ষণের শিকার, সেটা কি তার স্বদেশীরা ভালোভাবে নেবে? নেবে না।’ বাংলাদেশে সিঙ্গেল মাদার প্যারেন্টস সচরাচর দেখা যায় না। স্বামীর মৃত্যুর পরেও অনেক স্ত্রী শ্বশুরবাড়িতে থেকে যান। তালাকপ্রাপ্তদের অবস্থা হয় আরো করুণ। তাদের বাপেরবাড়ির মানুষজনও ভালোভাবে নিতে পারে না। কোনো বাবা-মায়ের তালাকপ্রাপ্ত মেয়ে থাকলে, তাদের আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ কমিয়ে দিতে হয়। অথচ নিউ ইয়র্কে অনেক বিধবা কিংবা তালাকপ্রাপ্ত নারীরা মাথা উঁচু করে সগৌরবে কাজ করে যাচ্ছে। মেহেরুন্নেসা জোবায়দা জানালেন, ‘আমি একজনকে জানি যার স্বামী মারা যাবার পরে উনি বাংলাদেশে চলে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, আমি কঠিনভাবে বারণ করেছি তাকে। কারণ বাংলাদেশে গেলে একদিন-দুইদিন সবাই তাকে সমবেদনা জানাবে, তারপর সবাই ভুলে যাবে। আর এখানে থাকলে তার কাজের সুযোগ আছে। কাজ না করলেও সরকার থেকে অনেক ভাতা সে পাবে।’
ম্যানহাটানের চেম্বার স্ট্রিটের এক ইতালিয়ান রেস্টুরেন্টে ম্যানেজারের কাজ করেন সালমা আলম কান্তা। একমাত্র ছেলে সন্তান নিয়ে জ্যাকসন হাইটসে থাকেন। স্বামী কাজের কারণে ফ্লোরিডা থাকেন। কান্তা জানালেন, ‘আমার কোনো সমস্যাই হয় না একা থাকতে। গভীর রাতে যখন বাসায় ফিরি, রাস্তাঘাটে কেউ ফিরেও তাকায় না। এখানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা অনেক ভালো। ছেলের সঙ্গে সারাদিন ফেসটাইমে কথা হয়। সন্ধ্যার পরে ওর বাসায় ভয় লাগলে স্টারবাকস কিংবা ম্যাকডোনাল্ডসে গিয়ে বসে বসে পড়ে।’ ঢাকায় থাকতে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের রিলেশনশিপ ম্যানেজার ছিলেন। এখানে এসে অড জব করছেন। কিন্তু তাতে খারাপ লাগছে না কান্তার। তিনি বলেন, ‘আমার কাগজপত্র হয়ে গেলেই পড়াশুনা শুরু করবো। এবং আমার বিশ্বাস বাংলাদেশের চেয়ে এখানে আমি আরো ভালো করবো।’
তবে কাজের ক্ষেত্রে বাঙালিদের তুলনায় অন্য দেশের মালিকরা ভালো হন বলে জানান কান্তা, ‘আমি যেখানে কাজ করি, সেখানে সপ্তাহ শেষ হলেই পেমেন্ট করা হয়। বাঙালি মালিকদের অধীনে আমি কাজ করে এটা পাইনি। শুধু সেটা নয়, তারা সর্বনিম্ন মজুরিও দিতে চায় না।’ স্বাধীনতা ও স্বেচ্ছাচারিতার পার্থক্য করতে বললে কান্তা একটা উদাহরণ টানেন। বলেন, ‘দেখুন আমি একটা উদাহরণ দেই। হ্যালোইনের দিন আমি ছেলেকে নিয়ে অনেক ঘুরেছি। ট্রিকস অ্যান্ড ট্রিটস করেছি। কিন্তু এদেশে অনেকে আছেন, মদ পান করে এই দিনে। আমি তো সেটা করিনি। উৎসবের ভালোটুকুই শুধু নিয়েছি।’
কান্তার মতো একাই থাকেন শারমিন মিয়া। জ্যাকসন হাইটসের ৭৭ স্ট্রিটে অবস্থিত ডাইম ব্যাংকে সুপারভাইজারের চাকরি করেন। ২০ বছর আগে এই দেশে এসেছেন। স্বামী-সন্তান ছাড়াই নিজের মতো জীবনযাপন করছেন। কাজ করেন। বাসায় ফিরে ঘরের কাজ করেন। কারো কাছে জবাবদিহি করতে হয় না। এটা বাংলাদেশে থাকলে পারতেন না বলে মনে করেন শারমিন। তার কথা হলো, ‘এদেশে এসে নিজেকে কখনো মেয়ে বলে আলাদা কিছু মনে হয়নি। একা থাকার জন্য কোনো সমস্যা মোকাবিলা করতে হয়নি। কখনও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগিনি।’ কান্তা কিংবা শারমিন যেভাবে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে সব বাধাকে মোকাবিলা করেছেন, এটা সবাই পারে না বলে জানান রুবাইয়া রহমান। বাঙালি কমিউনিটির নামকরা আইনজীবী রুবাইয়া বলেন, ‘অনেক মেয়েই নিজেদের অধিকারের কথা জানে না। এর একটা প্রধান কারণ ভাষাগত সমস্যা। ইংরেজিতে কথা বলতে বা বুঝতে না পারার জন্য প্রাপ্ত তথ্যগুলো তারা পায় না। ফলে তারা হয় ছোট চাকরি করে। কিংবা স্বামীর কর্তৃত্ব মেনে সংসারে পড়ে থাকে।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক ছিলেন রুবাইয়া। অটিস্টিক সন্তানের চিকিৎসার স্বার্থে তার পুরো পরিবার এখানে চলে আসে। পরে এখানে এসে রুবাইয়া আইন নিয়ে পড়াশুনা করে, এই পেশায় ক্যারিয়ার গড়েন। ক্যারিয়ারের ক্ষেত্রে রুবাইয়া রহমানকে দুই ধরনের সমস্যা মোকাবিলা করতে হয়। প্রথমত, তিনি জানান, ‘এখানে আইন পেশাকে অনেকটা কমিউনিটি বেজড ধরা হয়। যেমন সাদারা সাদাদের কাছে যায়। স্প্যানিশরা স্প্যানিশদের কাছে। কিন্তু আমি যদি বাংলাদেশে থাকতাম এই সমস্যাকে মোকাবিলা করতে হতো না। কারণ সেখানে আমরা সবাই বাঙালি।’ দ্বিতীয়ত রুবাইয়া বলেন, ‘আমার সন্তান অটিস্টিক। বাংলাদেশে থাকা অবস্থায় আমি কাজে গেলে ছেলেকে রাখার ব্যাপারে বাবা-মায়ের সহায়তা পেয়েছি। কিন্তু এখানে প্রথম দিকে এজন্য অনেক সমস্যা মোকাবিলা করেছি। মনে আছে, সাবওয়ে স্টেশনের সিঁড়ি দিয়ে ছেলেকে কোলে নিয়ে উঠতে খুব কষ্ট হতো। বহুদিন সিঁড়ির গোড়ায় বসে নিজের অসহায়ত্বের জন্য কেঁদেছি। পরে নিজেকেই নিজে সান্ত্বনা দিয়েছি। এদেশে অটিস্টিক শিশুদের জন্য অনেক সুযোগ-সুবিধা আছে। যেটা আদায় করে নিতে জানতে হয়। আমি সেটা করতে পেরেছি। ওর জন্য ফুলটাইম কেয়ারগিভার পেয়েছি। যে কারণে আইন পেশায় মনোযোগ দিতে পেরেছি।’
ভাষাগত সমস্যা ছাড়াও বৈধতা না থাকাসহ বিভিন্ন কারণে মজুরি বৈষম্যের শিকার হতে হয় নারীকে। জ্যাকসন হাইটসে বিভিন্ন দোকানে চাকরিরত নারীদের এ নিয়ে চাপা ক্ষোভ বহুদিনের। এখানে বেশিরভাগ মালিকই মজুরি আইনের কোনো নিয়ম মানেন না। তারা সারাদিন খাটিয়ে নিয়ে দিনশেষে ৪০/৫০ ডলার করে মজুরি দেয়। ওভারটাইম দেয় না। যখন তখন চাকরি থেকে ছাঁটাই করে। কাজের ঘণ্টা কমিয়ে দেয়। এতে করে মানসিকভাবে চরমভাবে বিপর্যস্ত হতে হয় নারীকে। জ্যাকসন হাইটসে নন্দিনী ফ্যাশনে কাজ করে পর্ণা ইয়াসমীন বলেন, ‘আমি আগে যেখানে কাজ করতাম, সেখানে মালিক যা খুশি তাই ব্যবহার করতো আমার সঙ্গে। মনে হতো আমি যেন তার ক্রীতদাস। এভাবে অন্যের মর্জিমতো চলা যায় না।’ বাংলাদেশে আইনজীবী ছিলেন পর্ণা। এখন কাপড়ের দোকানের সেলসগার্ল। যদিও এই দেশে কাজের ক্ষেত্রে কোনো পার্থক্য করা হয় না। তবু স্বীয় মেধার বিকাশ ঘটাতে না পেরে কেউ কেউ হতাশায় ভোগেন বই কি? তবে পর্ণার একটা জিনিস খুব ভালো লাগে। এখানে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান কিংবা মেলায় সে নিয়মিত যেতে পারছে। পর্ণা জানান, বাংলাদেশে থাকতে কোনো অনুষ্ঠানে যাওয়া হতো না। পথে বের হলে যানজট। তারপর রাতে বাসায় ফিরতে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতাম। এখানে সেই সমস্যা নেই। তাই কাজ শেষে এখানে সন্ধ্যাবেলাটা খুব উপভোগ করি। শুধু সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলোতে দর্শক উপস্থিতি বেড়েছে, তাই নয়। পারফরমারের সংখ্যাও বেড়েছে। বাঙালি নারীরা এখানে আপন দেশের সংস্কৃতির বিকাশে বড় ভূমিকা রাখছেন। বাংলাদেশ থেকে অভিনেত্রী, নাট্যকার, নাট্য সংগঠক, নির্দেশকরা আপন পরিচয় বিচ্যুত হননি। বরং সেটা ধরে রেখেছেন ও নতুন প্রজন্মের মধ্যে সেই আলো ছড়িয়ে দিয়েছেন। রেখা আহমেদ, রওশন আরা হোসেন, লুৎফুন্নাহার লতা, নার্গিস আহমেদ নিউ ইয়র্কের শিল্প সংস্কৃতির অঙ্গনে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন। সদ্য ৭০তম জন্মদিন পালন করা রেখা আহমেদ জানিয়েছেন, ‘নারীরা এখানে সংস্কৃতি ও সাহিত্য দুই জায়গায় খুব ভালো করছে। বিশেষ করে সংগীতের কথা বলবো। নতুন প্রজন্মের অনেক মেয়ের গান মুগ্ধ হয়ে শুনতে হয়। তার মানে তারা বাংলা গানটাকে ভালোবাসছে। এটা খুব বড় খবর। তবে সংগীতের মতো নাটকের রিহার্সেলে মেয়েদের সেভাবে পাওয়া যাচ্ছে না। নিউ ইয়র্কে কয়েকটা গ্রুপ আছে। তবে সেখানে নারী সদস্য আছে হাতেগোনা। অনেকেই হয়তো ভাবে যে নাটকের রিহার্সেল করতে যতটা সময় লাগবে, সেই সময় ডানকিন বা ডোয়াইন রিডে কাজ করলে ডলার পাওয়া যাবে।’ রেখা আহমেদের মতো রানু ফেরদৌসও মনে করেন, নিউ ইয়র্কের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছে নারীরা। সমাজকর্মী ও বাংলাদেশ সোসাইটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক এই মানুষটি বলেন, ‘এখানে বিপার মতো একটি সংগঠন কত বড় কাজ করছে ভাবাই যায় না। তাদের পারফরমেন্স দেখে আমি মুগ্ধ হই। বিপার এই উঠে আসার পেছনে এ্যানী ফেরদৌসের নিরলস অবদানের কথা বলবো। কাবেরী দাসের সংগীত পরিষদ, স্বপ্ন নাসরিনের সুরবাহারের কথা আমরা জানি। মনিকা রায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন শিল্পকলা একাডেমিকে। শুধু কুইন্সেই নয়, ব্রঙ্কসেও অনেক নারী সংগঠক খুব ভালো কাজ করছে। যাদের একজন ফরিদা ইয়াসমীনের কথা না বললে নয়। আরো অনেকে আছে তাদের মতো। এই বিষয়টা আমাকে খুব অনুপ্রাণিত করে।’
আমেরিকার মূলধারায় নারীরা সম্পৃক্ত হতে না পারাটা কষ্ট দেয় রানু ফেরদৌসকে, ‘আমি এমন বলবো না আমেরিকার মূলধারায় বাঙালি পুরুষরা অনেকে আছে। তবে তাতে কিছু যায়ও আসে না। নারীদের থাকা উচিত ছিল। এর অবশ্য কারণও আছে। ইংল্যান্ডে যত আগে বাঙালিরা বসবাস শুরু করেছে, আমেরিকায় বাঙালিরা তত আগে আসেনি। ইংল্যান্ডে এখন চতুর্থ প্রজন্ম বাঙালি বাস করছে। সেখানে নিউ ইয়র্কে দ্বিতীয় প্রজন্ম। সিলেটিরা বাংলাদেশ থেকে লন্ডনে গেলে কাজের কোনো সমস্যা হয় না। এমনকি কাজের জায়গায় থাকা-খাওয়া ফ্রি পায়। নিউ ইয়র্কে তো আয়ের একটা বড় অংশ চলে যায় বাসা ভাড়া দিতে। তাই এখানে জীবনযাপন অনেক জটিল। বাঙালিদের এখানে লড়াইটা তাই অনেক বেশি।’
সব মিলে এখানে আসা নারীদের দুই ভাবে দেখেন কমিউনিটি অ্যাকটিভিস্ট নার্গিস আহমেদ। তার ভাষ্য, ‘যারা গ্রাম থেকে বিয়ে করে নিউ ইয়র্কে আসে, তাদের জন্য এটা একটা স্বপ্নের শহর। তারা যদি পড়াশুনা করে কাজ করতে পারে তবে সেটা তার জন্য, পরিবারের জন্য বিশাল একটা অর্জন। কারণ দেখুন ওই মেয়েটি শুধু স্বামী ও সংসারকে না, দেশে নিজের বাবা-মাকে সাহায্য করতে পারছে। যেটা হয়তো বাংলাদেশে থাকলে পারতো না। আবার নিজের পরিবারের মানুষদের আমেরিকায়ও আনতে পারছে। কিন্তু ওই মেয়েটি যদি রঙিন চশমা চোখে দিয়ে স্বাধীনতার অপব্যয় করে তবেই বিপদ। কারণ স্বাধীনতা মানে স্বেচ্ছাচারিতা কিংবা নগ্নতা নয়, স্বাধীনতা মানে আত্মবিশ্বাস-দৃঢ়তার এক ধরনের সমন্বয়।’
নার্গিস আহমেদ তার দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় আরো এক দলের কথা বলেন। যারা বাংলাদেশে অভিজাত পরিবার থেকে নিউ ইয়র্কে আসে। তিনি তাদের কথা জানাতে বলেন, ‘বাংলাদেশের এক শ্রেণির অভিভাবকরা আছেন যারা পাত্র আমেরিকান শুনলেই গলে যান। সে কি করে, বয়স কত- এসব ধার ধারে না। পাত্র হয়তো বললো সে ইঞ্জিনিয়ার। পাত্রীপক্ষ কোনো কিছু খোঁজ না নিয়ে তাতেই বিশ্বাস করে। এখানে এসে মেয়েটা জানতে পারে তার স্বামী কোনো অড জব করছে। তখন তার স্বপ্নভঙ্গ হয়। মেয়েটা মানিয়ে নিতে পারে না। এক সময় গ্রিন কার্ড হওয়ার পরে ওই মেয়েটা স্বাবলম্বী হয়ে ওঠে। তখন বাড়ে সংঘাত। তবে আমি বলবো বাঙালি সমাজে বিচ্ছেদের ঘটনা হাতেগোনা। বেশিরভাগ নারী ঘরে-বাইরে প্রচণ্ড পরিশ্রম করছে। কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনার জন্য সব নারীকে ঢালাওভাবে দোষারোপ করা ঠিক না।’
‘নারীকে নিজেই নিজের অবস্থান পাল্টাতে হবে। সব সময় আপোষ করলে চলে না।’ এমনটাই মতামত বিশিষ্ট সমাজকর্মী রোকেয়া আকতারের। তার কথা, ‘আমি এক মেয়েকে চিনি যারা শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়স্বজন ছাড়া এখানে কারো সঙ্গে মেশে না। মানে তার সেই অনুমতি নেই। তার খালার বান্ধবী হিসেবে আমি মেয়েটিকে নিয়ে একবার ঘণ্টাখানেকের জন্য ঘুরতে বের হয়েছিলাম। মেয়েটির স্বামীর অনুমতি ছিল। কিন্তু বাসায় ফিরে তার শ্বশুর তাকে প্রচণ্ড বকাঝকা করে। কেন তারও অনুমতি নেয়া হয়নি এজন্য! এভাবে তারা বিদেশে এসে দেশের চেয়েও বেশ পরাধীন হয়ে পড়ে। আবার কোনো শিক্ষিত পরিবার আছে, যারা হয়তো নিউ ইয়র্কের বাইরে অন্যান্য রাজ্যে বিশাল প্রাসাদ বানিয়ে বাস করে। তারা একজন শিক্ষিত মেয়েকে বউ করে আনে, একজন শিক্ষিত গৃহকর্মী পাবার জন্য।’
রোকেয়া আখতার সেই সঙ্গে যুক্ত করেন, ‘যে দুটি দৃষ্টান্তের কথা বললাম এটা ব্যতিক্রম মাত্র। আসল কথা হলো, হাজারো প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও বাঙালি নারীরা উঠে আসছে। আর এখানে স্বামী-সন্তানরাও তাদের অনেক ক্ষেত্রে সহায়তা করছে। যেমন আমার নিজের ভাই কিংবা আমার বোনের স্বামীর কথা বলবো, যারা খুব ভালো রান্না করে। এবং নিয়মিত সেই কাজটা তারা করে।’
স্ত্রী কাজ করে। স্বামী সন্তানদের দেখাশুনা ও ঘরের কাজ করে। এমন পরিবার আমেরিকায় অনেক দেখা গেলেও, বাঙালিদের মধ্যে বিরল। আজন্ম সংস্কার থেকেই বাঙালিরা ধরে নেয়, পুরুষ সংসারের কর্তা। সুতরাং তারাই মূল উপার্জনের কাজটা করবে। আর যারা সেটা করে না, তাদের ‘আকাইম্যা’ পুরুষ বলে ধরা হয়। এখানেও ব্যতিক্রম আছে। নার্গিস আহমেদ নিউ ইয়র্কে এসে ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরস নিয়ে এসোসিয়েট ডিগ্রি নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করছেন। তার স্বামী একজন নামকরা ফার্মাসিস্ট। স্বামীকে পড়াশুনা করার সুযোগ দিতে তিনি কাজ করেছেন। সংসার সামলেছেন। স্বামী পেশাগত জীবনে সাফল্যপ্রাপ্তিকে ভেবেছেন নিজের সাফল্য। নার্গিস আহমেদ বলেছেন, এভাবে স্বামী-স্ত্রীর বোঝাপড়ার মাধ্যমে এগিয়ে যেতে হবে নারীকে। তবে সব নারীর স্বামী স্ত্রীকে এভাবে মূল্যায়ন করতে পারে না।
আমেরিকার মূলধারার একজন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ মাজেদা আক্তার উদ্দিন। উনি দুঃখ করে বলেন, ‘আমি কত কষ্ট করে পাঁচ জন সন্তানকে লালনপালন করেছি, আমি নিজেই জানি। কেউ আমাকে সাহায্য করেনি। কেউ না। এখনো করে না। কোথাও কি লেখা আছে, সংসারের যাবতীয় কাজের দায়িত্ব শুধু স্ত্রীদের। কোথাও নেই।’ পারিবারিক বাধা দমাতে পারেনি মাজেদা উদ্দিনকে। তিনি হয়েছেন নিউ ইয়র্ক সিটির বোর্ড অব ইলেকশন কাউন্সিলের একমাত্র বাঙালি। মাজেদা উদ্দিন বলেন, ‘আমি আমার কাজের স্বাধীনতাকে সৎপথে ব্যয় করেছি। সব মেয়েকে এভাবে ভাবতে হবে। স্বেচ্ছাচারিতার পথে পা বাড়ানো ঠিক নয়। আমাদের সংস্কৃতি ধরে রাখতে হবে। সন্তানের গতিবিধির ওপর লক্ষ্য রাখতে হবে। অনেক বাঙালি নারী কাজের কারণে ঠিকভাবে খোঁজ রাখতে পারে না, তার সন্তান কাদের সঙ্গে মিশছে। এটা ঠিক না।’ ঘরে-বাইরে সব কাজে স্ত্রীকে সমর্থন দিতে হবে স্বামীকে, নয়তো সংসার সুখের হতে পারে না বলে মনে করেন মাজেদা উদ্দিন। তিনি দুটি ঘটনার কথা বলেন। একজন রেস্টুরেন্টের ওয়েট্রেস, যার স্বামী জায়রোর গাড়িতে কাজ করে। স্বামী তার স্ত্রীর আয়ের অর্থ নিজের একাউন্টে রাখে। স্ত্রীকে জয়েন্ট একাউন্ট বা আলাদা একাউন্ট করতে দেয় না। আবার আরেক রেস্টুরেন্টের ওয়েট্রেস, যার স্বামী সরকারি চাকরি করেন, যিনি প্রায় রাতে মদ্যপ অবস্থায় বাড়িতে ফেরেন। মাজেদা উদ্দিন দুই ঘটনার প্রেক্ষিতে বলেন, ‘নিজের আয়ের অর্থে নিজের অধিকার না থাকাটা যে কত কষ্টের সেটা বলার নয়। আবার সন্তানদের সামনে প্রতিদিন মদ্যপ স্বামীকে সহ্য করাও কঠিন বিষয়। সংসারের শান্তির জন্য স্বামীকে এই বিষয়ে সচেতন হওয়া জরুরি।’ মাজেদা উদ্দিন যেমন বলেছিলেন নিজের ইচ্ছা শক্তির কথা, তেমনিভাবে মেহেরুন্নেসা জোবায়দা বলে ওঠেন, দেখুন আমেরিকা এমন একটা দেশ যেখানে কোনো নারী যদি নিজের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য স্থির রাখতে পারে, তবে তার জন্য কোনো বাধাই বাধা নয়। টাইম টেলিভিশনের প্রোগ্রাম বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্বরত মেহেরুন্নেসা জানান, ‘এখানে মধ্য বয়সে পড়াশুনা করার ও সরকারি-বেসরকারি সব ধরনের চাকরিতে ঢোকার সুযোগ আছে। বাংলাদেশে যেমন সমাজ সব ঠিক করে দেয়, একজন মায়ের চরিত্র কেমন হবে কিংবা একজন প্রেমিকার, আবার দাদী বা নানী হলে কি করতে হবে, এখানে কোনো ধরা-বাধা নিয়ম নেই। দাদী-নানী হয়ে গেলেন বলে ঘুরতে পারবেন না, বাইরে কাজ করতে পারবেন না আমেরিকায় এটা কেউ ভাবে না।’ তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশে উচ্চবিত্ত ও নিম্নবিত্তের কথা আলাদা। সেখানে নারীর অবস্থানে অনেকটাই উন্নতি হয়েছে। কিন্তু মধ্যবিত্ত সমাজের দিকে তাকান। ভালো স্ত্রী কে? যে সবচেয়ে বেশি সহ্য করে, সেই না? ’
আমেরিকায় নারীরা তাদের স্বাধীনতার অপব্যবহার করছে কিনা জানতে চাইলে মেহেরুন্নেসা বলেন, ‘এখানে অনেক নারী তাদের পছন্দ অনুযায়ী জীবন বেছে নিচ্ছেন, যেটা অনেকের সহ্য হচ্ছে না। কোনো বাঙালি নারী যদি বলে, সে স্বামী কর্তৃক ধর্ষণের শিকার, সেটা কি তার স্বদেশীরা ভালোভাবে নেবে? নেবে না।’ বাংলাদেশে সিঙ্গেল মাদার প্যারেন্টস সচরাচর দেখা যায় না। স্বামীর মৃত্যুর পরেও অনেক স্ত্রী শ্বশুরবাড়িতে থেকে যান। তালাকপ্রাপ্তদের অবস্থা হয় আরো করুণ। তাদের বাপেরবাড়ির মানুষজনও ভালোভাবে নিতে পারে না। কোনো বাবা-মায়ের তালাকপ্রাপ্ত মেয়ে থাকলে, তাদের আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ কমিয়ে দিতে হয়। অথচ নিউ ইয়র্কে অনেক বিধবা কিংবা তালাকপ্রাপ্ত নারীরা মাথা উঁচু করে সগৌরবে কাজ করে যাচ্ছে। মেহেরুন্নেসা জোবায়দা জানালেন, ‘আমি একজনকে জানি যার স্বামী মারা যাবার পরে উনি বাংলাদেশে চলে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, আমি কঠিনভাবে বারণ করেছি তাকে। কারণ বাংলাদেশে গেলে একদিন-দুইদিন সবাই তাকে সমবেদনা জানাবে, তারপর সবাই ভুলে যাবে। আর এখানে থাকলে তার কাজের সুযোগ আছে। কাজ না করলেও সরকার থেকে অনেক ভাতা সে পাবে।’
ম্যানহাটানের চেম্বার স্ট্রিটের এক ইতালিয়ান রেস্টুরেন্টে ম্যানেজারের কাজ করেন সালমা আলম কান্তা। একমাত্র ছেলে সন্তান নিয়ে জ্যাকসন হাইটসে থাকেন। স্বামী কাজের কারণে ফ্লোরিডা থাকেন। কান্তা জানালেন, ‘আমার কোনো সমস্যাই হয় না একা থাকতে। গভীর রাতে যখন বাসায় ফিরি, রাস্তাঘাটে কেউ ফিরেও তাকায় না। এখানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা অনেক ভালো। ছেলের সঙ্গে সারাদিন ফেসটাইমে কথা হয়। সন্ধ্যার পরে ওর বাসায় ভয় লাগলে স্টারবাকস কিংবা ম্যাকডোনাল্ডসে গিয়ে বসে বসে পড়ে।’ ঢাকায় থাকতে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের রিলেশনশিপ ম্যানেজার ছিলেন। এখানে এসে অড জব করছেন। কিন্তু তাতে খারাপ লাগছে না কান্তার। তিনি বলেন, ‘আমার কাগজপত্র হয়ে গেলেই পড়াশুনা শুরু করবো। এবং আমার বিশ্বাস বাংলাদেশের চেয়ে এখানে আমি আরো ভালো করবো।’
তবে কাজের ক্ষেত্রে বাঙালিদের তুলনায় অন্য দেশের মালিকরা ভালো হন বলে জানান কান্তা, ‘আমি যেখানে কাজ করি, সেখানে সপ্তাহ শেষ হলেই পেমেন্ট করা হয়। বাঙালি মালিকদের অধীনে আমি কাজ করে এটা পাইনি। শুধু সেটা নয়, তারা সর্বনিম্ন মজুরিও দিতে চায় না।’ স্বাধীনতা ও স্বেচ্ছাচারিতার পার্থক্য করতে বললে কান্তা একটা উদাহরণ টানেন। বলেন, ‘দেখুন আমি একটা উদাহরণ দেই। হ্যালোইনের দিন আমি ছেলেকে নিয়ে অনেক ঘুরেছি। ট্রিকস অ্যান্ড ট্রিটস করেছি। কিন্তু এদেশে অনেকে আছেন, মদ পান করে এই দিনে। আমি তো সেটা করিনি। উৎসবের ভালোটুকুই শুধু নিয়েছি।’
কান্তার মতো একাই থাকেন শারমিন মিয়া। জ্যাকসন হাইটসের ৭৭ স্ট্রিটে অবস্থিত ডাইম ব্যাংকে সুপারভাইজারের চাকরি করেন। ২০ বছর আগে এই দেশে এসেছেন। স্বামী-সন্তান ছাড়াই নিজের মতো জীবনযাপন করছেন। কাজ করেন। বাসায় ফিরে ঘরের কাজ করেন। কারো কাছে জবাবদিহি করতে হয় না। এটা বাংলাদেশে থাকলে পারতেন না বলে মনে করেন শারমিন। তার কথা হলো, ‘এদেশে এসে নিজেকে কখনো মেয়ে বলে আলাদা কিছু মনে হয়নি। একা থাকার জন্য কোনো সমস্যা মোকাবিলা করতে হয়নি। কখনও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগিনি।’ কান্তা কিংবা শারমিন যেভাবে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে সব বাধাকে মোকাবিলা করেছেন, এটা সবাই পারে না বলে জানান রুবাইয়া রহমান। বাঙালি কমিউনিটির নামকরা আইনজীবী রুবাইয়া বলেন, ‘অনেক মেয়েই নিজেদের অধিকারের কথা জানে না। এর একটা প্রধান কারণ ভাষাগত সমস্যা। ইংরেজিতে কথা বলতে বা বুঝতে না পারার জন্য প্রাপ্ত তথ্যগুলো তারা পায় না। ফলে তারা হয় ছোট চাকরি করে। কিংবা স্বামীর কর্তৃত্ব মেনে সংসারে পড়ে থাকে।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক ছিলেন রুবাইয়া। অটিস্টিক সন্তানের চিকিৎসার স্বার্থে তার পুরো পরিবার এখানে চলে আসে। পরে এখানে এসে রুবাইয়া আইন নিয়ে পড়াশুনা করে, এই পেশায় ক্যারিয়ার গড়েন। ক্যারিয়ারের ক্ষেত্রে রুবাইয়া রহমানকে দুই ধরনের সমস্যা মোকাবিলা করতে হয়। প্রথমত, তিনি জানান, ‘এখানে আইন পেশাকে অনেকটা কমিউনিটি বেজড ধরা হয়। যেমন সাদারা সাদাদের কাছে যায়। স্প্যানিশরা স্প্যানিশদের কাছে। কিন্তু আমি যদি বাংলাদেশে থাকতাম এই সমস্যাকে মোকাবিলা করতে হতো না। কারণ সেখানে আমরা সবাই বাঙালি।’ দ্বিতীয়ত রুবাইয়া বলেন, ‘আমার সন্তান অটিস্টিক। বাংলাদেশে থাকা অবস্থায় আমি কাজে গেলে ছেলেকে রাখার ব্যাপারে বাবা-মায়ের সহায়তা পেয়েছি। কিন্তু এখানে প্রথম দিকে এজন্য অনেক সমস্যা মোকাবিলা করেছি। মনে আছে, সাবওয়ে স্টেশনের সিঁড়ি দিয়ে ছেলেকে কোলে নিয়ে উঠতে খুব কষ্ট হতো। বহুদিন সিঁড়ির গোড়ায় বসে নিজের অসহায়ত্বের জন্য কেঁদেছি। পরে নিজেকেই নিজে সান্ত্বনা দিয়েছি। এদেশে অটিস্টিক শিশুদের জন্য অনেক সুযোগ-সুবিধা আছে। যেটা আদায় করে নিতে জানতে হয়। আমি সেটা করতে পেরেছি। ওর জন্য ফুলটাইম কেয়ারগিভার পেয়েছি। যে কারণে আইন পেশায় মনোযোগ দিতে পেরেছি।’
ভাষাগত সমস্যা ছাড়াও বৈধতা না থাকাসহ বিভিন্ন কারণে মজুরি বৈষম্যের শিকার হতে হয় নারীকে। জ্যাকসন হাইটসে বিভিন্ন দোকানে চাকরিরত নারীদের এ নিয়ে চাপা ক্ষোভ বহুদিনের। এখানে বেশিরভাগ মালিকই মজুরি আইনের কোনো নিয়ম মানেন না। তারা সারাদিন খাটিয়ে নিয়ে দিনশেষে ৪০/৫০ ডলার করে মজুরি দেয়। ওভারটাইম দেয় না। যখন তখন চাকরি থেকে ছাঁটাই করে। কাজের ঘণ্টা কমিয়ে দেয়। এতে করে মানসিকভাবে চরমভাবে বিপর্যস্ত হতে হয় নারীকে। জ্যাকসন হাইটসে নন্দিনী ফ্যাশনে কাজ করে পর্ণা ইয়াসমীন বলেন, ‘আমি আগে যেখানে কাজ করতাম, সেখানে মালিক যা খুশি তাই ব্যবহার করতো আমার সঙ্গে। মনে হতো আমি যেন তার ক্রীতদাস। এভাবে অন্যের মর্জিমতো চলা যায় না।’ বাংলাদেশে আইনজীবী ছিলেন পর্ণা। এখন কাপড়ের দোকানের সেলসগার্ল। যদিও এই দেশে কাজের ক্ষেত্রে কোনো পার্থক্য করা হয় না। তবু স্বীয় মেধার বিকাশ ঘটাতে না পেরে কেউ কেউ হতাশায় ভোগেন বই কি? তবে পর্ণার একটা জিনিস খুব ভালো লাগে। এখানে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান কিংবা মেলায় সে নিয়মিত যেতে পারছে। পর্ণা জানান, বাংলাদেশে থাকতে কোনো অনুষ্ঠানে যাওয়া হতো না। পথে বের হলে যানজট। তারপর রাতে বাসায় ফিরতে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতাম। এখানে সেই সমস্যা নেই। তাই কাজ শেষে এখানে সন্ধ্যাবেলাটা খুব উপভোগ করি। শুধু সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলোতে দর্শক উপস্থিতি বেড়েছে, তাই নয়। পারফরমারের সংখ্যাও বেড়েছে। বাঙালি নারীরা এখানে আপন দেশের সংস্কৃতির বিকাশে বড় ভূমিকা রাখছেন। বাংলাদেশ থেকে অভিনেত্রী, নাট্যকার, নাট্য সংগঠক, নির্দেশকরা আপন পরিচয় বিচ্যুত হননি। বরং সেটা ধরে রেখেছেন ও নতুন প্রজন্মের মধ্যে সেই আলো ছড়িয়ে দিয়েছেন। রেখা আহমেদ, রওশন আরা হোসেন, লুৎফুন্নাহার লতা, নার্গিস আহমেদ নিউ ইয়র্কের শিল্প সংস্কৃতির অঙ্গনে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন। সদ্য ৭০তম জন্মদিন পালন করা রেখা আহমেদ জানিয়েছেন, ‘নারীরা এখানে সংস্কৃতি ও সাহিত্য দুই জায়গায় খুব ভালো করছে। বিশেষ করে সংগীতের কথা বলবো। নতুন প্রজন্মের অনেক মেয়ের গান মুগ্ধ হয়ে শুনতে হয়। তার মানে তারা বাংলা গানটাকে ভালোবাসছে। এটা খুব বড় খবর। তবে সংগীতের মতো নাটকের রিহার্সেলে মেয়েদের সেভাবে পাওয়া যাচ্ছে না। নিউ ইয়র্কে কয়েকটা গ্রুপ আছে। তবে সেখানে নারী সদস্য আছে হাতেগোনা। অনেকেই হয়তো ভাবে যে নাটকের রিহার্সেল করতে যতটা সময় লাগবে, সেই সময় ডানকিন বা ডোয়াইন রিডে কাজ করলে ডলার পাওয়া যাবে।’ রেখা আহমেদের মতো রানু ফেরদৌসও মনে করেন, নিউ ইয়র্কের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছে নারীরা। সমাজকর্মী ও বাংলাদেশ সোসাইটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক এই মানুষটি বলেন, ‘এখানে বিপার মতো একটি সংগঠন কত বড় কাজ করছে ভাবাই যায় না। তাদের পারফরমেন্স দেখে আমি মুগ্ধ হই। বিপার এই উঠে আসার পেছনে এ্যানী ফেরদৌসের নিরলস অবদানের কথা বলবো। কাবেরী দাসের সংগীত পরিষদ, স্বপ্ন নাসরিনের সুরবাহারের কথা আমরা জানি। মনিকা রায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন শিল্পকলা একাডেমিকে। শুধু কুইন্সেই নয়, ব্রঙ্কসেও অনেক নারী সংগঠক খুব ভালো কাজ করছে। যাদের একজন ফরিদা ইয়াসমীনের কথা না বললে নয়। আরো অনেকে আছে তাদের মতো। এই বিষয়টা আমাকে খুব অনুপ্রাণিত করে।’
আমেরিকার মূলধারায় নারীরা সম্পৃক্ত হতে না পারাটা কষ্ট দেয় রানু ফেরদৌসকে, ‘আমি এমন বলবো না আমেরিকার মূলধারায় বাঙালি পুরুষরা অনেকে আছে। তবে তাতে কিছু যায়ও আসে না। নারীদের থাকা উচিত ছিল। এর অবশ্য কারণও আছে। ইংল্যান্ডে যত আগে বাঙালিরা বসবাস শুরু করেছে, আমেরিকায় বাঙালিরা তত আগে আসেনি। ইংল্যান্ডে এখন চতুর্থ প্রজন্ম বাঙালি বাস করছে। সেখানে নিউ ইয়র্কে দ্বিতীয় প্রজন্ম। সিলেটিরা বাংলাদেশ থেকে লন্ডনে গেলে কাজের কোনো সমস্যা হয় না। এমনকি কাজের জায়গায় থাকা-খাওয়া ফ্রি পায়। নিউ ইয়র্কে তো আয়ের একটা বড় অংশ চলে যায় বাসা ভাড়া দিতে। তাই এখানে জীবনযাপন অনেক জটিল। বাঙালিদের এখানে লড়াইটা তাই অনেক বেশি।’
সব মিলে এখানে আসা নারীদের দুই ভাবে দেখেন কমিউনিটি অ্যাকটিভিস্ট নার্গিস আহমেদ। তার ভাষ্য, ‘যারা গ্রাম থেকে বিয়ে করে নিউ ইয়র্কে আসে, তাদের জন্য এটা একটা স্বপ্নের শহর। তারা যদি পড়াশুনা করে কাজ করতে পারে তবে সেটা তার জন্য, পরিবারের জন্য বিশাল একটা অর্জন। কারণ দেখুন ওই মেয়েটি শুধু স্বামী ও সংসারকে না, দেশে নিজের বাবা-মাকে সাহায্য করতে পারছে। যেটা হয়তো বাংলাদেশে থাকলে পারতো না। আবার নিজের পরিবারের মানুষদের আমেরিকায়ও আনতে পারছে। কিন্তু ওই মেয়েটি যদি রঙিন চশমা চোখে দিয়ে স্বাধীনতার অপব্যয় করে তবেই বিপদ। কারণ স্বাধীনতা মানে স্বেচ্ছাচারিতা কিংবা নগ্নতা নয়, স্বাধীনতা মানে আত্মবিশ্বাস-দৃঢ়তার এক ধরনের সমন্বয়।’
নার্গিস আহমেদ তার দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় আরো এক দলের কথা বলেন। যারা বাংলাদেশে অভিজাত পরিবার থেকে নিউ ইয়র্কে আসে। তিনি তাদের কথা জানাতে বলেন, ‘বাংলাদেশের এক শ্রেণির অভিভাবকরা আছেন যারা পাত্র আমেরিকান শুনলেই গলে যান। সে কি করে, বয়স কত- এসব ধার ধারে না। পাত্র হয়তো বললো সে ইঞ্জিনিয়ার। পাত্রীপক্ষ কোনো কিছু খোঁজ না নিয়ে তাতেই বিশ্বাস করে। এখানে এসে মেয়েটা জানতে পারে তার স্বামী কোনো অড জব করছে। তখন তার স্বপ্নভঙ্গ হয়। মেয়েটা মানিয়ে নিতে পারে না। এক সময় গ্রিন কার্ড হওয়ার পরে ওই মেয়েটা স্বাবলম্বী হয়ে ওঠে। তখন বাড়ে সংঘাত। তবে আমি বলবো বাঙালি সমাজে বিচ্ছেদের ঘটনা হাতেগোনা। বেশিরভাগ নারী ঘরে-বাইরে প্রচণ্ড পরিশ্রম করছে। কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনার জন্য সব নারীকে ঢালাওভাবে দোষারোপ করা ঠিক না।’