ইইএফ ফান্ড নিয়ে কানাডায় ‘পালিয়ে গেছেন’ মোশারফ-বুশরা দম্পতি
তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান উইন্ডমিল ইনফোটেক ও ওয়ান কল সলিউশনস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবিএম রিয়াজউদ্দিন মোশারফ এবং তার সহধর্মিণী ও একই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান বুশরা আলম বাংলাদেশ ব্যাংকের ইক্যুইটি অ্যান্ড এন্টারপ্রেনারশিপ (ইইএফ) ফান্ড, নিজ প্রতিষ্ঠানের পার্টনার এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির কাছ থেকে কয়েক কোটি টাকা নিয়ে কানাডায় পালিয়ে গেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। যদিও ওই দম্পতি দাবি করেছেন, তারা কানাডায় ঘুরতে এবং নতুন ভেঞ্চার চালু করতে গেছেন।
২৬ মে শুক্রবার তারা দেশ ছেড়েছেন। এর আগে এই দম্পতি যেন দেশের বাইরে যেতে না পারে ও তাদের গ্রেফতার করার জন্য ২৩ মে পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) ইমিগ্রেশন বিভাগে তেজগাঁও থানা থেকে চিঠি দেওয়া হয়। তবে এসবি’র ইমিগ্রেশন বিভাগ দাবি করছে, তারা চিঠি পেয়েছেন ২৭ মে। ফলে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি।
রিয়াজউদ্দিন মোশারফ ও বুশরা আলম কানাডায় পালিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন জানতে পেরে আগে থেকেই বিষয়টি তেজগাঁও থানায় অবহিত করেন তাদের পার্টনার সাব্বির রহমান তানিম। গত ২২ মে এই দম্পতির বিরুদ্ধে তেজগাঁও থানায় মামলা (মামলা নং ২৪) দায়ের করার পর দিনই তাদের বিদেশ গমন প্রতিরোধ করতে এসবি’র বিশেষ পুলিশ সুপার (ইমিগ্রেশন) বরাবর চিঠি দেন তেজগাঁও থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মোহাম্মদ সেন্টু মিয়াঁ।
চিঠিতে বলা হয়, ‘মামলার পলাতক আসামিরা কাওরান বাজারস্থ যৌথমূলধনী কোম্পানি ও ফার্মের কার্যালয়ে বাদী ও সাক্ষীদের সই ও স্বাক্ষর জালিয়াতি করে শেয়ার হস্তান্তর করেছে। আসামিরা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ সিলেট ও চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে বিদেশ পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। তাদের বিদেশ গমন প্রতিরোধ এবং গ্রেফতার করার জন্য অনুরোধ করা হলো।’
ওই চিঠিতে মামলার কপি ও তাদের দুইজনের আলাদা পাসপোর্টের কপি সংযুক্ত করা হয়। চিঠিতে জানানো হয়, প্রথম আসামি এবিএম রিয়াজউদ্দিন মোশারফের পাসপোর্ট নম্বর বিএ০৫৮৬৮৯৮ ও জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর ২৬৯৯৫০১৯০১৪৮৭ এবং দ্বিতীয় আসামি বুশরা আলমের পাসপোর্ট নম্বর এই৯১৬৩০৯৪ ও জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর ২৬৯৯৫০১৯০১৪৮৮।
তবে থানা, এসবি এবং ইমিগ্রেশনকে ফাঁকি দিয়ে গত ২৬ মে শুক্রবার রাতে তারা দেশ ছেড়েছেন। রোববার ফেসবুকে এক স্ট্যাটাসে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন কম্পিউটার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান টেকম্যানিয়ার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা তাসলিমা মিজি। তিনি নিজের পাওনা টাকা পাওয়ার জন্য নিউমার্কেট থানায় আরও একটি মামলা করেছেন এবং অর্থ প্রতারণা মামলার ওয়ারেন্ট নিয়ে পুলিশ বুশরার মায়ের বাসায় গেলে বুশরার মা হোসনে আরা আলম জানান, তারা ২৬ তারিখ রাতে কানাডায় চলে গেছেন।
এদিকে এবিএম রিয়াজউদ্দিন মোশারফ ও বুশরা আলম নিজেরাই কানাডায় চলে যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তাসলিমা মিজি ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ার পরপরই তারা ফেসবুকে পাল্টা স্ট্যাটাস (একই পোস্ট) দিয়েছেন। স্ট্যাটাসে তারা জানিয়েছেন, কানাডাতে ছুটি কাটাতে এবং সেখানে নতুন ভেঞ্চার চালুর বিষয়ে কাজ করতে গেছেন। দুইজনই তাদের স্ট্যাটাসে কানাডার আলবার্টার ক্যালগারিতে আছেন বলেও চেক-ইনে উল্লেখ করেছেন।
ইমেগ্রেশনের চোখ ফাঁকি দিয়ে প্রতারণা মামলার আসামি বিদেশ চলে যাওয়াতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন মামলার বাদী সাব্বির রহমান তানিম। তিনি বলেছেন, ‘আমরা তাদের কানাডায় চলে যাওয়ার প্রস্তুতি সম্পর্কে আগে থেকেই জানতে পেরেছিলাম। পুলিশকে বিষয়টি জানানোর পরেও তারা কীভাবে বিদেশে পালিয়ে গেল সেটা আমার বোধগম্য নয়।’
সাব্বির রহমান তানিম তার মামলার এজাহারে লিখেছেন, ‘মামলার আসামি এবং আমার সাক্ষী সাকিল জোয়াদ রহিম ওয়ানকল সলিউশনস লিমিটেড নামে একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। উক্ত কোম্পানিতে সাকিল পরিচালক হিসেবে চার হাজার শেয়ারের মালিক এবং এক নং আসামি এবিএম রিয়াজউদ্দিন মোশারফ ১২ হাজার শেয়ার ও দুই নম্বর আসামি বুশরা আলম চার হাজার শেয়ারের মালিক হিসেবে কোম্পানির ব্যবসা পরিচালনাকালে সাকিল উক্ত কোম্পানির শেয়ার বিক্রি করে কোম্পানির পরিচালক হিসেবে পদত্যাগ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। বিষয়টি আসামিদের জানানো হলে আসামিদের সম্মতিতে সাকিল চার হাজার শেয়ার আমার নিকট হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত নেয় এবং সেই অনুযায়ী শেয়ার হস্তান্তরের যাবতীয় কাগজপত্র ২০১৩ সালের ১০ সেপ্টেম্বর স্বাক্ষরিত হয়। উক্ত শেয়ারের মূল্য হিসেবে নগদ ১০ লাখ টাকা আসামিদের দেওয়া হয়। ছয়টি ভিন্ন চেকে দেওয়া হয় আরও ২০ লাখ টাকা। আসামিদের বার্ষিক বোর্ড সভা ও বার্ষিক সাধারণ সভা করার কথা বললে তারা নানান কারণে কালক্ষেপণ করে। ব্যস্ততার কারণে এ বিষয়ে কোনো খোঁজ না নিলেও গত ১৭ মে জয়েন স্টক কোম্পানিতে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, আসামিগণ প্রতারণার উদ্দেশ্যে শেয়ার হস্তান্তরের কাগজপত্র দাখিল করে নাই এবং শেয়ার হস্তান্তর না করেই আমার ও সাকিলের সম্মতি না নিয়ে সাকিলকে পরিচালক এবং ইইএফ ডিভিশনের (কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তত্ত্বাবধানে ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ বা আইসিবি) পক্ষে প্রোগ্রামিং বিভাগের সিস্টেম অ্যানালিস্ট মাহবুবুর রহমানকে ২০১৪ সালের ২ মার্চ নমিনি পরিচালক নিয়োগ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের ইইএফ ফান্ডের চার কোটি টাকা ঋণ প্রসেস করে এর মঞ্জুরিপত্র গ্রহণ করে। জয়েন স্টকে জমা দেওয়া কাগজপত্রে আমি বা সাকিল কোনো স্বাক্ষর করি নাই এবং সম্পূর্ণ জালিয়াতি ও প্রতারণামূলক জাল স্বাক্ষর করে ও ভুয়া কাগজপত্র আসামিগণ দাখিল করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ইইএফ ফান্ডের প্রথম কিস্তির ৯৬ লাখ টাকা ইতোমধ্যেই উত্তোলন করেছেন। আসামি কর্তৃক পরিচালিত ওয়ানকল সলিউশনস লিমিটেড নামের কোম্পানিটির কোনো ব্যবসায়িক কার্যক্রম বর্তমানে চালু নেই এবং আসামিগণ প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিপুল পরিমাণ টাকা আত্মসাত করে বিদেশে চলে গেলে একদিকে যেমন সরকার আর্থিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হবে। অন্যদিকে এই ঋণের সাথে কোনোভাবে সংশ্লিষ্ট না থেকেও এর দায়িত্ব আমাকে বহন করতে হতে পারে। এ বিষয়ে গত ৭ মে আমার আইনজীবীর মাধ্যমে রেজিস্ট্রিকৃত ডাকযোগে আসামিদের লিগ্যাল নোটিশ প্রেরণ করেছি।’
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে আসামিরা ওয়ানকল সলিউশনস লিমিটেড, উইন্ডমিল ইনফোটেক লিমিটেড, বেবিটিকা, দেশিফুল নামের কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও উদ্যোগ পরিচালনা করেছে। আর বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) সদস্য এবিএম রিয়াজউদ্দিন মোশারফ এর আগে বেসিসের পরিচালক পদে নির্বাচনও করেছিলেন।
এ বিষয়ে জানতে পুলিশের এসবি’র ইমিগ্রেশন বিভাগের পুলিশ সুপার ফারুকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, ‘সারা বাংলাদেশ থেকে আমার এখানে শতশত কাগজ আসে বলে একটি বিশেষ কাগজের কথা মনে রাখা সম্ভব না। আর চিঠি আমাদের কাছে প্রোপারওয়েতে আসতে হবে। একটি থানা থেকে যখন কোনো বিষয় উত্থাপন হয়, তখন এটা সংশ্লিষ্ট ডিসি অথবা জেলার এসপির মাধ্যমে আমার কাছে চিঠিগুলো আসে। আমরা চিঠি রিসিভ করার সাথে সাথেই সিস্টেমে আপ করে দেই। এখন ধরেন ২৩ তারিখের চিঠি আমার কাছে ২৭ তারিখে আসে তাহলে তো আমি এটা ধরতে পারব না।’ তিনি আরও বলেন, ‘অনেক সময় আমাদের কাছে আর্জেন্ট বা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যেমন বনানী ধর্ষণ ইস্যু বা এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ কিছু হলে আমরা তাৎক্ষণিক পাসপোর্ট স্টপ করে দিতে পারি।’