জিবরাইলের ডানার অধ্যাপক শাহেদ আলী
এএইচএম হুমায়ুন মল্লিক।।
পঞ্চাশের দশকের সবচেয়ে আলোকিত ও আলোচিত ছোট গল্প জিবরাইলের ডানা,যেটা সবার মনে সাড়া জাগিয়ে ছিল,যারা পড়েছেন তাদের মনে রেখাপাত করে আছে এখনো,সেই গল্পের লেখক এবং সুনামগঞ্জের আলোচিত ভাষাসৈনিকদের একজন অধ্যাপক শাহেদ আলী,যিনি শুধু বাংলা সাহিত্যের একজন অমর কথা শিল্পীই ছিলেন না,তিনি ছিলেন একজন সৃজনশীল অনুবাদ-সাহিত্যিক এবং আমাদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গদ্য লেখক।
বৃটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের শেষ পর্যায়ে পাকিস্তান আন্দোলনের তিনি ছিলেন অন্যতম অগ্রগামী সৈনিক। তিনি পত্রিকা সম্পাদনা শুরু করেন বৃটিশ আমলে। পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলে আমাদের সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠান তাঁর অকৃপন অবদানে হয়েছে সমৃদ্ধ। আজকের দিনের বহু লব্ধ-প্রতিষ্ঠ সাহিত্যিকের লেখালেখির হাতেখড়ি হয়েছে তাঁর হাতে। ভাষা আন্দোলন ও তমদ্দিন মজলিশের অন্যতম নেতা শাহেদ আলী ছিলেন এদেশের অগনিত সংস্কৃতি-কর্মীর প্রেরণার উৎস।
১৯৫৪সালের সাধারণ নির্বাচনের প্রায় শূন্য হস্তে মুসলিম লীগ ও যুক্তফ্রন্টের বিরুদ্ধে ত্রিমুখী নির্বাচনী যুদ্ধে তাঁর সাড়া জাগানো ঐতিহাসিক বিজয় প্রমান করে,এদেশের গ্রামীণ জনগন শুধু তাঁর ছোট গল্পেই স্থায়ী আসন লাভ করেনি,শাহেদ আলী নিজেও তাদের মনিকোঠায় স্থায়ী আসন করে নিয়েছিলেন। এই বহুমুখী প্রতিভাধর মানুষটি ব্যক্তিগত ভাবে কতবড় মহৎ মনের অধিকারী ছিলেন তা যারা তাঁর সান্নিধ্যে না গেছেন তারা বুঝতে পারবেন না। নির্বাচনে বিজয়ী হলেও রাজনীতির বাহিরে তিনি লেখক হিসাবেই বেশি আলোকিত ছিলেন। তাঁর লেখায় ফুটে উঠেছে গ্রাম বাংলার মানূষের সুখ দুখের কথা। ইসলাম,মুসলমান এবং বাংলাদেশি মুসলমান এই তিনটি বিষয়ে তিনি তাঁর আদর্শ থেকে আজীবন একচুলও নড়েননি।
মুসলমানের ঘরে জন্ম নিয়ে কাকতালীয় ভাবে তিনি ইসলামের অনুরক্ত হয়ে পড়েননি। তাঁর ইসলামপ্রীতি ছিল গভীর অধ্যয়ন,চিন্তা ও সহজাত ভালোবাসার একটি অপরিহার্য পরিণাম। ইসলামের খেদমত করাটিকে তিনি জীবনের পেশা ও নেশা হিসাবে বেছে নিয়ে ছিলেন এর ভিতর কোন বাণিজ্যিক বা আর্থিক সুবিধা সংলগ্ন ছিলনা। সারাজীবন একজন স্বল্প বেতনভোগী মধ্যবিত্ত মানুষ হিসাবে তাঁর চিন্তা ও কর্মের বিস্তার ঘটিয়েছেন,নিজের আদর্শ থেকে একচুলও নড়েননি। তিনি ছিলেন অতি স্বল্পভাষী,কথা কম বলতেন,সারাক্ষণ যেন কিছু চিন্তা নিয়ে থাকতেন যা তাঁর লেখনিতে বের হয়ে আসত।
তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ জিবরাইলের ডানা যখন প্রকাশিত হয় তখন তিনি প্রচুর প্রশান্তি পান আর সেখানে ফুটিয়ে তুলেন দরিদ্র ঘরের একটি সন্তানের আশা ও আশ্বাসের। তাঁর মনে কোন ক্ষোভ ছিলনা,ছিল সবাইকে আপন করে নেওয়ার এক কোমল মন,যেটা আমি নিজে দেখেছি,আমার সৌভাগ্য হয়েছিল এই মানুষটির সঙ্গ পাওয়ার। জিবরাইলের ডানা গল্প দিয়ে তিনি সাহিত্যে স্থায়ী আসন পেয়েছেন। এই জিবরাইলের ডানা নিয়ে বিশ্বখ্যাত অনেক পরিচালক ছবি করার চেষ্টা করেছেন কিন্তু কোথায়ও কোন সমস্যা ছিল বিধায় তা আর হয়ে উঠেনি তবে এ নিয়ে তাঁর কোন আক্ষেপ ছিলনা।
তাঁর প্রিয় রঙ ছিল নীল তাই গল্পের নায়িকাকেও তিনি নীল রঙ এ রঙ্গিন করে তুলেছেন বিভিন্ন গল্পে। ১৯৪০ সালে তিনি যখন স্কুলের ছাত্র তখন তাঁর প্রথম গল্প অশ্রু প্রকাশিত হয় সেকালের প্রথম শ্রেনীর পত্রিকা মাসিক সওগাত-এ। তিনি প্রায় পঞ্চাশখানি গ্রন্থের লেখক,তার মধ্যে জিবরাইলের ডানা (১৯৫৩),একই সমতলে (১৯৬৩),পোড়ামাটির গন্ধ (১৯৮৭), শা’নজর (১৯৮৬), অতীত রাতের কাহিনী (১৯৮৬), অমর কাহিনী (১৯৮৭), বাংলা সাহিত্যের অমর সৃষ্টি। এছাড়া তাঁর উপন্যাস হৃদয় নদী (১৯৮৫) এবং নাটিকা বিচার (১৯৮৫) ও উল্লেখযোগ্য।
মানবতা ছিল শাহেদ আলীর গল্পের মুল সুর, অসহায় ও অবলম্বনহীন মানুষের বেদনার কথা অতি সরল ভাষায় তিনি তাঁর গল্পে অভিব্যক্ত করেছেন। এছাড়াও বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যও তাঁর রচনার সমৃদ্ধ। ‘বাংলা সাহিত্যের চট্রগ্রামের অবদান’ ‘তাওহীদ’ ইত্যাদি প্রবন্ধে তথ্য ও তত্ত্ব সমৃদ্ধির সঙ্গে তাঁর রসবোধের সম্মিলন ঘটেছে। ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক আল কোরআনের অনুবাদ সংঘেরও তিনি সদস্য ছিলেন। অধ্যাপক শাহেদ আলী তাঁর কীর্তির স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলা একাডেমী (১৯৬৪),একুশে পদক (১৯৮৯) ও মাতৃভাষাপদক (১৯৮১), সিলেট লায়ন ক্লাব পদক (১৯৮৫), ইসলামিক ফাউন্ডেশন পদক (১৯৮৬)সহ দেশে বিদেশে বহু পুরস্কার পেয়েছেন। তাঁর জিবরাইলের ডানা উর্দু,হিন্দি,ইংরেজী ও রাশিয়ান ভাষায় অনুদিত হয়েছে।
১৯৯৮ সালে নন্দিত কথা শিল্পী শাহেদ আলীকে আমি দেখেছি একজন সহজ সরল উষ্ণ হৃদয়ের মানুষ হিসাবে। এই কৃতি মানুষটি ১৯২৫ খ্রীস্টাব্দের ২৬মে বর্তমান সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর উপজেলায় মাহমুদপুর গ্রামে জন্মগ্রহন করেন,তার পিতার নাম মৌলভী ইসমাইল এবং মাতার নাম আয়েশা খাতুন। তিনি বিয়ে করেন ১৯৫৯ সালে চট্রগ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে চেমন আরা কে,বিয়ে করার সময় তখন চেমন আরা পড়ালেখা শেষ করেননি,পড়ে স্বামীর সহযোগিতায় এমএ সম্পন্ন করে অধ্যাপনায় যোগ দেন,তার নিজের লিখা অনেকগুলো বই বের হয়েছে। এই গুনী মানুষটির শিক্ষাজীবনের শুরু নিজের গ্রামের স্কুলে পরে সুনামগঞ্জ সরকারি জুবিলি উচ্চবিদ্যালয় থেকে ১৯৪৩ খ্রীস্টাব্দে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। সিলেট এমসি কলেজ থেকে ১৯৪৭ খ্রীস্টাব্দে ব্যাচেলার ডিগ্রি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫০ খ্রীস্টাব্দে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন। কর্মজীবনে ১৯৫১ খ্রীস্টাব্দে বগুড়া আজিজুল হক কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। এরপর থেকে ১৯৫৪ পর্যন্ত মিরপুর বাংলা কলেজ, রংপুর কারমাইকেল কলেজ ও চট্টগ্রাম সিটি কলেজে অধ্যাপনা। ১৯৫৪ সালের পর বেশ কিছুদিন তিনি রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন,তিনি খেলাফতে রব্বানী পার্টির সেক্রেটারী জেনারেল ছিলেন,১৯৫৬-৫৮ পর্যন্ত। ইসলামী বিশ্বকোষের সম্পাদনা বোর্ডেরও সদস্য ছিলেন। অধ্যাপক শাহেদ আলী বিভিন্ন বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। ১৯৪৮-৫২-এর ভাষা আন্দোলনের সার্বিক কার্যক্রমে জড়িত ছিলেন। রাষ্ট্রভাষা হবে বাংলা সেই লক্ষে তারা ১৯৪৮ সালের ১লা সেপ্টেম্বর তমদ্দিন মজলিস গঠন করেন,সেখান থেকে তারা ভাষা নিয়ে কাজ করেন এবং তিনি তমুদ্দন মজলিসের সাধারণ সম্পাদক ও পরে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। সাংবাদিকতায় ছিল তাঁর অগাধ বিচরন,সাপ্তাহিক সৈনিক এ