অর্থমন্ত্রীর ছেলেমানুষি জেদ ও বাস্তবত
হাসান হামিদ
আগে একটা গল্প বলে নিই।
এক দেশের সংসদ অধিবেশনে একজন সরকারি এমপি তার বক্তৃতার সময় এক গল্প বলছিলেন, “এক বাবা তার তিন ছেলেকে ১০০ টাকা করে দিয়ে বলল যে, এমন কিছু কিনে আনো; যাতে ঘরটা পুরো ভর্তি হয়ে যায। ১ম ছেলে ১০০ টাকার খড় কিনে আনল, কিন্তু ঘর পুরোপুরি ভর্তি করতে পারল না। ২য় ছেলে ১০০ টাকার তুলা কিনে আনল কিন্তু সেও পুরোপুরি ভর্তি করতে পারল না। ৩য় ছেলে ৫ টাকা দিয়ে একটা মোমবাতি কিনে আনল এবং রুমের মাঝে জ্বালাল। এতে পুরো ঘর সম্পূর্ণ আলোতে ভর্তি হয়ে গেলো”। এমপি আরও বলতে লাগলেন, “আমাদের অর্থমন্ত্রী হচ্ছেন ৩য় ছেলের মতো। যেদিন থেকে তিনি দায়িত্ব নিয়েছেন, এই দেশ উন্নতির আলোতে পূর্ণ হয়ে গিয়েছে।” ঠিক তখনই পিছন থেকে বিরোধী দলের এক এমপির আওয়াজ আসলো, “সেটা তো ঠিক আছে, কিন্তু বাকি ৯৫ টাকা কই গেলো?”
দেশে যখন ব্যাংকগুলো থেকে কোটি কোটি ডলার লোপাটের ঘটনা ঘটছে, বিদেশে পাচার হচ্ছে আমাদের দেশের টাকা, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে অলস ঋণের পরিমাণ অতিমাত্রায় বেশি; তখন আমাদের গুণী অর্থমন্ত্রী এসব বাদ দিয়ে চোখ দিয়েছেন মধ্যবিত্তের ঘামের সৌরভ মেশানো টাকায়। কিন্তু এতো যে দুর্নীতি আর লুটপাট হচ্ছে অর্থের, সেসব কি দেখার কেউ নেই? তাহলে কি আমরা এটাই জানবো যে, আমাদের রাজনীতিবিদগণ এ দেশটাকে তামাশা আর নাটকের মঞ্চ বানিয়ে ছাড়ছেন। আমরা কি এটাই জানবো যে, ভিন্ন পথেই এখানে সফলতা আসে নোংরামি ঢেকে আর নাটকীয় বাহবা পায়! এদেশে এই মুহূর্তে সরকার দলীয় সবার বক্তব্যে উন্নয়নের আলো ছড়ানো গল্পের আড়ালে তাহলে হচ্ছেটা কী?
বাজেট ঘোষণার পর যখন সব দিক থেকে বলা হচ্ছে, জনসাধারণ এটা ভালো ভাবে নেয়নি, এই বাজেট নামের দিন দুপুরে ডাকাতিকে মেনে নিচ্ছে না জনগণ; তখন এসব শুনে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, “আবগারি শুল্ক কমানোর সুযোগ নেই, ১৫ শতাংশ ভ্যাট কোনভাবেই কমানো হবে না। কারণ ২০১২ সাল থেকে এ বিষয়টি ঝুঁলে আছে। গত বছর তা বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করেছিলাম, হয়নি। কিন্তু এবার কোন ভাবেই ভ্যাটের হার কমানো হবে না”। ব্যাপক সমালোচনার মুখে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, “ব্যাংকে যাদের ১ লাখ টাকা আছে তারা সম্পদশালী”। অথচ এই অর্থমন্ত্রী হলমার্কের ঘটনার সময় বলেছিলেন, “সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা কোনো টাকাই না !”
আমরা সারা মাস কষ্ট করে পাওয়া বেতন থেকে আয়কর দেব। তারপর আবার খেয়ে না খেয়ে ব্যাংকে টাকা রেখে যখন সেটা বাড়বে একটু, তখন সেখান থেকেও উচ্চ হারে কর কেটে নেবে সরকার। কিন্তু কেনো? আর এ কারণেই কিছুদিন যাবত বাজেটে প্রস্তাবিত আবগারি শুল্ক ও সারচার্জ নিয়ে সারাদেশে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। আবগারি শুল্ক ও সারচার্জ প্রত্যাহার করা দরকার বলে মন্তব্য করেছেন ১৪ দলের নেতারাও। সরকার দলের অনেকেই অর্থমন্ত্রীকে জেদ না করতে বলছেন। এসবের মানে কী?
আমরা এটা বুঝি, রাজনীতিবিদদের কাছে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত অনেকটা বাধিত। এটি এ কারণে যে, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল ও সেখানে তহবিলের অপর্যাপ্ততা রয়েছে। রাজনীতিবিদদের নিয়ন্ত্রণে রাখার মতো কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা সাধারণ তিনটি সুরক্ষাকবচ অর্থাৎ টেকনোক্র্যাট, নিরীক্ষক, আদালতের নেই। বাংলাদেশের কর বনাম জিডিপি অনুপাত দুনিয়ার অন্যতম কম; ১০ শতাংশেরও কম। অবকাঠামোগত অবয়বের ফলে আয়কর আদায়ে বিঘ্ন ঘটে। করপোরেশনের ওপর অসংখ্য ধরনের কর রয়েছে। কিন্তু কাউকে ঘুষ দিয়ে ওই কর প্রদান থেকে বিরত থাকা খুব সহজ। আমদানির ওপর মাত্রাতিরিক্ত করারোপ করার অন্যতম কারণও এটি। এ বিষয়টিই আবার আয়কর দেয়া থেকে বিরত থাকতে আমদানিকারকদের উৎসাহ জোগায়। আছে আর্থিক সংকটের লক্ষণ।
অর্থমন্ত্রী কি এটা জানেন না যে, বাংলাদেশের মতো দেশ থেকে রাষ্ট্রীয় সম্পদ যারা লুট করে, তারা চায় না যে, এই অর্থই আবার অন্য কেউ নিয়ে যাক, বা সরকার বাজেয়াপ্ত করুক। তাই তারা এ টাকা বিদেশে পাচার করে। স্থানীয় কর আদায়কারীদের নজর থেকে অনেক দূরে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় লুটের অর্থ। যেসব দেশে টাকা রাখার স্বচ্ছতা নেই বা করও কম, সেসব দেশেই টাকা বেশি পাঠানো হয়। আবার বিদেশি উন্নয়ন সাহায্য হিসেবে বাংলাদেশের প্রাপ্ত অর্থের ৩.৫ গুণ পাচার হয়! অর্থমন্ত্রীর চোখ চশমার ফাঁক দিয়ে তিলে তিলে জমানো ১ লাখ টাকা দেখে; চুরি করা, লুটপাট করা কোটি টাকা দেখে না। তারউপর রাবিশ বলে বলে লাগামহীন বক্তব্য দিয়ে চলে অবিবেচনাপূর্ন মুখ।
২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে ভোক্তা, সাধারণ মানুষ, ব্যবসায়ী, বিনিয়োগকারী ও ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারীসহ বিভিন্ন পেশার কেউ খুশি নন। প্রস্তাবিত বাজেট অনেকটা মধ্যবিত্তের উপর নির্ভরশীল। সরকারের আয়-ব্যয়ের পুরোটার মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের উপর নির্ভর করছে। প্রস্তাবিত বাজটে সহজে আদায় করা যায় এমন খাত বাড়ানো হয়েছে। ব্যাংকে টাকা রাখায় এবং বিমানের টিকিট কেনায় কর বাড়ানো হয়েছে। অথচ কর না দিয়ে যারা বিদেশে টাকা পাচার করেন তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার কথা নেই বাজেটে। সীমিত ও স্বল্প আয়ের মানুষের সঞ্চয়ের উপর অতিরিক্ত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ করের বোঝা চাপানো হয়েছে। এটি একদিকে বৈষম্যমূলক, অন্যদিকে রাজস্ব আয়ের একটি ভঙুর পদ্ধতি। তাছাড়া ১৫ শতাংশ ভ্যাট ও নতুন আইন বাস্তবায়ন হলে দেশের উৎপাদনশীল শিল্প ও সমস্ত ছোট কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হবে। অর্থমন্ত্রী তার বাজেটে অনেক দূর যাওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছেন। কিন্তু এ স্বপ্ন বাস্তবায়নের সক্ষমতার যথেষ্ট কমতি রয়েছে।
আর জনগণ যেটা চায় না, অথবা চায়; সেটাকে নাক সিটকিয়ে মন্ত্রী যদি পার পেয়ে যাবেন ভেবে থাকেন, তবে তা ভুল। অর্থমন্ত্রীর বোঝা উচিত যে, এই জনগণ চেয়েছে বলেই তিনি আজ অর্থমন্ত্রী। জনগণ না চাইলে তিনি সামান্য চাকুরে বা আলু পটলের ব্যবসায়ী হতেন। আর সেই জনগণের চাওয়াকে তিনি মূল্যায়ন না করার দুঃসাহস দিখেয়েছেন। কিন্তু আমাদের দেশের রাজনীতি কিন্তু নির্বাচন আর ভোটের, এটা ভুলে গেলে মনের আসনের পর ক্ষমতার আসন থেকেও একসময় সড়িয়ে দেবে জনগণ। রাজনীতিবিদদের বলবো, মিথ্যা আর লাগামহীন বক্তব্য এবং অপরকে আক্রমণ করার নীচু মানসিকতা যদি বাদ দিয়ে আস্তে পারেন মঞ্চে, তবেই ইতিহাস আপনার পক্ষে থাকবে; নইলে কিছুতেই লাভ হবে না।
শুরু করেছিলাম গল্প দিয়ে। শেষটাও করছি গল্প দিয়ে।
নির্বাচন বিষয়ে কথা হচ্ছে দলের দুই কর্মীর মধ্যে; একজন বলছে, “নির্বাচন আমাদের দল জিততে হলে মাত্র পাঁচ টাকা ইনভেস্ট করলেই চলে”। অপরজন জিজ্ঞেস করল, “কি রকম?” প্রথমজন বলল, “পাঁচ টাকা দিয়ে একটা স্কচটেপ কিনলেই হল। তারপর আমাদের নেতার মুখে মারলেই হল। ওনার মুখটা বন্ধ রাখলেই আমাদের নিশ্চিত জয়”।
(লেখক- গবেষক ও সদস্য, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র)