আর কে চৌধুরী, মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ:- ফিলিস্তিনে ইসরাইলি বর্বরতায় স্তম্ভিত বিশে^র সব বিবেকবান মানুষ। মঙ্গলবার গাজার এক হাসপাতালের ওপর হামলা চালিয়ে তারা হত্যা করেছে পাঁচশর বেশি মানুষ। যাদের বড় অংশই নারী ও শিশু। গাজা উপত্যকায় হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ নিয়ে নিজেদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে ইসরাইল সরকার। এরই মধ্যে তিন ধাপের যুদ্ধ পরিকল্পনাও নির্ধারণ করা হয়েছে। এই তিন ধাপ যুদ্ধের উদ্দেশ্য গাজায় একটি ‘নতুন নিরাপত্তা শাসনব্যবস্থা’ প্রতিষ্ঠা করা। শুক্রবার ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ত এই পরিকল্পনা প্রকাশ করেছেন। খবর টাইমস অব ইসরাইলের।

ইয়োভ গ্যালান্ত জানান, গাজায় হামাসের সরকারব্যবস্থা, সামরিক সক্ষমতা ধ্বংস করতে তিন ধাপে যুদ্ধ পরিচালনা করা হবে। এর মধ্যে দিয়ে হামাসকে নির্মূল করা হবে। যুদ্ধের যে বর্তমান ও প্রথম ধাপ চলছে, সেখানে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে হামাসকে নিরস্ত্রীকরণ ও তাদের অবকাঠামোকে ধ্বংস করা হবে। তিনি জানান, পরবর্তী ধাপগুলো কয়েক দিন, কয়েক সপ্তাহ বা কয়েক মাসে শেষ হয়ে যাবে এমনটি ভাবা যাবে না। তবে এই তিন ধাপ যুদ্ধের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো-‘এই অঞ্চলে (গাজায়) একটি নতুন নিরাপত্তা শাসনব্যবস্থা গঠন করে গাজার ওপর ইসরাইলের দায়বদ্ধতা অপসারণ করা।’ গ্যালান্ত বলেন, ‘গাজায় সামরিক অভিযান ইসরাইলের নাগরিকদের জন্য একটি নতুন নিরাপত্তা বাস্তবতা প্রতিস্থাপন করবে।’

এদিকে গাজায় ইসরাইলি হামলা আরও বাড়ানোর হুমকি দিয়েছে দেশটির প্রতিরক্ষা বাহিনী। আসন্ন স্থল অভিযানের লক্ষ্যে আরও সুযোগ তৈরি করতে ইসরাইলি বাহিনী এ হামলা চালাবে বলে জানিয়েছে। ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর মুখপাত্র জানিয়েছেন, রোববার থেকেই এ হামলা শুরু হবে। এ বিষয়ে ইসরাইলি সশস্ত্র বাহিনীর মুখপাত্র রিয়ার অ্যাডমিরাল দানিয়েল হ্যাগারি শিগগিরই হামলা শুরু হবে উল্লেখ করে বলেন, ‘নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থে আপনারা (ফিলিস্তিনিরা) গাজার দক্ষিণাঞ্চলে সরে যান। আমরা গাজা শহরে আক্রমণ চালাতেই থাকব এবং এই আক্রমণ ক্রমেই বাড়বে।’

গত ৭ অক্টোবর ইসরাইলে প্রবেশ করে নজিরবিহীন হামলা চালায় ফিলিস্তিনির স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাস। হামাসের হামলার পর পাল্টা হামলা চালায় ইসরাইল। তাদের হামলায় গাজার হাজার হাজার সাধারণ নাগরিকের মৃত্যু হয়। জাতিসংঘ বলছে, গাজায় বাস্তুচ্যুত হয়েছে প্রায় ১০ লাখ নাগরিক। হামাসের সেই হামলায় ইসরাইলে অন্তত ১৪০০ এর বেশি নাগরিক নিহত হন। আহত হন আরও অন্তত ৪ হাজার মানুষ। প্রতিক্রিয়ায় ইসরাইলি সশস্ত্র বাহিনীও গাজায় ব্যাপক বিমান হামলা শুরু করে। ইসরাইলি হামলায় গাজা ও পশ্চিম তীরে প্রাণহানি নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

গাজার দক্ষিণাঞ্চলের খান ইউনিসের শহরের ইউরোপিয়ান গাজা হাসপাতালের পরিচালক ইউসেফ আল-আক্কাদকে বলতে শোনা যায়, ‘এই শোকাহত ও নির্যাতিত মানুষদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চলার সময়ে মুক্ত বিশ্ব তুমি কোথায়?’ সরাসরি তিনি প্রশ্ন না ছুড়লেও এই শিশুদের কী দোষ ছিল, তাই যে তিনি বলতে চেয়েছেন এই আকুতিতে স্পষ্ট। এ সময় ইসরাইলের বোমাবর্ষণ বন্ধে আবেগঘন আকুতি জানাতে দেখা যায় তাকে। ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী সংগঠন হামাস ইসরাইলে আকস্মিক হামলা চালায়। এরপর ওই দিন থেকেই গাজায় বোমা হামলা অব্যাহত রেখেছে ইসরাইল। এতে নিহত হয়েছে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার ফিলিস্তিনি। এর এক-তৃতীয়াংশই শিশু। জানা গেছে, ইসরাইলি বাহিনীর চলমান হামলায় অনেক নবজাতকও নিহত হয়েছে।

ফিলিস্তিনের নিউজ এজেন্সি ওয়াফার খবরে বলা হয়, গত বুধবার ইসরাইলের বিমান হামলায় খান ইউনিস শহরের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত আল-বাকরির পরিবারে ভয়াবহ শোক নেমে আসে। ওই হামলায় সাত শিশুসহ অন্তত ৯ জন নিহত হয়েছে এই পরিবারে। অনেকে ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়েছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বুধবার ইসরাইলের হামলায় হতাহত পরিবারগুলোর একটি হলো আল-বাকরির পরিবার। এমন আরও অনেক পরিবারের সদস্যদের একসঙ্গে কেড়ে নিয়েছে সেদিনের হামলা। অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস নিউজ এজেন্সির খবরে বলা হয়, চিকিৎসক ও বাসিন্দারা এই হত্যার তথ্য নিশ্চিত করেছেন। এ হামলার খবর দ্রুত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ছড়িয়ে পড়ে। তবে ইসরাইলি বাহিনী এই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে তাৎক্ষণিক কোনো মন্তব্য করেনি। আবেগতাড়িত কণ্ঠে ইউসেফ আল-আক্কাদ আরও বলেন, এটি গণহত্যা। বিশ্ব এই শিশুদের লাশ দেখুক। ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার মোট বাসিন্দা ২৩ লাখ। এর প্রায় অর্ধেকই শিশু, যাদের বয়স ১৮ বছরের নিচে। বিগত ১৫ বছরে এই শিশুরা দেখেছে পাঁচটি যুদ্ধ। ২০০৮-০৯ সালে ২৩ দিনব্যাপী চলা যুদ্ধে নিহত হয় ৩৪১ জন, ২০১২ সালের যুদ্ধে নিহত হয় ৩৫ জন, ২০১৪ সালের যুদ্ধে ৫৩২ জন এবং ২০২১ সালের যুদ্ধে ৬৬ জন শিশু নিহত হয়। গাজায় দুই সপ্তাহ ধরে চলমান যুদ্ধে ফিলিস্তিনি শিশু নিহতের সংখ্যা ইতিমধ্যে দেড় হাজার ছাড়িয়েছে। বলা হচ্ছে, ২০০৮-০৯ সালের যুদ্ধে যে শিশুর বয়স ছিল দুই বছর, সে-ও এ পর্যন্ত পাঁচটি যুদ্ধের সাক্ষী হয়েছে। যুদ্ধের সাক্ষী হওয়া শিশুদের স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠা যেমন কঠিন, তেমনি যুদ্ধ শিশুদের মনে বড় ধরনের দাগ তৈরি করে বলেও ধারণা করা হয়।

গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের সোল এজেন্ট যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি প্রভৃতি পশ্চিমা দেশ হাসপাতালের ওপর ভয়াবহ বোমা বর্ষণে পাঁচশর বেশি মানুষের প্রাণহানির যুদ্ধাপরাধ সত্ত্বেও ইসরাইলের পক্ষ নিয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন স্বয়ং ইহুদিবাদীদের সঙ্গে সংহতি জানাতে ইসরাইলে গেছেন। হাসপাতালে ভয়ংকর ধরনের বোমা মেরে পাঁচশর বেশি মানুষের প্রাণ কেড়ে নেওয়ার দায় থেকে ইসরাইলিদের রেহাই দিতে তিনি বলেছেন, অন্য কেউ এ হামলা চালিয়েছে। লজ্জার মাথা খেয়ে ইসরাইলিরা হাসপাতালে বোমা হামলার দায় সরাসরি অস্বীকার করার সাহস না দেখালেও ইহুদি নামধারী নব্য নাৎসিদের পক্ষে মার্কিন প্রেসিডেন্ট যে সাফাই গেয়েছেন তা লজ্জাজনক। গাজায় ফিলিস্তিনিদের ওপর বর্বর হামলার সমর্থন জানাতে বুধবার ইসরাইল সফরে যান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। স্থানীয় সময় বেলা ১১টায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ইসরাইলে অবতরণ করেন। এরপর তিনি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে ব্রিফিংয়ে বাইডেন বলেন, গাজার আল-আহলি আল আরবি হাসপাতালে ইসরাইল নয়, অন্য কেউ হামলা চালিয়েছে।

এ সময় তিনি নেতানিয়াহুকে উদ্দেশ করে বলেন, আপনারা নন, মনে হচ্ছে অন্য কোনো দল গাজার হাসপাতালে মারাত্মক বোমা হামলা চালিয়েছে। বাইডেন অবশ্য গাজার হাসপাতালে বিস্ফোরণের ঘটনায় গভীরভাবে দুঃখিত এবং ক্ষুব্ধ হওয়ার কথাও বলেছেন! নেতানিয়াহুকে বলেছেন, আমি যা দেখেছি তার ওপর ভিত্তি করে মনে হচ্ছে, এ কাজ অন্য কোনো দল করেছে, আপনারা নন। সাংবাদিকদের উদ্দেশে বাইডেন বলেছেন, ইসরাইলে হামাসের হামলায় মার্কিন নাগরিক নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৩১ জনে দাঁড়িয়েছে। ইসরাইলের মানুষ এবং বিশে^র মানুষকে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান জানাতে তিনি ইসরাইলে গেছেন এমন দাবিও করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে যে দেশটির মাতামাতি বিশ^বাসীকে তটস্থ করে রাখে তাদের ইসরাইল নীতি মুখোশ খোলার জন্য যথেষ্ট বললে খুব একটা ভুল হবে না।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn