সেজুল হোসেন-

হাইস্কুলে ভর্তির কিছুদিনের মাথায় চানাচুর বিক্রেতার কাছে ছেঁড়া বইয়ের পাতায় একটা কবিতা আবিষ্কার করলাম

‘তুমি আমার লুকানো মুখ তুলে ধরলে বারান্দার আলোর কাছে
তোমার একটু ভয়ও করলো না।
মাঝখানের দিকে একটি লাইন ছিল এমন
বুকের ভিতর চোখ ডুবিয়ে পালিয়ে যাই, বুকের মধ্যে এত অসুখ
কথা বন্ধ, শব্দ বন্ধ, এখন’…

তখনো জানি না, এ কার কবিতা? চানাচুরের মশলা লাগানো তেল চিটচিটে অসমাপ্ত সেই কবিতাকে যত্নে পকেটে নিয়ে বাড়ি ফিরেছিলাম। বিকেলে স্কুল শেষে বাড়ি ফিরতে হতো লঞ্চে। সেদিন সকালে নামিয়ে দিয়ে উজানে চলে যাওয়া লঞ্চ বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যায় এসে নামলো। চলন্ত লঞ্চের পিছনে দাঁড়িয়ে বাতাসের আলতো আঁচে নিজের কৈশোর রচনা করতে করতে পিছনের পকেট থেকে বের করে আবারো পড়লাম সেই কবিতা। কোথায় গিয়ে শেষ হয়েছিলো কবিতাটি জানি না । প্রায় ৭ বছর পর। সিলেটের কাজির বাজারে কিছু দোকানের সন্ধান পাই যেখানে পুরনো বই কেজি দরে কিনতে পাওয়া যায়, বেঁচাও যায়। দেশ, কৃত্তিবাসের শুরুর দিকের সংখ্যা থেকে শুরু করে প্রায় সব সংখ্যা সেখান থেকে অল্প দামে কিনি। প্রতি ৬ দিন পর পর টাকা জমাই আর রিক্সা ভর্তি করে বই নিয়ে ফিরি। প্রতিটি সংখ্যায় নতুন নতুন কবি পেতাম, কবিতা পেতাম, যে কবিতাগুলোর সঙ্গে আরও অনেক বছর পরে তাদের বইয়ে, সমগ্রে দেখা হয়েছে। একদিন কাজির বাজারের পুরনো বইয়ের দোকানে আবিষ্কার করি প্রায় ছেঁড়া, নিউজপ্রিন্ট কাগজে লেটার প্রেসে ছাপা একটি ধূসর সবুজ রঙের বই ‘আমি কি রকমভাবে বেঁচে আছি’। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। নওরোজ সাহিত্য সম্ভার। গায়ের দাম ৩০ টাকা কিন্তু আমি কিনি ৬ টাকায়। রাতে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বোনের বাসায় স্টার মুভিজে এক দফা সিনেমা দেখে ধীরে ধীরে বইটি হাতে নিয়ে ভেজা কাপড়ে মুছি। পড়তে বসি। ভিতরের পেজগুলো অনেক নরম থাকায় এবং পৃষ্টায় পৃষ্টায় ফুটো থাকায় খুব সাবধানে নাড়তে হচ্ছিল। তখন একটি অভ্যেস ছিলো, কবিতার বই হলে চোখ বন্ধ করে মাঝখান থেকে যে কোনও ১টা পৃষ্টা খুলে যে কবিতা চোখের সামনে পড়তো সেটা দিয়েই পড়া শুরু করতাম। সেদিন কি যে ঘটলো, চোখ বন্ধ করে একটা পৃষ্টা খুলে যেই কবিতাটি পড়তে যাবো, শরীরের মধ্যে এক ঝলক বিদ্যুৎ প্রবাহিত হলো। চোখের সামনে সেই কবিতা। অসমাপ্ত সেই কবিতা। যে কবিতার রচয়িতার নাম জানতাম না বলে পুরো কবিতা পড়া হয়নি আর। লাফ দিয়ে উঠলাম। গোগ্রাসে গিললাম কবিতাটি। মনে হয়েছিলো শৈশবে হারিয়ে ফেলা বন্ধুকে খুঁজে পেয়েছি। কি যে ভালো লাগলো আমার। বলা বাহুল্য সুনীলের ‘আমি কি রকমভাবে বেঁচে আছি’র সূত্র ধরেই শত শত কবির নামের সঙ্গে কবিতার সঙ্গে পরিচয় ঘটতে লাগলো। একেকদিন একেক কবির নাম শুনি আর শিহরে উঠি। খুঁজি তার বই। পড়ি তার কবিতা। একেক কবির একেক ভঙ্গিমা, একেক কবির কবিতায় একেক রকম রূপ-রস-গন্ধ।

সেইসময় সিলেটের জিন্দাবাজারে বইপত্রে জীবনের প্রথম কোনও ঋষির সঙ্গে দেখা হয়। শহরের দালান-কোঠায়ও যে ঋষি বাস করেন জানা ছিল না। ধারণা ছিল এই পীর আউলিয়া বা ঋষি টাইপ মানুষেরা বনে, কিংবা একা কোনও খুপরি ঘরে থাকেন। কেউ তাদের জ্বালায় না, তারাও জ্বালায় না কাউকে। সেই ঋষি তার সামনের চেয়ারে বসতে বলেন। চা খাওয়ান। নিমকি খাওয়ান। সিঙ্গারা খাওয়ান। বই কেনার টাকা থাকতো না বলে কম দামে লিটল ম্যাগাজিন কিনে বাসায় ফিরি। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে প্রকাশিত অনেক লিটল ম্যাগাজিন জমতো সেখানে। সব ম্যাগাজিনে এই ঋষির কবিতা পড়ি আর চমকিত হই। কি স্মার্ট। কবিতায় একটি বর্ণও বাহুল্য মনে হয় না। একবার একটা কবিতা পড়লাম। ‘যেভাবে সংকট তৈরী আমি তার ব্যাখ্যা দিলে তুমি খুব অস্বস্থিতে থাকো, বুঝি তোমার মন ছিঁড়ে গেছে তেরো রকমের নোখে’। তখন কবিতার ভিতরে বুক ডুবানোর সাহস ততোটা না হলেও ঠিকই একটা সুর বেজে উঠতো বুকের মধ্যে। তারপর আরেকদিন কোথায় যেন তাঁর কবিতা পড়ি ‘গরিমা অক্ষুন্ন রেখে কি করে গো সাধ করি স্বজনীর প্রাণ’। পড়ি আর মুগ্ধ হই । তাঁর প্রতি, কবিতার প্রতি। এসব কবিতা নিয়ে কবিতার বইও হয়। বহুল প্রত্যাশিত সেই বইয়ের নাম রাখা হয়- ‘কথা ও হাড়ের বেদনা’। পড়ি আর পড়ি। কবি ইমদাদ ভাইয়ের কাছ থেকে রাত জেগে বোঝার চেষ্টা করি দীন ভাইয়ের স্বত্বাকে। তার কবিতার অন্তর্নিহিত শক্তিকে।

জিন্দাবাজারস্থ বইপত্রের একসময়ের অধিকারী সেই ঋষি মোস্তাক আহমাদ দীনকে দেখে, কবিতার প্রতি তার প্রেম ও সহবাস দেখে, এমন নির্লোভ, নিরহঙ্কার ও নরম স্বভাব দেখে, কবিতা যাপকদের সম্পর্কে যে উচ্চ ধারণা জন্মেছিল দেড় যুগ আগে, এখন এই ফেসবুক যুগে, কবিদের স্টান্টবাজি, আত্ম প্রচারণার তুমুল প্রতিযোগিতা, কাঁদাছুড়াছুড়ি আর ‘কে বেশি বড়’ বড় প্রমাণের মরিয়া লড়াই দেখে আমার শুধু দুঃখ হয়, আমার শুধু কষ্ট হয় আর আফসোস হয়। যখন দেখি কবিরা ঘোষণা দিয়ে সিন্ডিকেট চালায়, কবিতার ক্লাব করে, ৩ জনে ৪ জনে গ্রুপ। ফেসবুকে ঝগড়া, এ ওর মুখ দেখে না। দিন রাত পড়ে থাকে ফেসবুকে। আনফ্রেন্ড করে, ব্লক করে। কাকে স্বীকার করবে আর কাকে অস্বীকার করবে তা নিয়ে তুমুল চিন্তায় চুল সব পেকে যাচ্ছে, তখন আমি চুপিসারে মোস্তাক আহমাদ দীন ভাইয়ের ফেসবুক আইডিতে গিয়ে উঁকি দিয়ে দেখি- এতোগুলা বছরের পরও তাঁর প্রোফাইল পিক ফাঁকা, টাইমলাইনে নিজের লেখা একটা বর্ণও নাই।  বাংলাদেশের কোথায় পাবো আর এমন সত্যিকারের কবি। আপাদমস্তক কবি। জীবনে-মরনে কবি। আমি সেই কবির নিজেকে সস্তা করে না দেয়া ধৈর্য্যের কাছে মাথা নুয়ে বসে থাকতে চাই।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn