রুমানা জামানঃঃ-সুনামগঞ্জের ইতিহাসকে বহুমুখী প্রতিভায় যারা সমৃদ্ধ করেছেন তাদের একজন জনাব মুহাম্মদ আব্দুল হাই। তিনি ছিলেন আমার আব্বার আপন মামা। পারিবারিক ভাবে উনাকে আমার বাবা, চাচা কিংবা ফুফুরা “গোলাপ মামা” নামেই সম্বোধন করতেন। সে হিসাবে পারিবারক সূত্রে পাওয়া উনিও আমার “গোলাপ দাদা”। তিরাশি সালে উনি মারা গেলেন। আমার বয়স তখন আর কতো ছয় কিংবা সাত। একজন মানুষকে মূলয়ায়িত করার বয়স তখনো হয়নি। ছোট ছিলাম বলে উনার স্মৃতির সবটুকু আমার মননে বা মগজে তেমন নেই।

ছোট বেলা বিভিন্ন পারিবারিক আলাপচারিতায় উনার কথা শুনেছি এবং এখনো শুনি। দাদীর সাথে মাঝেমধ্যে উনার বাবার বাড়ী আরপিনগর তালুকদার বাড়ী যাওয়া হতো। দাদীর দুই ভাইয়ের ঘর ছিলো সামনে আর পিছনে। মাঝখানে এক চিলতে উঠান। দুই ঘরে দৌড়াদৌড়ি করতাম। ছোট ভাই গোলাপ দাদার ঘর সামনে বড় জনের ঘর পিছনে।

গোলাপ দাদা শক্ত সামর্থ্য ছিলেন। হঠাৎ করে চলে গেলেন। আমার দাদীর দুঃখবোধ ছিলো। যাদের চলে যাবার কথা পরে তারা চলে গেলেন আগে। ছোট দুই ভাইকে হারিয়ে দাদী বেশ ভেঙ্গে পড়েন। গোলাপ দাদা আর দাদী পিঠাপিঠি ছিলেন। দাদী ছিলেন দাদার ছোট ‘বুয়াই’ । দাদীর সাথে উনার সংযোগটা বেশী ছিলো।

 আমার দাদা চাকুরী সূত্রে বিভিন্ন শহরে কাটিয়েছেন। সেই সূত্রে দাদী দূরে চলেগেলে গোলাপ দাদা দাদীর সঙ্গ খুব মিস করতেন। প্রতি মাসে চিঠি লিখতেন। দাদীর পড়াশুনা তেমন ছিলো না। তের বছরে বিয়ে হয়ে যায়। বাড়ীর পাশের আরপিননগর মক্তব থেকে পঞ্চম শ্রেণী পাশ। দাদীর হাতের লেখা ছিলো অসাধারন। খুব সুন্দর করে লিখিতেন। ভাইয়ের প্রতিটি চিঠির উত্তর দিতেন খুব যত্নে।

 ৫২ সালের ভাষা অন্দোলনে দাদা জেল কাটেন। ৫৪ সালে আবার কারাবন্দী হলেন। ছিলেন ঢাকা জেলে। বিএ পরীক্ষার্থী। জেল থেকেও ‘বুয়াই’ এর কাছে চিঠি লিখতেন। দাদী সাহস যুগিয়ে উত্তর দিতে ভুল করতেন না। আদরের সেই ভাইয়ের আকস্মিক চলে যাওয়াটা ছিলো দাদীর কাছে খুব মর্মান্তিক। অবসর কিংবা অলস সময়ে দাদী ভাইয়ের স্মৃতি রোমন্থন করতেন। প্রায় সময় ভাইদের গল্প শুনাতেন।

মৃত্যুর কোন সিরিয়াল নেই এটা ঠিক তারপরও একটা অঘোষিত নিয়ম থাকে। পরিবারে যিনি আগে আসেন তিনি আগেই যান। দাদীর ভাইদের বেলায় হয় তার উল্টো। তিন ভাইয়ের সব ছোট দুই ভাই আগে চলে গেলেন। দাদীর সব ছোট ভাইকে কলেজে পড়াকালীন সময়ে নিজের কাছে নিয়ে আসেন। মাত্র কুড়ি বছর বয়সে তিনি পরলোকে পাড়ি জমালেন। উনার মৃত্যুটা ছিলো অবাক করা। তারপর চলে গেলেন গোলাপ দাদা। গোলাপ দাদার চলে যাওয়াটা দাদীর কাছে ছিলো মরার উপর খাড়ার ঘা। দাদী খুব বেশী চিন্তা করতেন দাদার রেখে যাওয়া ছোটছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে।

‘গোলাপ দাদা’র শেষ দিনগুলোর মাত্র কয়েকটা বছর কিংবা মাস তাকে আমার দেখার সুভাগ্য হয়েছে। কচি মনের দৃশ্যপটে যতটুকু মনে আছে এইটুকুই আমার স্মৃতি। দাদার বৈশিষ্ট ছিলো এমনি, ক্লিন সেভ। মাথাভর্তি কাঁধসম আধপাকা চুল। স্বল্পভাষী,গুরুগম্ভীর,রাশভারী স্বভাব। চালচলনে আভিজাত্যের ছাপ। আমার আব্বাকে মাঝেমধ্যে এই রকম দেখতাম। দাদার স্বভাবটা ভাগিনা হিসাবে তার চালচলনে হয়তো কিছুটা প্রভাব ফেলেছিলো। দাদী আব্বার হাবভাব দেখে মাঝেমধ্যে বলতেন ‘এতো দেখি গোলাপ মিয়ার খাসলত পাইছে।“

গোলাপ দাদাকে দেখলে শ্রদ্ধাবোধ জেগে উঠতো। পোশাক আশাকে ছিলেন ফ্যাশন সচেতন। সব সময় ইস্ত্রী দেয়া সফেদ পায়জামা-পাঞ্জাবী পড়তেন। এই পোশাক ছাড়া অন্য কোন পোশাক তাকে পড়তে কখনো দেখেছি মনে হয় না। ঘরোয়া পোশাকে উনাকে এভাবেই দেখেছি। ছাত্রাবস্থায় খুব মেধাবী এবং প্রতিভাবান ছিলেন শুনেছি। জন্মের পর আমি যখন তাকে চিনেছি তখন উনাকে আমার কাছে একজন ভাবুক মনে হয়েছে। শেষ দিকে উনি অনেকটা আনমনা হয়ে গিয়েছিলেন।  কেউ তাই ঘাটাঘাটি করতেন না।

গোলাপ দাদার ঘরের পরিবেশটা ছিলো অন্য রকম। আরপিননগর দাদীর বাড়িতে গেলে দাদা’র ঘরে যাবার লোভ সামলাতে পাড়তাম না। মাঝেমাঝে উঁকি দিতাম। দাদা’র ঘরের বেশীটা জায়গা জুড়ে ছিলো বই আর বই। মনে হতো বৃহদাকার একটা লাইব্রেরী। সামনের ডয়িং রুমে যতোটুকু জায়গা আছে পুরোটা দখল করে আছে বিচিত্র বই। ছাদ ছোঁয়া কাঠের শেলফ ভর্তি স্তরে স্তরে সাজানো মূল্যবান দুঃস্প্রাপ্য বই দেখে শিশু মনের কৌতুহল নিয়ে অবাক দৃষ্টিতে থাকিয়ে দেখতাম। বিরাট বুকশেলফের কাছে দাড়িয়ে ভাঙ্গাভাঙ্গা উচ্চারণে সযত্নে সাজানো উনার সংগৃহীত বই গুলোর নাম পড়তাম।

সুনামাগঞ্জ শহরের বনেদি পরিবারের ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ ছিলেন আব্দুল হাই দাদা। বিভিন্ন জনের কাছ থেকে তার বহুমাত্রিক প্রতিভার কথা শুনেছি। উনার মেধা ও প্রতিভার কথা শুনে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে।

তিনি নাকি ১৯৪০ সালে মাত্র সাড়ে এগারো বছর বয়সে আরপিননগরস্থ কেবি মিয়া মক্তব থেকে প্রাথমিক বৃত্তি পরিক্ষায় অংশ গ্রহন করে সমগ্র আসামে প্রথম স্থান অধিকার করেন। আবার ১৯৪৮ সালে সরকারী জুবিলী হাইস্কুল থেকে প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পরিক্ষা পাশ করেন। ১৯৫১ সালে তিনি সুনামগঞ্জ কলেজ থেকে আইএ পাশ করেন। ১৯৫৪ সালে দেশে ১৯২ (ক) ধারা জারী হলে রাজনৈতিক কারনে বন্দী হলেন। অবাক হই জেনে  যে, জেল বন্দী থেকে ও আব্দুল হাই দাদা বিএ পরীক্ষা দিয়ে ডিস্টিংশন সহ কৃতিত্বের সাথে পাশ করেন। এরকম প্রতিভাবান, নানা গুন সম্পন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক চিন্তা ধারার মানুষ আজ সত্যি বিরল।

গোলাপ দাদা সুনামগঞ্জের পত্রিকা আর সাংস্কৃতিতে যোগ করেছিলেন নতুন মাত্রা। তিনি ভালো ভাবে নিজ গোলাপের সৌরভ চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছেন। সেই সৌরভের মৌমৌ সুভাষ আজোও আমার চারপাশে মৌমৌ করে। কিছু না হোক অন্ততঃ লেখালেখি আর পত্রিকা প্রকাশের পোকাটা তিনি তার বোনের বাসায় খুব ভালো ভাবে ডূকিয়ে দিয়ে গেছেন। আজো তার পদর্শিত পথে বংধররা হাটছেন।

উনার ভাগ্না অর্থাৎ আমার আব্বা-চাচাদের ভিন্ন- ভিন্ন পেশায় থাকলেও কোনো না কোনো ভাবে কেউকেউ পত্রিকা প্রকাশ বা লেখা-লেখির সাথে  সংযুক্ত । ভাগিনা কামরুজ্জামানের হাতে ৮৫ সালে সুনামগঞ্জ থেকে প্রকাশিত হয় “সাপ্তাহিক সুনামগঞ্জ বার্তা”। তার প্রতিষ্টিত সাপ্তাহিকটি এককালের সাড়া জাগায়। চাচা কামরুজ্জামান ছিলেন মামা আব্দুল হাই এর মতো সাংবাদিকতা জগতের আরেক দিকপাল। তিনি এক নাগারে পাঁচ পাঁচবার সুনামগঞ্জ প্রেসক্লাবের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।

আমার বাবা ষাট ও সত্তরের দশকে জাতীয় দৈনিক আজাদ, দৈনিক সংবাদ, দৈনিক পাকিস্তান (পরে দৈনিক বাংলা বর্তমানে বিলুপ্ত) ও দৈনিক পূর্বদেশের ষ্টাফ হিসাবে বৃহত্তর সিলেট ব্যুরোর দায়িত্ত্ব পালন সহ এক সময়ের বৃটিশ ভারতে সুনামধন্য উল্লেখ যোগ্য সাপ্তাহিক ‘যুগভেরী'(বর্তমান দৈনিক) এর কার্য নির্বাহী সম্পাদকের ও দায়িত্ব পালন করেন। ইদানিং সময়ে আমার ছোট চাচা আহমদুজ্জামান হাছান দৈনিক “সুনামগঞ্জ প্রতিদিন” পত্রিকা প্রকাশনা ও সম্পাদনায় জরিত। এক কথায় বলা যায় এসব কিছুই দাদা মুহাম্মদ আব্দুল হাই এর প্রতি দায়বদ্ধতার বহিঃপ্রকাশ।

 আম্মার কাছে উনার অনেক গল্প শুনেছি। আমার আম্মা ছিলেন দাদা’র লিখার একজন গুনমুগ্ধ পাঠক। দাদার লিখা প্রকাশ পেলেই আম্মা পত্রিকা থেকে লেখা কাট করে জমাতেন। জমিয়ে জমিয়ে পুরো এক খাতার মতো করে বানিয়ে রেখেছেন। সিলেটে ওমেন্স কলেজের বিএ পড়ুয়া আম্মা যখন সুনামগঞ্জে উনার ভাগ্না বউ হয়ে আসেন তখন সুনামগঞ্জের আদর্শ শিশু শিক্ষা নিকেতন নামক স্কুল উদ্বোধন হয়। দাদা আম্মাকে স্কুলে শিক্ষিকা হিসেবে জয়েন্ট করার জন্য উৎসাহ দেন। নিজ হাতে আবেদন পত্র লিখে দেন। ব্যাক্তিগত কারনে আম্মার চাকরি করা হয়নি। তবে স্মৃতি হিসাবে আজো দাদার লেখা আবেদন পত্রটি আম্মা সযত্নে রেখেছেন।

লেখক-গৃহিণী,যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn