দূরত্ব ঘুচিয়ে ও ‘ভুল বোঝাবুঝি’ নিরসন করে ফের রাজপথে সক্রিয় হচ্ছেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। সেই উদ্যোগের অংশ হিসেবে বৈঠকে বসছেন ফ্রন্টের শীর্ষ নেতারা। আগামীকাল সোমবার জেএসসি সভাপতি আ স ম আবদুর রবের উত্তরার বাসায় মিলিত হবেন তারা। আড়মোড়া ভেঙে পুনর্নির্বাচন দাবিতে রাজপথ কাঁপানোর কর্মসূটি নেয়া হতে পারে নেতাদের এ বৈঠক থেকে। এর আগে রোববার সন্ধ্যায় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেনের মতিঝিল কার্যালয়ে জোটের শরিক দলের নেতারা একদফা বসবেন। তবে এটিকে ‘অনানুষ্ঠানিক বৈঠক’ বলে দাবি করছে জোট। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে সম্পৃক্ত একাধিক নেতা জানিয়েছেন, এ বৈঠকে নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে জোটের শরিকদের মধ্যে নানা ইস্যুতে সৃষ্ট সংকট, দূরত্ব এবং ভুল বোঝাবুঝি দূর করার চেষ্টা করা হবে। জোট ত্যাগে আলটিমেটাম দেয়া কাদের সিদ্দিকীকে নিবৃত করার চেষ্টা করা হবে। আলোচনা হতে পারে নতুন কর্মসূচি নিয়েও। ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে যাত্রা শুরু করে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। একসঙ্গে আন্দোলন, নির্বাচন এবং সরকার গঠনের লক্ষ্য নিয়ে মাঠে নামা জোটটি নির্বাচনে মাত্র আটটি আসনে জয়লাভ করে।

নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম ও কারচুপির অভিযোগ তুলে ফল বর্জনের পাশাপাশি শপথ না নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ঐক্যফ্রন্ট। কিন্তু একপর্যায়ে গণফোরামের দুই এমপি শপথ নিয়ে নেন। নানা নাটকীয়তার পর বিএনপি মহাসচিব ছাড়া দলটির বাকি ৫ সংসদ সদস্যও শপথ নিয়ে নেন। জোটের শরিকদের না জানিয়ে বিএনপি ও গণফোরাম এককভাবে সিদ্ধান্ত বদল করায় সৃষ্টি হয়েছে দূরত্ব। এ নিয়ে ফ্রন্টের শরিকদের অনেক নেতা প্রকাশ্যে সমালোচনাও করেন। এসব কারণে পুনর্নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনে নামার ঘোষণা দিয়েও শেষ পর্যন্ত আর মাঠে দেখা যায়নি ঐক্যফ্রন্টকে। জোট সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে কোনো কর্মসূচি না থাকা এবং বিএনপি ও গণফোরামের সদস্যদের সংসদে যোগদান নিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ভেতরে এক ধরনের চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। পাশাপাশি বগুড়া-৬ আসনের উপনির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ এবং জোটের আরেক শরিক দল কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর জোট ছাড়ার আলটিমেটামের মধ্য দিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অসন্তোষ প্রকাশ্যে আসে। ফলে কার্যত থমকে দাঁড়ায় জোটের যাবতীয় কর্মকাণ্ড।

জানা গেছে, এ অচলাবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য দীর্ঘদিন পর বৈঠকে বসছেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতারা। এর আগে তারা ঘরোয়াভাবে কয়েক দফা বসেছেন, কথাও বলেছেন নিজেদের মধ্যে। প্রথমে ১২ জুন বৈঠক ডাকা হলেও পরে তা এগিয়ে ১০ জুন নির্ধারণ করা হয়। ঈদের পর দিন এক ঘরোয়া অনুষ্ঠানে ফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেন জানান, ঐক্যফ্রন্ট ভাঙছে না, জোটের পরিধি আরও বাড়বে। পাশাপাশি রাজপথে সক্রিয় হওয়ার ঘোষণা দেন ড. কামাল হোসেন। সেই প্রস্তুতি হিসেবে সোমবারের বৈঠক বলে জানিয়েছেন জোট সংশ্লিষ্ট নেতাদের। এতে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের বিগত দিনের কার্যক্রম পর্যালোচনা ও পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ নিয়ে আলোচনা হবে। এর আগে ড. কামাল হোসেনের মতিঝিলের চেম্বারে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের বাকি চার দলের একটি বিশেষ বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে।

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম শরিক গণফোরামের একাধিক নেতা জানান, জোটের শরিকদের মধ্যে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর আলটিমেটামকে গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে। গত ৯ মে কাদের সিদ্দিকী সংবাদ সম্মেলন করে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে ৮ জুন পর্যন্ত আলটিমেটাম দেন। এর মধ্যে ঐক্যফ্রন্টের এমপিরা কেন শপথ নিলেন এ বিষয়ে সন্তোষজনক জবাব না পেলে তিনি জোটের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করবেন বলেও জানান। যদিও এই আলটিমেটাম শেষ হওয়ার আগেই গত সোমবার রাতে ড. কামাল হোসেনের আহ্বানে তার বেইলি রোডের বাসায় যান বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী। ওই বৈঠকের পর ড. কামাল হোসেন তার দলের কয়েকজন নেতাকে জানিয়েছেন, কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে তার আলোচনা হয়েছে, এতে তিনি সন্তুষ্ট। জোটে থাকা না থাকার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে আরও দুদিন সময় নিয়েছেন কাদের সিদ্দিকী।

জানতে চাইলে এ বিষয়ে গণফোরামের সাংগঠনিক সম্পাদক লতিফুর বারী হামীম শনিবার বলেন, ‘ইতিমধ্যে কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে ড. কামাল হোসেনের কথা হয়েছে। তিনি বলেছেন, আলোচনা সন্তোষজনক।’ এ বিষয়ে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ ইকবাল সিদ্দিকী শনিবার বলেন, ‘একাদশ জাতীয় নির্বাচনের পর বিএনপির সংসদে যোগদান, বগুড়া-৬ উপনির্বাচনে অংশগ্রহণ, গণফোরামের মোকাব্বির খানকে তাদের বিশেষ কাউন্সিলে অংশ নিতে দেয়ার সিদ্ধান্তগুলো নিয়ে আমরা প্রশ্ন রেখেছি। আমরা জানি না এসব সিদ্ধান্ত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নাকি বিএনপির।’ জানা গেছে, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ঐক্য ধরে রাখতে বিএনপির আন্তরিকতার কমতি নেই। এ বিষয়ে ড. কামাল হোসেনও ইতিবাচক। ঈদের পর দিন দলের নেতাকর্মীরা তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে তিনি ঐক্যের ওপর জোর দিয়ে আগামী দিনের আন্দোলন সংগঠিত করার আহ্বান জানান। ডিসেম্বরের মধ্যে ফল আনতেও তাগাদা দেন ড. কামাল হোসেন। এর অংশ হিসেবেই অভ্যন্তরীণ সংকট দূর করে নিজেদের ঐক্য সুসংহত করার পাশাপাশি নয়া উদ্যমে রাজপথে নামার সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট।

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের গৃহবিবাদ দূর করতে কাজ করছেন গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী। তিনি বলেন, সমস্যা তো কিছু আছে। এগুলো বৈঠকেই ঠিক হয়ে যাবে আশা করি। ঐক্যফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটির অন্যতম সদস্য ডা. জাফরউল্লাহ চৌধুরী বলেন, সোমবার আমাদের মিটিং আছে। সবকিছু মিটমাট হয়ে যাবে আশা করি। বিএনপির দায়িত্বশীলরা বলছেন, বিএনপি যেকোনো মূল্যে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ঐক্য টিকিয়ে রাখার পক্ষে। দলের কারাবন্দি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ঐক্যফ্রন্টের ঐক্য অটুট রাখার পক্ষে। তিনি নির্বাচনের আগে যেমন ঐক্যের পক্ষে সম্মতি দিয়েছিলেন, সে পথ থেকে তিনি সরে যাননি। বৈঠক হলেই ঐক্যফ্রন্টের সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে বলে মনে করছে দলটি। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সোমবারের বৈঠকে উপস্থিত থাকবেন। প্রশ্ন উঠলে তিনি উত্তর দেবেন— এ প্রস্তুতি তার রয়েছে।

ঐক্যফ্রন্টের শরিক নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ঐক্যফ্রন্ট কীভাবে ঘুরে দাঁড়াবে, বিষয়টি ঐক্যফ্রন্টের বড় দল হিসেবে সবচেয়ে বেশি নির্ভর করছে বিএনপির ওপর। পাঁচ মাস নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে থাকলাম, সে নিষ্ক্রিয়তা ভাঙতে পারে বিএনপি। তারা কোনো কারণেই হোক উদ্যোগ নিচ্ছে না। আশা করি, বিএনপি দ্রুত এগিয়ে আসবে। গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী আশা প্রকাশ করছেন, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট চাঙ্গা হবেই। তিনি বলেন, একটি বৃহৎ ঐক্যের জন্য অপেক্ষা করছি। আশা করি, সেই ঐক্য আপনারা শিগগিরই দেখতে পাবেন।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn