ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হওয়ার পর নিজেকে সব ধরনের সাংগঠনিক কার্যক্রম থেকে গুটিয়ে নেন আওয়ামী যুবলীগের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী। প্রায় এক মাস ধরে ধানমন্ডির নিজ বাসায় অনেকটা ‘নির্বাসিত’ জীবন যাপন করছেন। নেতা-কর্মীরাও যাচ্ছেন না তাঁর কাছে। যুবলীগ চেয়ারম্যানের নীরব পতন হয়েছে বলে মনে করছেন নেতা–কর্মীরা। এখন তাঁর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপনের দাবি জানিয়েছেন যুবলীগেরই কয়েকজন নেতা। তবে তাঁরা নাম প্রকাশ করতে চাননি। ৩ অক্টোবর ওমর ফারুক চৌধুরীর ব্যাংক হিসাব তলব করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাঁর নামে থাকা সব ধরনের ব্যাংক হিসাবের লেনদেন, বিবরণীর তথ্য ইতিমধ্যেই বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটে জমা পড়েছে বলে জানা গেছে। এছাড়া সরকারের অনুমতি ছাড়া তাঁর বিদেশযাত্রার ক্ষেত্রে ৬ অক্টোবর নিষেধাজ্ঞা দেয় অভিবাসন পুলিশ। ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে যেসব রাজনৈতিক নেতার নাম এসেছে, তাঁদের সবার বিষয়ে তদন্ত হচ্ছে বলে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সূত্র জানায়। যুবলীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, প্রায় ১০ বছর একক কর্তৃত্বে সংগঠন চালিয়েছেন ওমর ফারুক চৌধুরী। গত ১৮ সেপ্টেম্বর ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে অভিযান শুরুর পর তাঁর স্বেচ্ছাচারিতা, অর্থের বিনিময়ে বিতর্কিতদের সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো এবং অপকর্মে প্রশ্রয় দেওয়ার বিষয়টি সামনে চলে আসে। নৈতিক স্খলনের কারণে নিজ থেকেই পদত্যাগ করা উচিত ছিল তাঁর। পদ ধরে রাখায় সংগঠনের কাজ ব্যাহত হচ্ছে। এখন তাঁকে বাইরে রেখেই যুবলীগের কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়ার বিষয়টি আগামী রোববার চূড়ান্ত হতে পারে।

সর্বশেষ ১১ অক্টোবর যুবলীগের সভাপতিমণ্ডলীর বৈঠক হলেও তাতে অংশ নেননি ওমর ফারুক। নেতা-কর্মীদের ফোনও ধরছেন না তিনি। এই অবস্থায় জাতীয় সম্মেলনের (২৩ নভেম্বর) বিষয়ে আলোচনা করতে রোববার গণভবনে যাচ্ছেন যুবলীগের নেতারা। তবে ওই বৈঠকে যেতে পারবেন না ওমর ফারুক চৌধুরী এবং সংগঠনের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য সাংসদ নুরুন্নবী চৌধুরী ওরফে শাওন। ক্যাসিনো অভিযান শুরু হওয়ার পর নুরুন্নবীর ব্যাংক হিসাবও তলব করে বাংলাদেশ ব্যাংক। যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, সম্মেলন ও সামগ্রিক পরিস্থিতিতে করণীয় নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে নির্দেশনা নেওয়া হবে। বৈঠকে ওমর ফারুক চৌধুরী যাতে অংশ না নেন, এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে তাঁকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ৬৪ বছর বয়সে ২০১২ সালে যুবলীগের চেয়ারম্যান হন ওমর ফারুক। কাউন্সিল না হওয়ায় সাত বছর ধরে একই পদে রয়েছেন তিনি। তামাকের বিকল্প ‘টেন্ডু পাতা’ থেকে শুরু করে তৈরি পোশাকের ব্যবসা করেছেন একসময়। এরশাদের শাসনামলে জাতীয় পার্টির যুব সংগঠন যুব সংহতির সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন তিনি। যুবলীগের দায়িত্বশীল কয়েকজন নেতা জানান, ঢাকা মহানগর (দক্ষিণ) যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী ওরফে সম্রাটকে বহিষ্কার করা হয় ৭ অক্টোবর। ১০ দিন পরও তাঁর পদে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে কাউকে দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। যুবলীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের পিয়ন থেকে দপ্তর সম্পাদক হয়ে বিত্তবৈভবের মালিক হওয়া কাজী আনিসুর রহমান আনিসের খোঁজ নেই ২৫ দিন ধরে। ১১ অক্টোবর তাঁকে বহিষ্কার করা হলেও এই পদে কাউকে দায়িত্ব দেওয়া হয়নি।

যুবলীগ সূত্র জানায়, ক্যাসিনোতে অভিযান শুরুর দিন (১৮ সেপ্টেম্বর) যুবলীগের চেয়ারম্যান মিরপুরে সংগঠনের এক অনুষ্ঠানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘এত দিন আঙুল চুষছিলেন?’ গত ২০ সেপ্টেম্বরও উত্তরার সংগঠনের একটি অনুষ্ঠানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ধন্যবাদ জানান। এরপর থেকে তাঁকে সংগঠনের কোনো কার্যক্রমে দেখা যায়নি। যুবলীগের সভাপতিমণ্ডলীর তিনজন সদস্য জানান, প্রচলিত রেওয়াজ অনুযায়ী সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের চেয়ারম্যান। এখন ওমর ফারুক চৌধুরীর বিকল্প হিসেবে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে কাউকে দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে। সভাপতিমণ্ডলীর জ্যেষ্ঠ নেতাদের মধ্যে কয়েকজন আগেও বিভিন্ন সময়ে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এ ছাড়া কাউকে আহ্বায়ক করেও এই দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে। এ বিষয়ে যুবলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শহীদ সেরনিয়াবাত বলেন, বিভিন্ন অভিযোগ তদন্তাধীন থাকায় চেয়ারম্যান নিজ থেকেই সরে আছেন। এটাই সৌজন্য। যে কারণেই হোক, তিনি দায়িত্ব পালনে অপারগ আছেন। এমন অবস্থায় সম্মেলন পরিচালনা করতে গঠনতান্ত্রিকভাবে কাউকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দিতে পারেন প্রধানমন্ত্রী।

১১ অক্টোবর সভাপতিমণ্ডলীর বৈঠকে ওমর ফারুকের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করেছেন কয়েকজন নেতা। কেউ কেউ সাধারণ সম্পাদকের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। চারজন নেতা জানান, চেয়ারম্যান প্রকাশ্যে গাল দিতেন নেতা-কর্মীদের। তাঁর সঙ্গে সরাসরি দেখা করা কিংবা আলাপ করার সুযোগ ছিল না। কাজী আনিসের মাধ্যমে যোগাযোগ করতে হতো। নেতা-কর্মীরা তাঁকে যুবলীগ চেয়ারম্যানের ‘ক্যাশিয়ার’ বলে জানে। ক্যাসিনো, টেন্ডারবাজিসহ নানা অপকর্মে যাঁদের নাম এসেছে, তাঁদের দায় যুবলীগের চেয়ারম্যানেরও। তাঁর আশ্রয়-প্রশ্রয়েই এসব হয়েছে। যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন মহি বলেন, গঠনতন্ত্র অনুসারে পরিচালনা করা হলে সংগঠন এখন এভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হতো না। এ পরিস্থিতিতে আনার দায় সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এড়াতে পারেন না। খবর: প্রথম আলো।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn