তসলিমা নাসরিন-

ইউরোপ আমেরিকা থেকে খবর আসে, ক্যাথলিক গির্জার ভেতরে বালকদের ধর্ষণ করেছেন খ্রিস্টান পুরোহিতরা, ফাদাররা।  অবিশ্বাস্য হলেও সত্য।  অন্য মুসলিম দেশে কতটা হয় তা তলিয়ে দেখিনি, তবে বাংলাদেশের পত্র পত্রিকায় প্রায়ই খবর পড়ছি,  ইমাম শিশু ধর্ষণ করেছে মসজিদে, মাদ্রাসার শিক্ষক মাদ্রাসার ভেতরেই চার পাঁচ ছ’বছর মাদ্রাসার ছাত্রীকে ধর্ষণ করেছে।  আজ শুনি জম্মু কাশ্মিরের এক মন্দিরে ৮ বছর বয়সী একটি মেয়েকে ধরে এনে গণধর্ষণ করেছে কিছু লোক, ধর্ষকদের একজন সাঞ্জি রাম, মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ছিল যার কাঁধে।  ৮  বছর বয়সী আসিফাকে মন্দিরের ভেতর বন্দি করে ধর্ষণ করেছে সাঞ্জি রামের আত্মীয় স্বজন, আর দু’জন পুলিশ আধিকারিক, তাদের বন্ধু।  আসিফা ঘোড়া চড়াতো জম্মুতে, তার একটি ঘোড়া হারিয়ে যাওয়ায় যখন সে ঘোড়া খুঁজছিল জঙ্গলে, তখনই তাকে ধরে নিয়ে এসে মন্দিরে বন্দি করে ধর্ষকের দল।  এরপর টানা কয়েকদিন ধর্ষণ করার পর ভারী পাথর দিয়ে মাথা ফাটিয়ে আসিফাকে বীর পুঙ্গবেরা হত্যা করে।

আসিফা যদি মুসলমান না হয়ে হিন্দু হতো, লোকগুলো ঠিক একই ভাবে হয়তো মেয়েটিকে ধরে আনতো, বন্দি করতো, ধর্ষণ করতো, এবং শেষে মেরে ফেলতো।  গরিবকে মেরে ফেললে ঝুট ঝামেলার আশঙ্কা সাধারণত কম থাকে, তা ধনী দরিদ্র সকলেই তা জানে।  মেয়েটি হিন্দু হলে, হিন্দু পুরুষেরা, মেয়েটি জঙ্গলে যেভাবে হাঁটছিল, সেভাবে তাকে একা একা  হাঁটতে দিত বলে আমার বিশ্বাস হয় না।  ভারতবর্ষে প্রতি ১৪ মিনিটে একটি করে ধর্ষণ ঘটছে।  হিন্দু পুরুষেরাই প্রায় প্রতিদিন হিন্দু মেয়েদের ধর্ষণ করছে।  বৃদ্ধা থেকে শুরু করে এক বছরের শিশুকেও রেহাই দিচ্ছে না। একই রকম মুসলিম পুরুষেরাও ধর্ষণ করছে।  কোনও বয়সের কোনও মেয়েকেই বাঁচতে দিচ্ছে না।  ধর্ষণ চলছেই।  হত্যাও চলছে।  ধর্ষণ যারা করে, তারা সাধারণত ধর্ষণ যাকে করা হয়, তার নাম ধাম তার ধর্ম কর্ম এসব জানতে আগ্রহী হয় না।  তারা শুধু শরীরটা দেখে।  যত কচি  হবে শরীর,  তত চমৎকার হবে স্বাদ।  অথবা তারা শুধু ‘বীরত্ব’টাই দেখে। বর্বরতাকে বীরত্ব ভাবার লোকের অভাব নেই এই দুনিয়ায়।

শত্রুপক্ষের মেয়েদের ধর্ষণ করা নতুন কিছু নয়।  যেহেতু শত্রু পক্ষের হাতি  ঘোড়া জমি জমা ঘর বাড়ির মতো মেয়েদেরও সম্পত্তি বলে মনে করা হয়, তাই তারা শত্রুপক্ষের হাতি ঘোড়া নিয়ে চলে যায়, জমি জমা দখল করে নেয়, ঘর বাড়ি লুট করে, পুড়িয়ে ফেলে, আর তাদের মেয়েদের ধর্ষণ করে।  এই তো হয়ে আসছে আদিকাল থেকে।  শত্রু-পুরুষদের মা বোন স্ত্রী কন্যাকে ধর্ষণ করে শত্রু-পুরুষদের শায়েস্তা করার অভ্যেস মানুষের বড় পুরনো।  পয়গম্বর মুহম্মদ আরব দেশে ইহুদি পুরুষদের মেরে ইহুদি মেয়েদের নিজের জঙ্গি সঙ্গিদের মধ্যে ভোগ করার জন্য বিতরণ করেছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ২ লক্ষ মেয়েকে ধর্ষণ করেছিল পাকিস্তান সেনারা।  যদিও সেনারা মুসলমান ছিল, এবং ধর্ষিতাদের অধিকাংশই ছিল মুসলমান–  কিন্তু ধর্মের চেয়ে বড় হয়ে উঠেছিল বিরোধ।  বাঙালির ঘর বাড়ি পাকিস্তানিরা লুট করেছিল,  পুড়িয়ে দিয়েছিল, আর বাঙালি মেয়েদের করেছিল ধর্ষণ।   যুদ্ধের সুযোগটা পেয়ে গিয়েছিল বলেই ধর্ষণ করেছিল।  সুযোগ পেলে অহরহই পুরুষেরা ধর্ষণ করে মেয়েদের, ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে ধর্ষণ করে, যুদ্ধের প্রয়োজন হয় না।

সত্যি কথা বলতে, ভারতে কোনও হিন্দু মুসলমানে যুদ্ধ হচ্ছে না, বিরোধ তৈরি করার চেষ্টা আজকাল অনেকে করছে বটে, কিন্তু বিরোধটা এমন ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠেনি, যে হিন্দুরা দলে দলে মুসলমান মেয়েদের ধর্ষণ করবে, বা মুসলমানরা দলে দলে হিন্দু মেয়েদের ধর্ষণ করবে।  এখন অবধি হিন্দু পুরুষেরা যত মুসলমান মেয়েদের ধর্ষণ করছে, তার চেয়ে শতগুণ বেশি হিন্দু মেয়েদেরই ধর্ষণ করছে।  একই রকম মুসলমান পুরুষেরাও মুসলমান মেয়েদেরই ধর্ষণ করছে বেশি।  ওরা যে হিন্দু মেয়েকে বা মুসলমান মেয়েকে ধর্ষণ করার প্রতিজ্ঞা করে ধর্ষণ করছে তা নয়।  সুযোগ পায় বলে করছে।  মুসলমান পুরুষেরা হাতের কাছে মুসলমান মেয়েদের বেশি পায় বলে মুসলমান মেয়েদের ধর্ষণ করে।  একই রকম হিন্দু পুরুষেরা হাতের কাছে হিন্দু মেয়েদের বেশি পায় বলে হিন্দু মেয়েদের বেশি ধর্ষণ করে।

কাঠুয়ায় যে ৮ বছর বয়সী মেয়েকে সাত জন মিলে সাত দিন ধরে ধর্ষণ করলো, মিরাট থেকে জম্মু চলে এল এক লোক শুধু একটি মেয়েকে ধর্ষণ করবে বলে, আকর্ষণটা কি হিন্দু হয়ে একটি মুসলমান মেয়ে ধর্ষণ করার সুযোগ পেয়েছে বলে? নাকি একটা মেয়েশিশুকে ধর্ষণ করার সুযোগ পেয়েছে বলে? আমার কিন্তু মনে হয় একটি মেয়ে শিশুকে ধর্ষণ করার সুযোগ পেয়েছে বলে। আসিফা হিন্দু হলেও মিরাট থেকে চলে জম্মু চলে আসতো ধর্ষক।  আজকাল শিশু ধর্ষণ প্রচণ্ড বাড়ছে। হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান সব ধর্মের লোকেরাই শিশু ধর্ষণের সুযোগ পেলে আর ছাড়ছে না। হয়তো শিশু-ধর্ষণ সব কালেই ছিল, আজকাল পত্র পত্রিকায় এ নিয়ে খবর হয় বলেই আমাদের মনে হয় এটি বাড়ছে।

হিন্দু পুরুষেরা যদি কোনও হিন্দু মেয়েকে ধর্ষণ না করতো, তা হলে বুঝতাম মুসলমান মেয়ে বলেই আসিফাকে ধর্ষণ করেছে কাঠুয়ার  হিন্দু পুরুষেরা।  মুসলমান পুরুষরাও যদি হিন্দু মেয়ে ছাড়া আর কোনও ধর্মের মেয়েকে ধর্ষণ না করতো, তাহলে হয়ত স্পষ্ট হতো হিন্দু মুসলমানে বিরোধ বাড়ছে, বা যুদ্ধ বাড়ছে।  এখনও এই সমাজে ইমদাদুল রশিদির মতো মুসলমান লোক আছেন, যারা পুত্র হত্যার প্রতিশোধ নিতে হিন্দু হন্তারকদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে দাঙ্গা বাঁধাতে চান না।  এখনও যশপাল সাক্সেনার মতো হিন্দু লোক আছেন যারা পুত্র হত্যার প্রতিশোধ না নিয়ে বরং মুসলমান হন্তারকদের ক্ষমা করে দেন।  যশপাল সাক্সেনার মতো হিন্দু আর ইমদাদুল রশিদির মতো মুসলমানই এই ভারতীয় উপমহাদেশে দরকার।

ওদিকে উত্তর প্রদেশের উন্নাও-এ এক ১৮ বছর বয়সী বালিকা কুলদীপ সিংহ সেঙ্গার নামের এক বিধায়ক এবং তার ভাই তাকে ধর্ষণ করেছেন বলে অভিযোগ করেছে।  ধর্ষক রাজপুত, আর কিশোরী দলিত শ্রেণির।  কেউ কেউ বলছে উঁচু জাতের লোকদের মধ্যে নিচু জাতের মেয়েদের ধর্ষণ করার একটা প্রবণতা আছে। ধর্ষণের পেছনে যেহেতু ঘৃণা একটা কারণ, সে কারণে হতেই পারে উঁচু জাত নিচু জাতকে ঘৃণা করে বলেই ধর্ষণ করে।  কিন্তু উঁচু জাতের পুরুষ কী উঁচু জাতের মেয়েদের ধর্ষণ করছে না? খুব করছে। নিচু জাতের পুরুষও নিচু জাতের মেয়েদের ধর্ষণ করছে।  তাহলে এখানে জাত নয়, মেয়েদের প্রতি ঘৃণাটাই, মেয়েদের নিচু জাত, মেয়েদের দাসি বাঁদি, বুদ্ধিসুদ্ধিহীন জীব ভাবাটাই ধর্ষণের কারণ।  অনেকেই আমরা জানি, ধর্ষণ আর যা কিছুই হোক, যৌন সঙ্গম নয়।  ধর্ষণ নিতান্তই পেশির জোর, পুরুষের জোর, আর পুরুষাঙ্গের জোর।  মোদ্দা কথা, পিতৃতান্ত্রিক সমাজের পরম পূজনীয় পুরুষাঙ্গের ন্যাড়া মাথায় মুকুট পরানো বা বিজয় নিশান ওড়ানোর আরেক নাম ধর্ষণ।

এখনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি বিধায়ক কুলদীপ সেঙ্গার উন্নাওয়ের মেয়েটিকে ধর্ষণ করেছেন কিনা।  যদি প্রমাণ মেলে তিনিই ধর্ষণ করেছেন, তাহলে কিন্তু অবাক হওয়ার কিছু নেই।  তিনি বিজেপির বিধায়ক বলে ধর্ষণ করেছেন তা নয়, তার জায়গায় কংগ্রেস, তৃণমূল, সিপিএম বা যে কোনও রাজনৈতিক দলের বিধায়ক হলেও ধর্ষণ করতেন।  করতেন কারণ তারা পুরুষ।  ক্ষমতাশালীরাই ধর্ষণ বেশি করে।  কারণ ক্ষমতাশালীদের দোষ ঢাকার ব্যবস্থা থাকে।  আর ক্ষমতাশালীদের শাস্তি দেওয়ার চল খুব বেশি নেই।  অন্যায় করে তারাই অন্যদের চেয়ে বেশি পার পেয়ে যেতে পারেন।

কাঠুয়ার ধর্ষণকে সাম্প্রদায়িক আখ্যা দেওয়া হচ্ছে, আর উন্নাওয়ের ধর্ষণকে বলা হচ্ছে এ বিজেপির বিধায়ক বলেই হয়েছে।  আমি মনে করি কাঠুয়ায় আর উন্নাওয়ে যারা দুটো মেয়েকে ধর্ষণ করেছে, তারা পুরুষ বলেই ধর্ষণ করেছে।  তারা ধর্ষণ করার সুযোগ পেয়েছে বলেই ধর্ষণ করেছে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ পুরুষদের শিখিয়েছে মেয়েরা নিতান্তই ভোগ্য বস্তু , তাই তাদের শরীর যেমন ইচ্ছে তেমন ভাবে ভোগ করাটা এমন কোনও অন্যায় নয়।  পুরুষতান্ত্রিক সমাজ পুরুষদের শিখিয়েছে মেয়েরা অবলা অসহায়, মেয়েরা যে ধর্মেরই হোক, যে বয়সই তাদের হোক, যে বর্ণেরই তারা হোক, যে বংশেরই হোক তারা, গরিব হোক ধনী হোক –তারা নিচুজাত, তাদের নিগ্রহ করার, নির্যাতন করার, নিষ্পেষিত করার অধিকার পুরুষের আছে, তাই পুরুষেরা ধর্ষণ করছে।  প্রতি ১৪ মিনিটে একটি।

যতদিন পুরুষতান্ত্রিক সমাজ না ভাঙবে, যতদিন মেয়েদের সমানাধিকারকে তুচ্ছ করবে পুরুষেরা, যতদিন পুরুষেরা নিজেদের প্রভু আর মেয়েদের যৌনদাসি ভাবাটা বন্ধ না করবে, ততদিন পুরুষ– সে হিন্দু হোক মুসলমান হোক, খ্রিস্টান হোক, বৌদ্ধ হোক, ইহুদি হোক,  ধনী হোক দরিদ্র হোক, উঁচু জাত হোক, নিচু জাত হোক, বিধায়ক হোক, মন্ত্রী হোক, পুরোহিত হোক, ইমাম হোক, মন্দির রক্ষক হোক– মেয়েদের ধর্ষণ করবেই। লেখক: কবি, সাহিত্যিক, মুক্তচিন্তক, নারীবাদী, মানববাদী, ডাক্তার 

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn