কুলসুম হত্যা::মুচলেকা দিয়ে বাসায় ফিরেই স্ত্রীকে পিটান এমদাদ
রুদ্র মিজান-মুচলেকা দিয়ে থানা থেকে বাসায় ফিরেই স্ত্রীকে বেদম প্রহার করেন এমদাদ হোসেন। এর একদিন পরেই স্ত্রী উম্মে কুলসুমের ভাইকে ফোনে জানানো হয় তার বোন আর নেই। তিনি আত্মহত্যা করেছেন। দ্রুত ঢাকার বাড্ডায় বাসায় পৌঁছে দেখতে পান ফ্ল্যাটটি বাইরে থেকে তালাবদ্ধ। পুলিশের উপস্থিতিতে অতিরিক্ত চাবি দিয়ে দরজা খুলেন বাড়ির মালিক। ফ্যানের সঙ্গে গলায় ওড়না প্যাচানো কুলসুমের লাশ। তার পা ছুঁেয় আছে বিছানা। অনেকটা অর্ধ ভাজ করা তার দেহ।
বাসায় কেউ নেই। ঘটনাটি ঘটেছিলো গত ২৫শে জানুয়ারি। ওই দিন বিকালে লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে পাঠায় পুলিশ। এ ঘটনায় হত্যা মামলা হলেও তাৎক্ষণিকভাবে কোনো আসামিকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। সম্প্রতি আসামিরা উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়েছেন। বাদিপক্ষ অভিযোগ করেছেন, মামলাটি আপস করার প্রস্তাব দিয়েছে আসামিপক্ষ। এতে রাজি না হাওয়ায় নানাভাবে হুমকি-ধমকি দিচ্ছে আসামিরা। আশঙ্কা করছেন তারা অর্থের বিনিময়ে তদন্তে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। পুলিশের সুরতহালে উল্লেখ রয়েছে, ‘নিহতের ডান চোখের নিচে ও গালে লালচে দাগ পরিলক্ষিত হয়। গলার উভয় পাশে অর্ধ চন্দ্রাকৃতির কালচে দাগ পাওয়া গেছে। ডান হাতের মুষ্টির ওপর ফোলা লালচে জখম। দুই হাতের তালুতে কালোশিরা দাগ। ঘাড় থেকে মাজা পর্যন্ত দাগ দেখা গেছে।’ প্রাথমিক তদন্তে এটি হত্যা বলেই মনে হয়েছে পুলিশের কাছে। লাশ উদ্ধারকালে বাসায় কেউ ছিলেন না বলে জানায় পুলিশ। এ বিষয়ে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, ২২শে জানুয়ারি কুলসুমকে বেদম প্রহার করেন এমদাদ। নারী ও শিশু হেল্প লাইন সেন্টারের ১০৯ নম্বরে কল দিয়ে বিষয়টি জানান প্রতিবেশীরা। খবর পেয়ে পুলিশ তাৎক্ষণিকভাবে মেরুলবাড্ডার ডিআইটি প্রজেক্টের ওই বাসায় ছুটে যায়। ডেকে আনা হয় কুলসুমের স্বজনদের। পরবর্তীতে বাড্ডা থানায় এ বিষয়ে বৈঠক হয়। থানায় মুচলেকা দিয়ে তখন বাসায় ফিরেন এমদাদ। বাসায় ফিরেই কুলসুমকে আবার মারধর করেন এমদাদ।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২৩শে জানুয়ারি রাত ২টার দিকে কুলসুমের কান্না, চিৎকারের শব্দ পান প্রতিবেশীরা। ধারণা করা হয় রাতভর তাকে মারধর করা হয়। কুলসুমের স্বজনদের অভিযোগ, গভীর রাত থেকে সকালের মধ্যে যে কোনো সময় পিটিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয় তাকে। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, পরদিন ২৪শে জানুয়ারি সকাল ৯টা ৫০ মিনিটে কুমিল্লা থেকে কুলসুমের সঙ্গে কথা বলতে কল দেন তার মা। ফোন রিসিভ করে কুলসুমের শ্বাশুড়ি জানান, কুলসুম গোসলে। আরও কয়েকবার কল দিলেও তা রিসিভ হয় না। বিকাল ৫টার দিকে এই মামলার প্রধান আসামি এমদাদের ভাগ্নে সুমন ফোনে জানান, কুলসুম আর বেঁচে নেই। দ্রুত কুলসুমের স্বজনদের ঢাকায় আসতে বলেন। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, সকালে এমদাদ-কুলসুম দম্পতির তিন বছরের সন্তান ঈশালকে সঙ্গে নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে যান কুলসুমের শ্বাশুড়ি। তার আগে বাসা থেকে বের হয়ে যান এমদাদ। খালি বাসা থেকেই উদ্ধার করা হয় কুলসুমের লাশ।
নিহত উম্মে কুলসুমের স্বজনরা জানান, পাঁচ বছর আগে এমদাদ হোসেনের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিলো উম্মে কুলসুমের। স্বামী এমদাদ হোসেন একটি এয়ারলাইন্সের কর্মকর্তা। কাসিফ বিন এমদাদ ওরফে ঈশাল নামে তিন বছরের এক শিশু সন্তান রয়েছে এই দম্পতির। শ্রীলঙ্কান একটি এয়ারলাইন্সে চাকরি করেন এমদাদ হোসেন। পাঁচ বছর আগে বিয়ে করেন কুমিল্লার বাহ্মণপাড়ার মেয়ে উম্মে কুলসুমকে। বুড়িচং এরশাদ ডিগ্রি কলেজের ছাত্রী কুলসুম। বিয়ের পর লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায় তার। কয়েক বছর যেতে না যেতেই স্ত্রী কুলসুমের সঙ্গে মানসিক দুরত্ব সৃষ্টি হয় এমদাদের। কুলসুম শিক্ষিত না বলে কথায় কথায় তাকে হেয় করতেন তিনি। এ নিয়ে দু’জনের মধ্যে কলহ সৃষ্টি হয়। এ বিষয়ে এই মামলার প্রধান আসামি এমদাদের ভাগ্নে সুমন বলেন, শুনেছি মামি স্মার্ট ছিলেন না। এই অভিযোগ ছিলো এমদাদ মামার। এ নিয়ে দুজনের মধ্যে দুরত্ব ছিলো। প্রায়ই কলহ হতো। এ থেকেই পরবর্তীতে এই ঘটনা ঘটে বলে জানান তিনি। তবে এটি হত্যা নাকি আত্মহত্যা এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি সুমন।
এ ঘটনায় কুলসুমের ভগ্নিপতি সারোয়ার আহমেদ কাউছার বাদি হয়ে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলাটি তদন্ত করছে পুলিশের ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট সিআইডি। সিআইডি’র পরিদর্শক মো. শরীফ জানান, এখন নিহতের লাশের ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পাওয়া যায়নি। রিপোর্ট পেলেই মৃত্যুর কারণ নিশ্চিত হওয়া যাবে। তবে প্রাথমিক তদন্তে এটি হত্যা বলেই মনে হয়েছে। তিনি জানান, মামলার আসামিরা উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়েছেন। এ ঘটনায় অন্য কারও সংশ্লিষ্টতা পেলেও তাদের বিরুদ্ধেও আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আসামি এমদাদ হোসেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা থানার লেসিয়ারা গ্রামের মৃত আনোয়ার হোসেনের পুত্র।