ওয়েছ খছরু, সিলেট থেকে-

পরিবহন ধর্মঘটের দ্বিতীয় দিনে সিলেটে আরো কঠোর অবস্থানে পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা। গতকাল ভোর থেকেই তারা নগরীর প্রতিটি প্রবেশমুখে অবস্থান নেয়। এ সময় লাঠিসোটা নিয়ে রাস্তায় অবস্থান করে। জরুরি প্রয়োজনীয় গাড়ি ছাড়া অন্য কোনো যানবাহন তারা চলাচল করতে দেয়নি। এ কারণে সিলেটে ডাকা তিনদিনের পরিবহন ধর্মঘটের দ্বিতীয় দিনে অচল হয়ে পড়ে সিলেট। এদিকে- রাস্তায় অরাজকতার আশঙ্কায় গতকাল সিলেট নগরীর প্রবেশমুখে পুলিশ মোতায়েন ছিল। পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা জানিয়েছেন- মালিক ও শ্রমিকরাই রাস্তায় গাড়ি বের করছেন না। এখানে তো বাধা প্রদানের কোনো প্রশ্নই আসে না।

সিলেটের জাফলং, বিছনাকান্দি, ভোলাগঞ্জসহ কয়েকটি পাথর কোয়ারি গত দুই বছর ধরে বন্ধ রয়েছে। এসব পাথর কোয়ারি থেকে নির্বিচারে পাথর উত্তোলন ও শ্রমিক মৃত্যুতে মানবিক বিপর্যয় দেখা দেওয়ায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে এই কোয়ারিগুলো বন্ধ রাখা হয়েছে। এতে মত রয়েছে কোয়ারি অধ্যুষিত এলাকার জনপ্রতিনিধিদেরও। কিন্তু করোনা কালে কোয়ারি বন্ধ থাকায় তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে পরিবহন সেক্টরে। বিশেষ করে ট্রাক মালিক ও শ্রমিকরা লোকসান গুনতে গুনতে অসহায় হয়ে পড়েছেন। সিলেটের পাথর কেন্দ্রিক ব্যবসা চালু না হলে ট্রাক শ্রমিকদের দুঃখ লাঘব হবে না। ট্রাক শ্রমিকরা জানিয়েছেন- সিলেটে পাথর কোয়ারি কেন্দ্রিক প্রায় ১৫ লাখ পাথর ও ট্রাক শ্রমিক নিয়োজিত রয়েছে। কোয়ারি বন্ধ থাকার কারণে এসব শ্রমিকরা দিশাহারা হয়ে পড়েছেন। করোনা কালে এসব শ্রমিকদের হাহাকার কেউ দেখেনি। এই অবস্থায় এবার পাথর উত্তোলনের মৌসুম শুরু হলেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে লিজ কিংবা ম্যানুয়ালি পাথর উত্তোলনের সুযোগ দেয়া হয়নি।

সিলেট বিভাগীয় ট্রাক-পিকআপ-কাভার্ডভ্যান মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক আলহাজ গোলাম হাদী ছয়ফুল গতকাল বিকালে  জানিয়েছেন- গত তিন মাস ধরে তারা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালাচ্ছেন। সিলেটের মন্ত্রীদ্বয়, প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে তারা একাধিকবার বৈঠক করেছেন। ধর্মঘট শুরু করার আগের দিন গত সোমবারও তারা জেলা প্রশাসক কাজী এমদাদুল ইসলামের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। কিন্তু প্রশাসন কোনো আশ্বাস পর্যন্ত দেয়নি। তিনি বলেন- আগামীকাল তাদের তিনদিনের পরিবহন ধর্মঘট শেষ হবে। পরবর্তীতে তারা আরো বৃহত্তর পরিবেশে ধর্মঘট আহ্বান করা হতে পারে। গত মঙ্গলবার থেকে ধর্মঘট পালন করছে সিলেটের পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা। দিনভর ধর্মঘট পালনের পর তারা সন্ধ্যায় মশাল মিছিল করেছে। পাথর কোয়ারি সচলের দাবিতে তারা মশাল মিছিলের পর সমাবেশও করে। তবে- ধর্মঘট রাতে কিছুটা শিথিল ছিল। এ কারণে দূর-দূরান্ত থেকে সবজি ও মাছ নিয়ে আসা পরিবহনগুলো সিলেট নগরীতে প্রবেশ করতে পেরেছে। এরপর ভোরেই সিলেটের প্রবেশমুখ চণ্ডিপুল এলাকায় ব্যারিকেড দেয়া হয়। এ সময় সেখানে শ’শ যানবাহন আটকা পড়ে।

সকাল থেকে লাঠিসোটা নিয়ে পরিবহন শ্রমিকরা রাস্তায় অবস্থান করে। একপর্যায়ে সেখানে বিপুলসংখ্যক পুলিশও মোতায়েন করা হয়। শ্রমিকদের ব্যারিকেড উপেক্ষা করে কয়েকটি যানবাহন নগরে ঢোকার চেষ্টা করলে পরিবহন শ্রমিকরা তাদের সরিয়ে দেয়। দুপুরের দিকে সিনিয়র শ্রমিক নেতারা চণ্ডিপুল এলাকা এলে বিক্ষোভ মিছিল করা হয়। একই সঙ্গে সকাল থেকে নগরীর আরেক প্রবেশ মুখ হুমায়ূন রশীদ চত্বরেও অবস্থান ছিল ধর্মঘট আহ্বানকারী শ্রমিকদের। ফলে সিলেট-জকিগঞ্জ ও সিলেট-মৌলভীবাজার সড়ক দিয়ে কোনো যানবাহন নগরীতে প্রবেশ করতে পারেনি। দুপুরে সিলেট বিভাগীয় ট্রাক মালিক গ্রুপের সাংগঠনিক সম্পাদক শাব্বির আহমদ ফয়েজের নেতৃত্বে হুমায়ূন রশীদ চত্বর এলাকায় মিছিল বের করা হয়। মিছিলটি কদমতলী ঘুরে আবার চলে আসে। এ সময় শাব্বির আহমদ ফয়েজ জানিয়েছেন- আমরা শান্তিপূর্ণভাবে গাড়ি বন্ধ রেখে ধর্মঘট পালন করছি। কোনো সহিংসতা ঘটাচ্ছি না। আমাদের যৌক্তি দাবি প্রশাসন মেনে নিলে রাস্তা থেকে সরে যাবো। নতুবা বৃহস্পতিবারের পর আরো বড় পরিসরে ধর্মঘট আহ্বান করা হতে পারে। নগরীর ব্যস্ততম কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল এলাকা দুইদিন ধরে নীরব রয়েছে। টার্মিনাল থেকে দূরপাল্লার কিংবা আন্তঃজেলার কোনো যাত্রীবাহী যানবাহন চলছে না। এতে অনেক যাত্রী টার্মিনাল এলাকায় অবস্থান নিলেও তারা গন্তব্যে যেতে পারেননি। কেউ কেউ গাড়ি না পেয়ে ফের বাসায় চলে যান।

সিলেট থেকে কোনো যানবাহন গত দুইদিন ধরে ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাচ্ছে না। হাজার হাজার বাস টার্মিনালেই নীরব দাঁড়িয়ে আছে। সিলেট-ঢাকা মিতালী রোড শ্রমিক উপ-কমিটির সভাপতি মো. রিয়াজ মিয়া জানিয়েছেন- ট্রাকের শ্রমিকদের ধর্মঘটে পাশে দাঁড়াতে তারা এই ধর্মঘটে সংহতি প্রকাশ করেছেন। এ কারণে বাস-মিনিবাস শ্রমিক নেতারা ধর্মঘটে একাত্ম থেকে কর্মসূচি পালন করছে। দাবি মেনে নিলে ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হবে। তবে- গতকাল বিকাল পর্যন্ত প্রশাসনের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে কার্যকর কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে না। আন্দোলনকারী মালিক ও শ্রমিকরা জানিয়েছে- পাথর কোয়ারি নিয়ে প্রশাসন নমনীয় না হলে তারা আন্দোলনে থাকবেন। শ্রমিকের দুঃখ লাঘবের জন্য তারা এই ধর্মঘট পালন করছে। বরং প্রশাসনের কর্মকর্তা বিষয়টি নিয়ে ছিনিমিনি করছেন বলে দাবি করেন তারা। এদিকে- পরিবহন ধর্মঘটের কারণে বিশেষ করে অফিস-আদালতগামী যাত্রীরা সবচেয়ে বেশি পড়েছেন বেকায়দায়। নির্ধারিত সময়ে অফিসে যেতে তারা বেশি দামে পাঠাও রাইডের মোটরসাইকেল ব্যবহার করছেন। সিলেটে এই পরিবহন ধর্মঘটের পাশাপাশি সিএনজি অটোরিকশা মালিক ও শ্রমিকদের আরো একটি ধর্মঘট চলছে। সিএনজি অটোরিকশা গ্রিল স্থাপন কার্যক্রম বন্ধসহ ৫ দফা দাবিতে তারা আন্দোলনে রয়েছে। এ কারণে এবারের পরিবহন ধর্মঘটে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে রয়েছেন যাত্রীরা। কার রাস্তায় সিএনজি অটোরিকশাও চলছে না। রোববার থেকে ধর্মঘটে যাচ্ছে পেট্রোল পাম্প মালিকরা: সিলেট বিভাগের তেলের পাম্পগুলোতে নিম্নমানের তেল সরবরাহ করায় অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম ডিলার্স, ডিস্ট্রিবিউটার্স এজেন্টস অ্যান্ড পেট্রোল পাম্প ওনার্স এসোসিয়েশন। আগামী রোববার সকাল থেকে ৬ দফা দাবিতে এই ধর্মঘটের ডাক দিয়েছেন ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ।

দাবিগুলো হচ্ছে, জ্বালানি তেল বিপণন কোম্পানি কর্তৃক নিম্নমানের পেট্রোল সরবরাহ বন্ধ করতে হবে এবং পূর্বের ন্যায় সিলেট গ্যাস ফিল্ড- এর উন্নতমানের পেট্রোল সরবরাহ করতে হবে। জ্বালানি তেলের মান নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সিলেটের প্রত্যেক ডিপোতে জ্বালানি তেল টেস্টিং ল্যাব স্থাপন করতে হবে। বিভিন্ন সরকারি সংস্থা কর্তৃক অন্যায় ও উদ্দেশ্যমূলক হয়রানি আচরণ বন্ধ করতে হবে। সরকারি অধিদপ্তর কর্তৃক পেট্রোল পাম্পে অভিযান পরিচালনাকালে এসোসিয়শনের প্রতিনিধি ও তেল বিপণন কোম্পানির প্রতিনিধির উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। সরকারি অধিদপ্তর কর্তৃক প্রদত্ত লাইসেন্সসমূহ নবায়ন সহজ করতে হবে। দুর্বৃত্ত পরায়ণ ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা আমিরুল ইসলাম মাসুদকে অবিলম্বে সিলেট থেকে প্রত্যাহার করতে হবে। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম ডিলার্স, ডিস্ট্রিবিউটার্স এজেন্টস অ্যান্ড পেট্রোল পাম্প ওনার্স এসোসিয়েশন সিলেট বিভাগের সাধারণ সম্পাদক জুবায়ের আহমদ চৌধুরী জানিয়েছেন- সিলেট গ্যাস ফিল্ডের উৎপাদিত তেল বিক্রি করে আসছিলাম দীর্ঘদিন থেকে। কিন্তু কয়েক মাস থেকে সিলেটের পাম্পগুলোতে গ্যাস ফিল্ডের তেল না দিয়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের তেল দেয়া হচ্ছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের তেল খুবই নিম্নমানের ও ভেজাল। যার কারণেই ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর অভিযান চালিয়ে আমাদের পাম্পগুলোতে জরিমানা করেছে।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn