আমার গ্রামের বাড়ি থেকে কেউ যখন ফোন করে বলে যে, খেয়ে না খেয়ে কাটছে তাদের জীবন; তখন একটি মুখ আমার চোখের সামনে ভেসে উঠে, সে মুখটি আমাদের খাদ্যমন্ত্রীর। আমার খুব অবাক লাগ; এ দেশের রাজনীতির বড় মানুষগুলো কিছুতেই স্বীকার করেন না যে, কোন সংকট এখানে আছে। অথচ আমার হাওরে বাড়ি, আমি জানি কী হচ্ছে অসহায় সেই মানুষগুলোর। কোনোদিন জুটে, কোনোদিন জোটে না খাবার। এভাবেই দিন কাটছে হাওরের বেশির ভাগ মানুষের। ফসলহারা বেশির ভাগ কৃষকের মুখে গত  ঈদে সেমাই-চিনি মুখে উঠেনি, এ আমার জানা কথা। মোটেই আনন্দ নেই হাওরবাসীর মনে, মলিনভাবে কাটছে তাদের জীবন।  আমার আশেপাশের গ্রামের কৃষকদের ধান হারানোর দুঃসহ যন্ত্রণা এখনো তাড়া করে বেড়াচ্ছে। তাদের চোখেমুখে এখনো অশ্রু। ধান হারানোর পর থেকেই ধারকর্জ-দাদনের ওপরে চলছে তাদের জীবন। আগাম বন্যায় তার সবকিছু পানির নিচে তলিয়ে গেছে। এখনো খেয়ে না খেয়ে দিন পার করছেন এসব পরিবার।

বাংলাদেশ খাদ্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ১৩ জুন পর্যন্ত মজুদের পরিমাণ এক লাখ ৯১ হাজার মেট্রিক টন চাল। যা গত ছয় থেকে সাত বছরের বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। ২০০৯-২০১০ অর্থবছরের এই সময়ে খাদ্যগুদামে চাল মজুদ ছিল পাঁচ লাখ ৪৬ হাজার মেট্রিক টন। যা চলতি বছরের তুলনায় তিন লাখ ৫৫ হাজার মেট্রিক টন বেশি ছিল। চাল সংকটে পড়েছে দেশ। খাদ্যগুদামে চালের মজুদও কমে গেছে।

কিন্তু আমাদের খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম সাহেব সবসময়ই বলে আসছেন, মজুদ ঠিক আছে। সরকারের মজুদ পরিস্থিতি সন্তোষজনক। তিনি  বলেছেন, দেশে কোন সংকট নেই। প্রচুর পরিমাণ  খাদ্য মজুদ রয়েছে। অহেতুক একটি ভুল খবর জনগনকে দিয়ে বিভ্রান্তি করার চেষ্টা চলছে। একটি কুচক্রি মহল খাদ্য সংকট দেখিয়ে দেশে অস্থিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করার পায়তারা করছে। তিনি আরও বলেছেন, হাওর অঞ্চলে প্রাকৃতিক দুর্যোগে বোরো আবাদের ক্ষতি হয়েছে। ব্লাষ্ট রোগ ও অতিবৃষ্টির ফলে ফসলের ক্ষতি হলেও দেশে খাদ্য সংকট কিংবা বিপর্যয় সৃষ্টি হবে না। কিছু ব্যবসায়ী কৃত্রিম খাদ্য সংকটের অপচেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু আসলেই কি তাই?

পত্রিকা পড়ে আমরা জেনেছি,  সরকারের হিসাবে হাওরের বন্যায় মাত্র ছয় লাখ টন বোরো ধান নষ্ট হয়েছে। এখন ছয় লাখ টন চাল আমদানি করলেই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাবে। তাই এই চাল আমদানির সিদ্ধান্তও নিয়েছে সরকার। তাছাড়া খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চলতি বোরো মৌসুমে ২২ হাজার ৪৬৩ চালকল মালিকের সঙ্গে চাল সংগ্রহের জন্য সরকার চুক্তি করে। চুক্তি অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সরকারি গুদামে আট লাখ মেট্রিক টন চাল সরবরাহ করার কথা রয়েছে চালকল মালিকদের। আবার আড়াই লাখ মেট্রিক টন চাল আমদানির সিদ্ধান্ত অনুমোদন করেছে সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি। ভিয়েতনাম থেকে আমদানি করা এ চালের মধ্যে ৫০ হাজার টন সিদ্ধ ও দুই লাখ টন আতপ চাল রয়েছে। প্রতিটন চাল আমদানি করা হবে ৪৭০ মার্কিন ডলার মূল্যে। আমদনি করা এ চালের দাম পড়বে  প্রতিকেজি এক ডলার ৮০ টাকা হিসাবে প্রতিকেজি চালের মূল্য দাঁড়ায় ৩৭ টকা ৬০ পয়সা।

হাওরের মানুষদের একদিকে খাদ্যের অভাব,  অন্যদিকে ঋণের চাপ। দিশেহারা হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ কাজের সন্ধানে পরিবার পরিজন নিয়ে ছুটছেন শহরের দিকে। সরকারিভাবে ওএমএস, ভিজিডি কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় তা অপ্রতুল। আর তেমন কেউ সেগুলো পাননি বোলেঈ আমরা জানি। বন্যা কবলিত এই সমস্ত জেলায় দেখা দিয়েছে খাদ্যাভাব। তার ওপর রয়েছে এনজিও ও মহাজনি ঋণের চাপ। সরকারি নিষেধাজ্ঞা মানছেন না এনজিও কর্মীরা। তারা ঋণের তাগিদ দিয়ে যাচ্ছেন বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের ওপর। ত্রাণের কথা শুনলে কিংবা বাইরে থেকে কোন নৌকা গেলেই নদীর পাড়ে ভিড় করেন অসহায় নারী, শিশু ও পুরুষ। হাওরাঞ্চলের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীর অনুপস্থিতি আশংকাজনক বেড়েছে। অথচ সরকার স্বীকারই করতে চায় না যে, চালের দাম ক্রেতার নাগালের বাইরে চলে গেছে। সরকার প্রতিকেজি চালের দাম নির্ধারণ করেছে ৩৪ টাকা। অথচ বাজারে দাম ৪৫ টাকার ওপরে। দামের জন্য মানুষ যদি না খেয়ে বা কম খেয়ে থাকে, তবে এটা কি খাদ্য সংকট নয়? খাবারের অভাবে মানুষ যদি কাতরায়, রাতভর না ঘুমিয়ে কাটায় তবে সেটা কী? সংকট আছে কিনা মাননীয় মন্ত্রী কি নিজের চোখে দেখে আসবেন একবার?

হাসান হামিদ-লেখক,গবেষক ও কবি।

 

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn