বার্তা ডেস্ক: দলে ‘চেইন অব কমান্ড’ নিয়ে চিন্তিত বিএনপির হাইকমান্ড। দলের ঐক্য ধরে রাখাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে দলটির। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল নেতাদের মধ্যে নানা ইস্যুতে আস্থার সংকট ভাবিয়ে তুলছে তাদের। এমন পরিস্থিতিতে দলের শৃঙ্খলা রক্ষায় হার্ডলাইনে হাইকমান্ড। কেউ দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গেলে কোনো ছাড় দেয়া হবে না। কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে। এর অংশ হিসেবে সম্প্রতি দলের প্রভাবশালী দুই ভাইস-চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ ও শওকত মাহমুদকে শোকজ করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ও অঙ্গসংগঠনের বেশকিছু নেতাকে মৌখিকভাবে সতর্ক করা হয়েছে। হাইকমান্ডের এমন সতর্কতা উপেক্ষা করে এরপরও কেউ শৃঙ্খলাবিরোধী কাজ করলে তাকে বহিষ্কারও করা হতে পারে। সূত্র জানায়, হার্ডলাইনে যাওয়ার আগে বিভিন্ন ইস্যুতে দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে সৃষ্ট দূরত্ব যাতে আর না বাড়ে সেদিকে গুরুত্ব দিয়েছে হাইকমান্ড। দলের ঐক্য ধরে রাখতে এবং নেতাদের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে পরামর্শ করা হচ্ছে।

জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে দলে ঐক্য রয়েছে। বিএনপিকে ভাঙতে সরকার নানা ষড়যন্ত্র করলেও তাতে সফল হয়নি। এত মামলা-হামলার পরও বিএনপির একজন নেতাও দল ছেড়ে যাননি। এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় সফলতা। তিনি বলেন- একটা কথা সবার মনে রাখতে হবে, বিএনপি উদারপন্থী রাজনৈতিক দল। এ ধরনের উদারপন্থী, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলে ছোটখাটো দু-একটা ঘটনা কোনো ঘটনাই নয়। এটাকে বড় করে যারা দেখছেন তারা ঠিকভাবে দেখছেন না।

সূত্র জানায়, দলের মধ্যে কোন্দল নিয়েই বেশি চিন্তিত হাইকমান্ড। গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে দলের সিনিয়র নেতারা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ছেন। ব্যক্তিস্বার্থকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে জড়িয়ে পড়ছেন বিবাদে। এছাড়া কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করেও তারা কোন্দলে জড়িয়ে পড়ছেন। যোগ্য ও ত্যাগীদের পরিবর্তে নিজেদের বলয়ের লোকদের গুরুত্বপূর্ণ পদে আনতে মরিয়া তারা। নিজেদের আখের গোছাতে গিয়ে জড়িয়ে পড়ছেন দ্বন্দ্বে। কমিটি গঠনের পাশাপাশি স্থানীয় সরকার নির্বাচনে মনোনয়ন ঘিরে অনেক এলাকায় কোন্দল ছড়িয়ে পড়ছে। আসন্ন পৌর নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন স্থানে একাধিক গ্রুপ মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে। প্রার্থী ঘোষণার পর অনেক স্থানেই বিদ্রোহ দেখা দিয়েছে। কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত অমান্য করে অনেকে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন। স্থানীয়দের অভিযোগ, ত্যাগী ও যোগ্য নেতাদের মনোনয়ন না দিয়ে সুবিধাবাদীদের মনোনয়ন দেয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। কেন্দ্রীয় অনেক নেতা তাদের নিজেদের পছন্দের প্রার্থী চূড়ান্ত করতে তৃণমূলে চাপ দিচ্ছেন। যা তৃণমূল নেতাকর্মীরা মেনে নিতে পারছেন না। ফলে সৃষ্টি হচ্ছে দ্বন্দ্ব।

সূত্র জানায়, কমিটি গঠন ও মনোনয়নকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট কোন্দলের পাশাপাশি সম্প্রতি দলের একটি অংশের ভূমিকা নিয়ে বেশ চিন্তিত হাইকমান্ড। বিশেষ করে সরকার পতনের আন্দোলনের নামে তৃতীয় পক্ষের সঙ্গে ওইসব নেতার যোগাযোগ ভাবিয়ে তুলছে। বেশ কিছুদিন ধরে দলের ওই অংশটি হাইকমান্ডের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে এসব কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। এ ব্যাপারে তাদের মৌখিকভাবে সতর্ক করা হলেও তা তেমন কাজে আসছে না। সর্বশেষ ১৪ ডিসেম্বর মুক্তাঙ্গনে সরকার পতনের আন্দোলনের নামে কিছু নেতাকর্মী অবস্থান নেন। ওই কর্মসূচিতে না যেতে সব স্তরের নেতাকর্মীকে দলের হাইকমান্ড থেকে কঠোর বার্তা দেয়া হয়। কিন্তু হাইকমান্ডের নির্দেশ অমান্য করে অনেকে সেখানে যান। কেউ কেউ উপস্থিত না থাকলেও পেছন থেকে কলকাঠি নাড়েন। বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন হাইকমান্ড। দলের স্থায়ী কমিটির কয়েক নেতা জানান, এ ঘটনাকে সহজভাবে নেয়নি হাইকমান্ড। তাদের ধারণা, বিগত ওয়ান-ইলেভেনের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে দলের মধ্যে কয়েক নেতা কাজ করছেন। তারা তৃতীয় কোনো শক্তির সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ রাখছেন। বিএনপির বর্তমান নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করে ওই অংশটি বিএনপির নামে ওই শক্তির সঙ্গে আঁতাত করছেন এমন অভিযোগও পাওয়া গেছে। সময়-সুযোগ বুঝে তারা বিএনপির বর্তমান নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়ার চিন্তাভাবনাও করছেন। এমন পরিস্থিতিতে দলের ঐক্য ধরে রাখতে কঠোর সিদ্ধান্ত নেয় হাইকমান্ড। ওই ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে দলের প্রভাবশালী দুই ভাইস-চেয়ারম্যানকে শোকজ করা হয়। এ শোকজের মধ্য দিয়ে ওই ঘটনার সঙ্গে জড়িত অন্য নেতাদের একটা বার্তা দেয়া হয়। শোকজের পর ওইসব নেতার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। এরপরও তারা দলের ভেতরে ভাঙনের চেষ্টা করলে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হতে পারে। প্রয়োজনে বহিষ্কার করা হতে পারে প্রভাবশালী কয়েক নেতাকেও। দলের এমন কঠোর অবস্থানের পর ওইসব নেতা কিছুটা পিছু হটেছেন বলে মনে করছেন নীতিনির্ধারকরা।

এদিকে দলের দুই ভাইস-চেয়ারম্যানকে শোকজ করা নিয়েও চলছে অস্থিরতা। শোকজ ও তার জবাব দেয়ার বিষয়টি গণমাধ্যমে আসা নিয়ে অনেকে অস্বস্তি প্রকাশ করেছেন। এর ফলে দলের ইমেজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে মনে করেন তারা। শোকজ নিয়ে এভাবে প্রকাশ্য বিবাদে জড়িয়ে পড়ায় নেতাকর্মীদের মধ্যেও সৃষ্টি হয়েছে ক্ষোভ। তাদের অনেকে মনে করেন, শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে কোনো এক নেতাকে শোকজ করা যেতেই পারে। কিন্তু এ ব্যাপারে দলের গঠনতন্ত্র মেনে করা উচিত। ভাইস-চেয়ারম্যানকে কিভাবে সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব স্বাক্ষরিত চিঠিতে শোকজ করা হয়- তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তবে দলের আরেকটি অংশ মনে করে- এ নিয়ে নেতাদের মধ্যে প্রকাশ্য বিবাদে জড়িয়ে পড়া উচিত হয়নি। কারণ, দলের হাইকমান্ডের নির্দেশ ছাড়া সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর পক্ষে কাউকে শোকজ করা সম্ভব নয়। এছাড়া শোকজের জবাব প্রকাশ্যে গণমাধ্যমে আসাটাও সমীচীন হয়নি। এতে দলের ঐক্যের চেয়ে অনৈক্যই আরও বাড়বে।

শুধু কেন্দ্রীয়ভাবে নয়, তৃণমূলেও যাতে চেইন অব কমান্ড থাকে সেদিকেও বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে দলটি। হাইকমান্ডের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে কোনো নেতা যাতে কিছু না করে সে ব্যাপারে কঠোর বার্তা পাঠানো হয়েছে। দলের শৃঙ্খলাবিরোধী কাজে যুক্ত হলে তাদের বহিষ্কার করা হবে বলেও সতর্ক করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে হাইকমান্ডের এমন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নও শুরু হয়েছে। দলের সিদ্ধান্তের বাইরে যারা পৌরসভা নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন তাদের কোনো ছাড় দেয়া হচ্ছে না। প্রথমে তাদের নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার অনুরোধ করা হচ্ছে। কিন্তু যারা শেষপর্যন্ত দলের সিদ্ধান্ত মানছেন না তাদের করা হচ্ছে বহিষ্কার। গত কয়েক দিনে তৃণমূলের বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এর মধ্যে আছেন- কুড়িগ্রাম জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি আবু বকর সিদ্দিক, চুয়াডাঙ্গা বিএনপির যুগ্ম-আহ্বায়ক মুজিবুল হক মালিক মজু, দিনাজপুর জেলার ফুলবাড়ি উপজেলা বিএনপির সভাপতি খুরশীদ আলম মতি।

জানতে চাইলে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, বিএনপি একটি সুশৃঙ্খল দল। তবে কেউ শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ড করলে তার বিরুদ্ধে শাস্তির বিধান দলের গঠনতন্ত্রে আছে। কেউ গঠনতন্ত্রবিরোধী কাজ করলে অতীতে ব্যবস্থা নিয়েছি, বর্তমানে নিচ্ছি এবং ভবিষ্যতেও নেব।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn