সম্মেলনের মাধ্যমে আংশিক কমিটি ঘোষণার ছয় মাস পর পূর্ণাঙ্গ কমিটি পেতে যাচ্ছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) শাখা ছাত্রলীগ। কমিটির খসড়া তালিকা নিয়ে তা অনুমোদনের জন্য কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগে জমা দিতে ঢাকায় অবস্থান করছেন রাবি শাখার নেতারা। তবে খসড়া তালিকায় উপরের সারির বেশিরভাগ গুরুত্বপূর্ণ পদে রাখা হয়েছে ছাত্রদল, শিবিরের অনুপ্রবেশকারী, অছাত্র, বিবাহিত ও বিতর্কিতদের। অভিযোগ উঠেছে- ‘খসড়া তালিকা অনুযায়ী কমিটি অনুমোদন হলে সেটা ছাত্রলীগের কমিটি নয়, অনুপ্রবেশকারীদের কমিটিতে পরিণত হবে।’ ১৩ সদস্যের আংশিক কমিটির অন্তত ৮ নেতা এমন অভিযোগ করেছেন। কমিটির খসড়া তালিকা করার সময় তাদের কোনো মতামতও নেয়নি সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। একই অভিযোগ সংগঠনের স্বচ্ছ ইমেজধারী ও ত্যাগী অর্ধশত কর্মীরও।

জানা গেছে, গত বছরের ৮ ডিসেম্বর রাবি শাখার সম্মেলন করে তিনদিন পর ১১ ডিসেম্বর ১৩ সদস্যের আংশিক কমিটি ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। আংশিক কমিটিকে দ্রুত কমিটি পূর্ণাঙ্গ করতে খসড়া তালিকা কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগে পাঠানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়। কিন্তু ছয় মাসেও তা করতে ব্যর্থ হয় রাবি ছাত্রলীগ। ২২ মে রাজশাহীতে বিভাগীয় প্রতিনিধি সম্মেলনে রাবি সভাপতি গোলাম কিবরিয়া ও সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ রুনুকে কমিটি পূর্ণাঙ্গ করতে না পারায় শাসায় কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ। একপর্যায়ে তারা ৫ জুনের মধ্যে খসড়া তালিকা নিয়ে ঢাকায় যেতে নির্দেশ দেয়। নির্দেশনা অনুযায়ী রাবি ছাত্রলীগের সভাপতি ও সম্পাদক খসড়া তালিকা কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে জমা দিয়েছেন। ছাত্রলীগের বিশ্বস্ত সূত্র জানায়, ৭ জুন রাতে পূর্ণাঙ্গ কমিটি অনুমোদন করাতে খসড়া কমিটি নিয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগে জমা দিতে ঢাকা গেছেন রাবি সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক।

খসড়া ওই কমিটিতে বিতর্কিতদের মধ্যে রাখা হয়েছে- মাহফুজুর রহমান এহসান, সাইফ করিম রুপম, মাহফুজ আল আমিন, মিজানুর রহমান সিনহা, তাওশিক তাজ, মুশফিক তাহমিদ তন্ময়, সজীব হোসেন, হিরোক, আবু খায়ের মোস্তফা রিনেট, এরশাদুর রহমান রিফাত, রবিউল আওয়াল মিল্টন, সুরঞ্জিত প্রসাদ বৃত্ত, গোলাম সারওয়ার, অনিক মাহমুদ বনি, বায়োজিদ আহমেদ, মামুন-অর-রশীদ (হবিবুর হল), আরিফ বিন জহির, রেজয়ানুল হক হৃদয়, শরীফুল সনেট প্রমূখ।

সভাপতির ঘনিষ্ঠ ভুগোল ও পরিবেশ বিদ্যা বিভাগের মাহফুজুর রহমান এহসান ২০১৪ সাল পর্যন্ত ছাত্রদলের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিল। নাশকতার মামলায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক থেকে গ্রেফতার হয়ে প্রায় তিন মাস জেলও খেটেছেন। নিজ বিভাগের ছাত্রীর করা নারী ও শিশু নির্যাতন মামলার আসামি সে। ওই ছাত্রী এহসানের বিরুদ্ধে নগরীর মতিহার থানায় জিডি ও রাবির যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন নিরোধ সেলে লিখিত অভিযোগও দেয়। ছাত্রদল ও নারী নির্যাতন মামলা থেকে বাঁচতে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর ছাত্রলীগে অনুপ্রবেশ করে এহসান। ছাত্রলীগে এসেও অপহরণ করে চাঁদাবাজির দায়ে ছাত্রলীগ থেকে বহিস্কার হয় সে। অথচ আংশিক কমিটির তিনজন সহ-সভাপতির পরই খসড়া তালিকায় সহ-সভাপতি পদে তার নাম রেখেছে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা।

খসড়া কমিটিতে সহ-সভাপতি পদে নাম থাকা সাইফ করিম রুপমও সভাপতি গোলাম কিবরিয়ার ঘনিষ্ঠ সহচর। বগুড়ার ছেলে রুপম ৫ জানুয়ারি আগে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরোধীতা করে ছাত্রদলের নিয়মিত মিছিল সমাবেশে সক্রিয় ছিল।

অথচ রাবি ছাত্রলীগে প্রথম সারির নেতাদের মধ্যে এখন তার অবস্থান। রাবির ম্যাটেরিয়াল সায়েন্সে ২০১১-১২ সেশনে ভর্তি হলেও দুই বছর আগে ড্রপ আউট হয়ে ছাত্রত্ব হারিয়েছে রুপম। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তার পদ পাওয়া কথা নয়। অথচ তার নাম সহ-সভাপতির তালিকায়। তার মতই ছাত্রত্ব হারালেও কমিটিতে পদের দৌঁড়ে এগিয়ে ইনফরমেশন সায়েন্স অ্যান্ড লাইব্রেরি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ থেকে ড্রপ আউট হওয় সুরঞ্জিত প্রসাদ বৃত্ত।

বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী তওশিক তাজ ও শরীফুল সনেটও সভাপতির অনুসারী। তারা দু’জন অপহরণ মামলার আসামি ছিলেন। ওই ঘটনায় তাদেরকে রাবি ছাত্রলীগ থেকে বহিস্কার করা হয়। এছাড়া তাজের বিরুদ্ধে গত ৭ মাসে দুই শিক্ষার্থীকে বেধড়ক মারপিঠের অভিযোগ রয়েছে। সভাপতির ঘনিষ্ঠ মিজানুর রহমান সিনহা পড়ালেখা শেষ। তিনি বিয়ে করেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।

আরেক বিতর্কিত পদপ্রার্থী গোলাম সারওয়ারও সভাপতির অনুসারী। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ- দলীয় নেতাকে মারধর, ছিনতাই, ক্যাম্পাসে বহুল পরিচিত ‘সিস্টেমবাজি’তেও অভ্যস্ত তিনি। আর মাহফুজ আল আমিনের বিরুদ্ধে অভিযোগ- ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে পূর্বে শিবিরের সঙ্গে লিঁয়াজো করার। এছাড়া কিবরিয়া-রুনু কমিটি হওয়ার পর হঠাৎ ছাত্রলীগে সক্রিয় হয়ে ওঠেন তিনি। দলে হাইব্রিড বলে পরিচিত মাহফুজ আল আমিন।

সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ রুনুর ঘনিষ্ঠ আইন বিভাগের শিক্ষার্থী সজীব হোসেন। বঙ্গবন্ধু হল থেকে ২০১৩ সালে ল্যাপটপ চুরির অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। পরে ২০১৫ সালে তুচ্ছ কারণে গণশিল্পী সংস্থার রাবি শাখার সভাপতি বাসুদেবকে পিটিয়ে পা ভাঙার ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাময়িক বহিস্কার হয় সজীব। পরে ভুক্তভোগীকে ভয়ভীতি দেখিয়ে প্রশাসনের মাধ্যমে তা প্রত্যাহার করিয়ে নেয় ছাত্রলীগ।

রুনুর অনুসারী আবু খায়ের মোস্তফা রিনেট ও হিরোক অস্ত্র মামলায় গ্রেফতার হয়। হিরোক ওই মামলায় এখনও আসামি। আর রিনেট ছাত্রদল কর্মী ছিলেন। বিএনপি নেতা মিজানুর রহমান মিনুর হাত থেকে ফুল নিচ্ছেন -এমন ছবিও গণমাধ্যমে প্রকাশ হয় ‘শর্ষের মধ্যে ভূত’ শিরোনামে।

রুনুর আরেক ঘনিষ্ঠ সহচর এরশাদুর রহমান রিফাত চাঁদাবাজির দায়ে ছাত্রলীগ থেকে বহিস্কার হন। ২০১৫ সালে ঢাকা থেকে রাবিতে বেড়াতে আসা এক শিক্ষার্থীকে জোর করে বিয়ে দিয়ে ২৪ ঘণ্টা আটকে রাখা নির্যাতনে নেতৃত্ব দেয় রিফাত। আর দর্শন বিভাগের রবিউল আওয়াল মিল্টন নিজ বিভাগের ছাত্রীকে যৌন হয়রানির দায়ে অভিযুক্ত হয়ে মুচলেকা নিয়ে ছাড়া পান। একটি জাতীয় দৈনিকের রাবি প্রতিনিধিকে মারধরের দায়ে দল থেকে তাকে বহিস্কার করা হয়।

এছাড়া বিতর্কিত অন্যদের মধ্যে অনিক মাহমুদ বনি বহিস্কৃত, মুশফিক তাহমিদ তন্ময় মাদকসহ গ্রেফতার হয়েছিল, আরিফ বিন জহির ও রেজয়ানুল হক হৃদয় দলীয় কর্মীকে মারধরের দায়ে বহিস্কার, বায়োজিদ আহমেদ ছাত্রদল কর্মী, মামুন-অর-রশীদ রাবির প্রধান প্রকৌশলীকে মারধরের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থায়ী বহিস্কৃত। জানতে চাইলে রাবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ রুনু বলেন, খোঁজ-খবর নিয়ে আমরা পূর্ণাঙ্গ কমিটির খসড়া তালিকা করেছি। অনুপ্রবেশকারী ও বিতর্কিতরা যাতে পদে না আসতে পারে সে ব্যাপারে সচেতন আছি। জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ বলেন, অনুপ্রবেশকারী অছাত্র ও বিতর্কিতরা কেউ-ই পদে আসতে পারবে না। খসড়া তালিকা যাচাই-বাছাই করে কমিটি দেওয়া হবে।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn