মো. মশিউর রহমান::সুরমা নদীর তীরে সুনামগঞ্জ শান্ত, সুন্দর, ছোট্ট একটি শহর। হাওরের রাজধানী, মরমী কবিদের তীর্থ স্থান এ শহরকে জোসনার শহর হিসেবে সবার কাছে তুলে ধরেছিলেন সবার প্রিয়, তিনবারের নির্বাচিত জনপ্রিয় প্রয়াত পৌর চেয়ারম্যান কবি মমিনুল মউজদীন। তিনি ১৯৫৫ সালের ২৯ শে আগষ্ট সুরমা নদীর তীরবর্তী সাহেব বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি হাছন রাজার প্রপৌত্র। রাজ পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও তাঁর চলাফেরা ছিল সাধারণের মত। মরমী কবি হাসন রাজার প্রভাবে প্রভাবিত কবি মউজদীনের ছোটবেলা থেকেই ছিল শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির সাথে সখ্যতা। জুবিলী স্কুলে পড়াকালীন পাঠ্যবইয়ের বাহিরে বই পড়ায় মনযোগি হন। সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজে পড়ার সময় তিনি লেখালেখিতে মনযোগ দেন। সাহিত্য চর্চার পাশাপাশি রাজনীতি সচেতন এই ব্যক্তিটি ছাত্র জীবন থেকেই সক্রিয় ভাবে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। তিনি জানতেন রাজনীতির মাধ্যমেই মানুষের অধিকার আদায় সম্ভব। মানুষকে তিনি ভাল ভাবেই বুঝতে পারতেন। সবাইকে কাছে টানার এক সহজাত প্রবৃতি তাঁর ছিল। ছিল সম্মোহনী শক্তি। মোহনীয় হাসি দিয়ে মুগ্ধ করতেন সবাইকে। সকল শ্রেণির লোকজনই তাঁকে আপন ভাবত। তাইতো তিনি সুনামগঞ্জ শহরের সবার আপনজন ছিলেন। ছিলেন আমৃত্য অভিভাবক। মনযোগ দিয়ে সবার কথা শুনতেন। কাউকে অসস্তুষ্ট করে বিদায় দিতেন না। শহরের সকল সামাজিক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তাঁর সরব উপস্থিতি ছিল। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সামাজিক অন্দোলন গড়ে তোলতেন। দুর্নীতির সাথে জড়িত থাকার জন্যে এক সময়ের জেলা প্রশাসককে তাঁর নেতৃত্বে সামাজিক আন্দোলনের ফলে সুনামগঞ্জ থেকে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। জুবিলী স্কুলের শিক্ষার্থী হিসেবে আমিও সে আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলাম। সাহিত্য জগতে কবিতাই ছিল তাঁর ধ্যান জ্ঞান। তিনি কবিতার মাধ্যমে তুলে ধরেছেন প্রিয় সুনামগঞ্জকে। তাঁর কবিতায় পাওয়া যায় মাটি, মানুষ ও প্রকৃতির কথা। মানুষের ভালবাসার কথা। সুনামগঞ্জই তাঁর প্রিয় স্থান। এ শহরকে ছেড়ে অন্য কোথাও থাকার কথা তিনি চিন্তাই করতে পারেন না। ‘ভালবাসার শহর’ শিরোনামে কবিতায় তিনি লিখেছেন
এ শহর ছেড়ে আমি পালাবো কোথায়
যে দিকে তাকাই দেখি সারাটি ভূবনময়
আলো আর মৃত্তিকার বুকের ভিতর
তোমার দু’ চোখ
সুরভিত শস্যময় সজল দু’ চোখ।
জোসনার কবি ভরা পূর্নিমার জোসনাকে বেশ উপভোগ করতেন। এ জোসনায় অবগাহন করতে অন্যদেরকেও উৎসাহিত করতেন। তাই ১৯৯৩ সালে প্রথম বার পৌর চেয়ারম্যান নির্বাচিত হবার পর জোসনার আনন্দ উৎসব করেছিলেন তিনি। পূর্ণিমা রাতে রাস্তার লাইট নিভিয়ে নগরবাসীকে জোসনা উপভোগ করার সুযোগ করে দিতেন। কবি মউজদীনের জোসনা বিলাসের বিষয়টি মিডিয়ার মাধ্যমে দেশবাসী জেনে যায়। তখন থেকেই সুনামগঞ্জ শহর জল জোসনার শহর। জোসনা উপভোগ করতে ঢাকা থেকে অনেক কবি সাহিত্যিকগন সুনামগঞ্জ ছুটে আসতেন। এখনও এ ধারা অব্যাহত রয়েছে। এখন ভরা পূর্ণিমায় শহরে রাস্তার লাইট বন্ধ না হলেও শহরের জোসনা প্রিয় লোকজন এটাকে বেশ উপভোগ করেন। সাথে সাথে কবি মউজদীনকে স্মৃতিতে নিয়ে আসেন। কবি মমিনুল মউজদ্দিনের জোসনা বিলাসকে স¥রণ করতে কিছুদিন পূর্বে সুনামগঞ্জের বর্তমান পৌর মেয়র নাদের বখত শহরের রাস্তার বাতি নিভিয়ে সুরমার নদীর পাড়ে রিভার ভিউতে শহরের লোকজনকে নিয়ে জোসনা উপভোগ করেন। রাজনৈতিক পরিমন্ডল থেকে শত ব্যস্ততার মধ্যেও কাব্যিক জগতে তাঁর সদা বিচরণ ছিল। মরমী কবিদের তীর্থস্থান খ্যাত সুনামগঞ্জের সংস্কৃতিমনা এই মানুষটি হাসন রাজার সুযোগ্য উত্তরসুরী হিসেবে নিজ শহরে ব্যাপক পরিসরে হাসন উৎসবের আয়োজন করেন। বই পড়তে ও কবিতা লিখতে ভালবাসতেন। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতার বই “এ শহর ছেড়ে আমি পালাবো কোথায়” প্রকাশিত হয় ১৯৯৮ সালে একুশে বই মেলায়। দ্বিতীয় প্রকাশিত গ্রন্থ ‘হৃদয় ভাঙ্গার শব্দ’। সবার প্রিয় এই মানুষটি নিজ শহরটিকে কবিতার শহর ভাবতেন। প্রতিনিয়ত স্বপ্ন দেখতেন। হয়ত সেই স্বপ্ন দেখতে দেখতেই ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর বৃহস্পতিবার ঢাকা থেকে স্বপরিবারে নিজ শহর সুনামগঞ্জে ফিরছিলেন। নিজ বাসায় আর ফেরা হয়নি তাঁর । মৃত্যু তাঁকে কেড়ে নেয়। ঢাকা সিলেট সড়কের ব্রাম্মণবাড়িয়ার সরাইলের কাছাকাছি সড়কে দুপুর একটায় তাঁকে বহনকারী প্রাইভেট কারটি র্দূঘটনার কবলে পড়ে। সাথে সাথেই স্ত্রী, সন্তান সহ তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। ভাগ্য গুনে বেঁচে যান কবি পুত্র ফিদেল নাহিয়ান। একজন আলোকিত মানুষের বিদায়ে শহরবাসী স্তব্ধ হয়ে যায়। স্বজন হারা ব্যাথায় সবাই ব্যথিত হয়। একজন মানুষ যে দল মত নির্বিশেষে সবার এত প্রিয় হতে পারেন, তাঁর মৃত্যুর দিনই সেটা প্রমাণিত হয়েছিল। মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে বিশ্বম্ভরপুর একটি রাজনৈতিক জনসভা শেষ করে আমার কর্মস্থল সরকারি দিগেন্দ বর্মন কলেজ গেইট দিয়ে যাওয়ার সময় কলেজে প্রবেশ করেন। শিক্ষক মন্ডলীদের সাথে আলাপকালে কলেজের লাইব্রেরির খোঁজ নেন। পরে নিজ দায়িত্বে কলেজ লাইব্রেরিতে তারঁ প্রতিশ্রুত পাঁচ হাজার টাকার বই অধ্যক্ষ বরাবারে পাঠিয়ে দেন। যে কোন আলোচনায় সাহিত্য প্রসঙ্গ চলে আসলেই তিনি জমিয়ে ফেলতেন। ডুবে থাকতেন সাহিত্য জগতে। মৃত্যুর সপ্তাহ পূর্বে সদ্য বিবাহিত স্ত্রীকে নিয়ে বিশেষ কাজে আমি তাঁর সাথে দেখা করতে যাই। বাসায় গিয়ে জানতে পারলাম তিনি বাসায় নেই। কেয়ারটেকার ফোনে তাঁকে আমাদের কথা জানালেন। তিনি কেয়ারটেকারকে আমাদেরকে বসতে বলার জন্যে বললেন। কিছুক্ষণ পর তিনি এসে পৌছলেন। ড্রয়িংরুমে আমরা তিন জন বসেই কথা বলছিলাম। আমার স্ত্রী বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর শেষ করেছে জেনে খুশি হলেন। আমার শ্বশুর বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন এটাও বললেন। এর পর শুরু হয়ে গেল সাহিত্য আড্ডা। প্রসঙ্গ কবিতা। টেনে নিয়ে আসলেন জীবনানন্দ দাসকে। পাশপাশি সাহিত্যের নানান দিক নিয়ে আলোচনা। কেয়ারটেকারকে বললেন চা, বিস্কুট, ও চিপস নিয়ে আসার জন্যে। চা বিস্কুট খেলাম। অনুরুধ করলেন চিপস খাওয়ার জন্যে। বললেন এটা দেশের বাহিরের চিপস। খুবই টেস্টি। টেস্ট করে দেখুন। আমার স্ত্রী আজও গল্পটি করে। সৃষ্টিশীল, আলোকিত এই ব্যক্তিটির ১২তম মৃত্যু বার্ষিকী আজ। দিন, মাস, বছর, পেরিয়ে যাচ্ছে। চলে যাবে যুগের পর যুগ। একজন কবি মউজদীনের কবিতা, মানুষের প্রতি তাঁর ভালবাসা, প্রেম মনকে ছুঁয়ে যাবে বার বার। সবার ভালবাসা নিয়ে তিনি বেঁচে থাকবেন তাঁর কবিতায় পাঠকের হৃদয়ে। আজকের এই দিনে কবি মউজদীনের প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।
লেখক- প্রভাষক, ইংরেজি, সরকারি দিগেন্দ্র বর্মন কলেজ, বিশ্বম্ভরপুর, সুনামগঞ্জ।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn