মুক্তিযুদ্ধের সম্মুখসমরে পা হারানো একজন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার লে. কর্নেল এম এ তাহের। ৪১ বছর আগে বিশেষ সামরিক ট্রাইব্যুনালের গোপন বিচারে ১৯৭৬ সালের ২১ জুলাই এই মুক্তিযোদ্ধাকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। কার্যকরের সাড়ে তিন দশক পর ২০১১ সালের ২২ মার্চ এক রায়ে কর্নেল তাহের ফাঁসিকে ‘ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা’ বলে অভিহিত করে হাইকোর্ট। কর্নেল তাহেরকে শহীদের মর্যাদা দেওয়ার পাশাপাশি তার পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করতে নির্দেশও দেন আদালত।

ফিরে দেখা

১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে ও সহযোগিতায় কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে সিপাহি-জনতার গণ-অভ্যুত্থান সূচিত হয়। বিশেষ সামরিক ট্রাইব্যুনালের গোপন বিচারে ১৯৭৬ সালের ১৭ জুলাই কর্নেল তাহেরসহ ১৭ জনকে সাজা দেওয়া হয়। এরপর ২১ জুলাই ভোররাতে কর্নেল তাহেরের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। কর্নেল তাহেরের মৃত্যুর ৩৪ বছর পর গোপন বিচারের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করেন কর্নেল তাহেরের ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আনোয়ার হোসেন, তাহেরের স্ত্রী লুৎফা তাহের এবং সামরিক আদালতের বিচারে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ফ্লাইট সার্জেন্ট আবু ইউসুফ খানের স্ত্রী ফাতেমা ইউসুফ।

এর পেক্ষিতে শুনানি শেষে ২০১১ সালের ২২ মার্চ রায় দেন বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ। রায়ে বলা হয়, তাহেরকে যে আইনে বিচার করে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়, সে আইনে ওই সময় মৃত্যুদণ্ডের কোনো বিধান ছিল না। মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পর ’৭৬-এর ৩১ জুলাই মৃত্যুদণ্ডের বিধান করা হয়। তথাকথিত ওই আদালতের বিচারক আবদুল আলী ও অন্যরা বলেছেন, বিচারের সময় তাদের সামনে কোনো কাগজ বা নথিপত্র ছিল না। এ ছাড়া আসামিরা জানতেন না যে তাদের বিরুদ্ধে কী অভিযোগ। তাদের পক্ষে বক্তব্য দিতে কোনো আইনজীবীও নিয়োগ দেওয়া হয়নি। এসব বিবেচনায় ট্রাইব্যুনাল ও এর কার্যক্রম ছিল অবৈধ।

রায়ে বলা হয়, কর্নেল তাহেরের তথাকথিত ওই বিচার সংবিধানের ২৭, ২৯, ৩০, ৩২, ৩৩ ও ৩৫ অনুচ্ছেদ ও সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার পরিপন্থী। রায়ে আরও বলা হয়, তাহেরের তথাকথিত বিচার ও ফাঁসি ছিল ঠান্ডা মাথার হত্যাকাণ্ড। ওই বিচার ও হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন জিয়াউর রহমান। জিয়া জীবিত না থাকায় তার বিচার সম্ভবপর না হলেও সরকারের উচিত হবে এই হত্যার জন্য দায়ী কেউ জীবিত থাকলে তাকে খুঁজে বের করে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত করা। কর্নেল তাহেরের দেশদ্রোহের অভিযোগ মুছে দিয়ে মহান দেশপ্রেমিক হিসেবে চিহ্নিত করে শহীদের মর্যাদা দিতে নির্দেশ দেন আদালত। একই সঙ্গে তাহেরের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করতে নির্দেশও দেন আদালত।

কর্নেল এম এ তাহের

১৯৩৮ সালের ১৪ নভেম্বর ভারতের আসামের বদরপুরে জন্মগ্রহণ করেন কর্নেল এম এ তাহের। তার পৈতৃক নিবাস নেত্রকোনার পূর্বধলা উপজেলার কাজলা গ্রামে। তার বাবার নাম মহিউদ্দিন আহমেদ এবং মায়ের নাম আশরাফুন্নেসা।  কর্নেল তাহেরের শিক্ষাজীবন শুরু হয় চট্টগ্রামের ফতেহাবাদ স্কুল থেকে। সিলেটের এমসি কলেজ থেকে স্নাতক পাস শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে স্নাতকোত্তর শ্রেণীতে ভর্তি হন ১৯৬০ সালে। ওই বছর সেনাবাহিনীতে যোগ দেন।

১৯৬১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে অফিসার হিসাবে কর্নেল তাহেরের কর্মজীবন শুরু হয়। ১৯৬২ সালে কমিশনপ্রাপ্ত হন তিনি। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে কর্নেল তাহের পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে চলে আসেন। ১১ নম্বর সেক্টরের তিনি ছিলেন সেক্টর কমান্ডার। জামালপুরে পাকিস্তানি সেনাঘাঁটিতে আক্রমণ পরিচালনার সময় আহত হন। পরবর্তী সময়ে ‘বীর উত্তম’ খেতাব পান। সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ করে ১৯৭২ সালের অক্টোবর মাসে সক্রিয় রাজনীতিতে অংশ নেন কর্নেল তাহের।  ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর তিনি সিপাহি-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে অংশ নেন। ১৯৭৫ সালের ২৪ নভেম্বর গ্রেফতার হন কর্নেল তাহের। ১৯৭৬ সালের ২১ জুলাই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে তার ফাঁসি হয়।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn