মরতুজা আহমদ- তথ্য অধিকার মানুষের মৌলিক স্বাধীনতা, মানবাধিকার, আইনের শাসন, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার, বৈষম্য দূরীকরণ; সুশাসন তথা স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও দায়িত্বশীলতা আনয়ন; দুর্নীতি হ্রাস, জনগণের ক্ষমতায়ন ও গণতন্ত্রকে সুসংহত করে। চিকিৎসাসহ সংবিধানে বর্ণিত সব মৌলিক অধিকার পূরণে সর্বাগ্রে প্রয়োজন জনগণের তথ্যে আবশ্যিক অভিগমন। তথ্য অধিকার রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানকে জনগণের প্রতি সংবেদনশীল করে তুলে, আস্থার সম্পর্ক স্থাপন করে। ‘তথ্য অধিকার সংকটে হাতিয়ার’- ২০২০ সালে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক তথ্য অধিকার দিবস পালনের মূল প্রতিপাদ্য নির্ধারিত হয়েছে। এবার এমন সময় দিবসটি পালিত হচ্ছে যখন সারাবিশ্ব করোনাভাইরাস মহামারিতে আক্রান্ত। বলা বাহুল্য, করোনা সংকট উত্তরণে ইউনেস্কোর অনুসরণে আমাদের এবারের প্রতিপাদ্য নিঃসন্দেহে তাৎপর্যমণ্ডিত ও সময়োপযোগী। উল্লেখ্য, অবাধ তথ্যপ্রবাহ রচনা, তথ্যে সর্বজনীন প্রবেশাধিকার, তথ্য অধিকার সম্পর্কে ব্যাপক জনসচেতনতা বৃদ্ধি করাই দিবসটি পালনের মূল উদ্দেশ্য।
করোনাকালে বিশ্ববাসী উপলব্ধি করেছে, সঠিক ও সময়োচিত তথ্য কীভাবে মানুষের জীবন-মৃত্যুর নিয়ামক হতে পারে। করোনার ভয়াল থাবা থেকে জীবনকে নিরাপদ রাখতে, স্বাস্থ্যবিধি জানতে, বুঝতে এবং তা মেনে চলার অভ্যাস গড়ে তুলতে এ-সংক্রান্ত জরুরি ও সাধারণ তথ্যাদি জনগণের জন্য সহজ ও বোধগম্য করে তোলা অত্যন্ত জরুরি। মাস্ক পরিধান, সাবান দিয়ে ঘন ঘন হাত পরিস্কার করা, সামাজিক দূরত্ব মেনে চলতে জনগণকে উদ্বুদ্ধকরণে অবাধ তথ্যপ্রবাহ ও তথ্যে অভিগমনের গুরুত্ব অপরিসীম। আপনজনকে হারিয়ে আমরা বুঝেছি আক্রান্ত ব্যক্তিকে কত তাড়াতাড়ি চিকিৎসার আওতায় আনা ও দ্রুত সর্বোচ্চ চিকিৎসা প্রদান নিশ্চিত করা প্রয়োজন ছিল। তার দ্বারা অন্যদের সংক্রমিত হওয়ার পর আমাদের বোধগম্য হয়েছে সঠিক সময়ে তথ্য পেলে, জানলে এবং তা পালন করলে ব্যাপকভাবে সংক্রমণ ঠেকানো সম্ভব ছিল। এখনও আমরা অনেকেই বিশ্বব্যাপী করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের খবর রাখি না। এজন্য এ সংকটে সংশ্নিষ্ট সব কর্তৃপক্ষের প্রয়োজন জরুরি সেবা ও স্বাস্থ্যবিধির সব তথ্য জনগণের কাছে অবারিত করা ও রাখা, এগুলো পালনে জনগণকে উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করা এবং এ ধারা অব্যাহত রাখা। হাসপাতালে তো বটেই, ঢাকাসহ অন্যান্য শহরে অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা বিনামূল্যে বা কম মূল্যে করোনা চিকিৎসা ও সেবা দিয়ে যাচ্ছে- এ তথ্য ভুক্তভোগীর কাছে আছে কি? অজানা ভাইরাসের সংকট মোকাবিলায় চিকিৎসা, স্বাস্থ্যসহ অপরাপর মৌলিক অধিকার নিশ্চিতকরণে, আর্থসামাজিক নিরাপত্তা বিধানে টেকসই কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়নে, জনগণের জন্য গৃহীত প্রণোদনা ও সহায়তার বিভিন্ন প্যাকেজের তথ্য তাদের কাছে অবারিতকরণে, ঘোষিত সুবিধাদিতে প্রকৃত উপকারভোগীর অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণে সঠিক ও সময়োচিত তথ্য প্রদানের বিয়য়টি অতীব গুরুত্বপূর্ণ। সঠিক ও সময়োচিত চিকিৎসা গ্রহণ ও প্রদানে, নমুনা পরীক্ষায়, মানসম্মত চিকিৎসা সামগ্রীর সময়োচিত এবং যথাযথ সরবরাহ ও ব্যবহারে, এক কথায় চলমান ও সব ভবিষ্যৎ কর্মকাণ্ডের তথ্যে জনগণের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা ও অব্যাহত রাখা একান্ত আবশ্যক। এতে সংকটে মানুষের শুধু জীবন রক্ষাই সহজ হবে না, জনস্বাস্থ্য নিরাপদ থাকবে, অন্যান্য মৌলিক অধিকার নিশ্চিত হবে। অন্যদিকে বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের স্বচ্ছতা, জবাবদিহি নিশ্চিত হবে, দুর্নীতি হ্রাস পাবে, সুশাসন বজায় থাকবে, সংকট মোকাবিলায় রাষ্ট্র ও জনগণের আস্থার সম্পর্ক সমুন্নত থাকবে। তাছাড়া গুজব, ভুল-বানোয়াট তথ্য জনগণকে বিভ্রান্ত করবে না। সংকট উত্তরণ ত্বরান্বিত হবে, উন্নয়নের গতিধারা অব্যাহত থাকবে। জনগণ করোনা পরিবেশেই জীবনকে নিরাপদ রাখার জন্য সহনশীলতা তৈরি করে করোনার প্রতিঘাতকে মোকাবিলা করে অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সচেষ্ট হবে। তাই তথ্য অধিকার জনগণের ঘুরে দাঁড়াতে আশা জাগানিয়ার এক মহৌষধ।
সন্দেহ নেই, করোনা সংকটকালে বাংলাদেশ এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশগুলোসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশেই নাগরিকের আবেদন করে তথ্য পাওয়ার ক্ষেত্রটি কিছুটা সংকুচিত হয়েছে। বিশ্বের কোনো কোনো দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণাসহ লকডাউন ইত্যাদি কারণে নাগরিকের তথ্য প্রাপ্তি ব্যাহত হয়েছে। করোনা সংকটে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার বিধানটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এ সময়ে নাগরিকের পক্ষে শারীরিকভাবে তথ্য সংগ্রহ করা, এজন্য কয়েকটি ধাপ পার করে তথ্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করা কঠিন কাজ, স্বাস্থ্যবিধিসম্মতও নয়। অবশ্য বিকল্প হিসেবে অনলাইনে তথ্য প্রদান ও শুনানি বা সিদ্ধান্ত প্রদানের বিষয়টি জোরদার হয়েছে।
সংকট মোকাবিলায় অবাধ তথ্যপ্রবাহ রচনার মাধ্যমে জনগণকে সম্পৃক্ত ও সচেতন করার লক্ষ্যে করোনা প্রাদুর্ভাবের শুরু থেকেই প্রধানমন্ত্রী সম্মুখযোদ্ধাদের নিয়ে স্বয়ং সারাদেশে নিয়মিত ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হয়ে জনজীবন রক্ষায় ও জনস্বাস্থ্যের নিরাপত্তায়, আর্থসামাজিক উন্নয়নে একদিকে যেমন জনগণকে স্বাস্থ্য সচেতন করার প্রয়াস নিয়েছেন; সামাজিক ও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন, প্রণোদনা ও সহায়তা প্যাকেজের ঘোষণা দিয়েছেন, এগুলোর যথাযথ বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিয়েছেন, অন্যদিকে সব কর্তৃপক্ষকে জনগণের প্রতি দায়িত্বশীল রাখতে সচেষ্ট হয়েছেন, যা সর্বত্র প্রশংসিত হয়েছে, দেশ-বিদেশে সমাদৃত হয়েছে। একাদশ জাতীয় সংসদের নবম অধিবেশনের সমাপনী ভাষণে তিনি জানান, করোনা ভ্যাকসিনের জন্য সব দেশেই আবেদন করা হয়েছে, প্রয়োজনীয় বাজেটের সংস্থান রাখা হয়েছে, যেখানে আগে পাওয়া যাবে সেখান থেকেই নেওয়া হবে। মহান সংসদে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নোত্তর প্রদানসহ এহেন বক্তব্য সারাদেশে তথ্যের অবাধ প্রবাহ রচনা করে, জনগণকে সংকটে আশ্বস্ত করে, আশার আলো দেখায়। স্বপ্রণোদিত তথ্য প্রদানের আরেকটি বাধ্যতামূলক মাধ্যম কর্তৃপক্ষের ওয়েবসাইট। ওয়েবসাইটের তথ্য ও নির্দেশিকা সংকট উত্তরণে পথ দেখায়। তবে ওয়েবসাইট নিয়মিত হালনাগাদ থাকতে হবে, হতে হবে সহজলভ্য ও ব্যবহার উপযোগী। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটের মতো জেলা ও উপজেলার স্বাস্থ্য কার্যালয়ের ওয়েবসাইটেও করোনা-সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় তথ্যাদির একটি কর্নার থাকা জনস্বাস্থ্যের খাতিরে সমীচীন হবে। প্রধান তথ্য কমিশনার সূত্র : সমকাল

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn