থানা হাজতে নিজেকে শেষ করার জন্য নজরুল ইসলাম বাবু সময় নিয়েছে প্রায় ৭ মিনিট। এই সময়ের মধ্যে সে একবার ফ্যানের কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করে। গ্রিল বেয়ে উঠার চেষ্টা করলেও মাটিতে পড়ে যায়। এরপর ভেন্টিলেটরের সঙ্গে ফাঁস লাগিয়েও আত্মহত্যার চেষ্টা করে দুবার। তৃতীয়বার চেষ্টার পর সে মারা যায়। আর থানা হাজতে বাবুর এই মৃত্যুর ঘটনাবলী রেকর্ড হয়েছে সিসিটিভি ফুটেজে। মাত্র ৬ থেকে ৭ মিনিটের ওই ফুটেজ দেখলেই যে কেউ চমকে উঠবেন। আঁতকে উঠেছে পুলিশও। আর সিলেটের থানা হাজতে এই মৃত্যু নিয়েও তোলপাড় চলছে পুলিশের মধ্যে। বাবুর স্বজনরা জানিয়েছেন, বাবুকে যদি খুন করা না হয় তাহলে মৃত্যুর প্ররোচণাও দেয়া হতে পারে। এ কারণে তারা আইনি উদ্যোগ গ্রহণ করবেন। সিলেটের জৈন্তাপুর থানা পুলিশের হাতে রয়েছে নজরুল ইসলাম বাবু মারা যাওয়ার ফুটেজটি। ওই ফুটেজ পুলিশ স্বচ্ছতার জন্য সাংবাদিকদেরও দেখিয়েছেন। থানায় থাকা সিসিটিভি থেকে এই ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়। পুলিশ জানায়, শুক্রবার ভোররাতের দিকে জৈন্তাপুর থানা হাজতে মারা যায় নজরুল ইসলাম বাবু। তখন ভোর ৪টা ৪৫ মিনিট। আসামি মারা গেলেও বিষয়টি বুঝতে পারেনি দায়িত্বরত পুলিশ। বিষয়টি পুলিশের নজরে আসে ভোর ৬টার দিকে। সিলেটের জৈন্তাপুর থানার ওসি সফিউল কবির গতকাল  জানিয়েছেন, দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যরা ঘটনাটি বুঝতে পারেননি।

শিফট পরিবর্তনের সময় নতুন সদস্যরা চেক করতে এলে বিষয়টি ধরা পড়ে। তিনি বলেন, ওই দিন বাবু একাই হাজতে ছিল। অন্য কোনো আসামি ছিল না। তবে গভীর রাত পর্যন্ত দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা দেখেছেন বাবু কম্বল গায়ে জড়িয়ে শুয়ে আছে। এদিকে সিসিটিভির ফুটেজে দেখা গেছে নিচু ভেন্টিলেটরের গ্রিলে কম্বলের সুতোর অংশ বেঁধে সে আত্মহত্যা করেছে। তবে যে স্থানে দড়ি বেঁধেছে সেটি হাতের নাগালে। ওই রাতে দ্বিতীয় স্ত্রীর দায়ের করা মামলায় বাবুকে পুলিশ জৈন্তাপুরের কোহাইগড় গ্রাম থেকে গ্রেপ্তার করে। সে ওই মামলার পলাতক আসামি ছিল। রাতে তাকে গ্রেপ্তারের পর নিয়ে রাখা হয় জৈন্তাপুর থানায়। সেখানে তাকে দেখতে যায় আত্মীয়রা। তাদের সঙ্গে কথা বলে বাবু। ওই সময় বাবুকে বেশ চিন্তিত মনে হয়েছিল বলে জানিয়েছেন স্বজনরা। রাতে স্বজনরা তাকে জানিয়েছিলেন তারা সকালে নাস্তা নিয়ে আসবে। সিসিটিভির ফুটেজ ঘেঁটে দেখা গেছে, বাবু কম্বল থেকে খুব কৌশলে সুতার অংশ বিচ্ছিন্ন করে। বিচ্ছিন্ন করার সময় সে হাজতের দেয়ালে ঘষা দিয়ে এক অংশ থেকে অপর অংশ আলাদা করে। এরপর জোড়াতালি দিয়ে ওই দড়ি লম্বা করে। দড়িটি লম্বা করার পর সে প্রথমে থানায় থাকা ফ্যানের সঙ্গে ঝুলতে চেয়েছিল। এ কারণে সে গ্রিল বেয়ে উপরে ওঠার চেষ্টা চালায়। কিন্তু ফ্যানের নাগাল পায়নি। এরপর সে ওই গ্রিলের সঙ্গে ঝুলার চেষ্টা করে। প্রথম দুবার সে ঝুলে থাকার চেষ্টা করেও পারেনি। কারণ, দড়ি ছিড়ে যায়। শেষবার খুব শক্ত করে কম্বলের আলাদা অংশ জোড়া লাগায়। এরপর খুব নিচু গ্রিলের সঙ্গে এক অংশ বেঁধে অপর অংশ গলায় জড়ায়। এরপর সে হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে থাকে। ফুটেজে এই দৃশ্য দেখে পুলিশও আঁতকে ওঠে। বাবুর মৃতদেহ মাটির সঙ্গে ঝুলে থাকলেও দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তারা বিষয়টি টের পাননি। ঘটনাকালীন কেউ হাজতের সামনে আসেননি। এ কারণে প্রচুর সময় নিয়ে এই কাজ করেছে বাবু। সিলেটের বিভিন্ন থানায় দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, থানা হাজতে এ ধরনের ঘটনা বিরল। আর এ ঘটনার পর সিলেটের থানা হাজতে থাকা হাজতিদের প্রতি বিশেষ নজরদারি শুরু করেছে পুলিশ। সিলেট জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (মিডিয়া) সুজ্ঞান চাকমা জানিয়েছেন, পুলিশ সিসিটিভির ওই ফুটেজ সংগ্রহ করেছে। এরপর লাশ ময়নাতদন্তের পর পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তিনি বলেন, থানা হাজতের জন্য অতিরিক্ত কোনো পুলিশের দায়িত্ব থাকে না। যারা থানায় দায়িত্বে থাকেন তারাই হাজতখানা দেখাশোনা করেন। তিনি বলেন, থানা হাজতে আসামির মৃত্যুর ঘটনায় ইতিমধ্যে সিলেটের পুলিশ সুপার মো. মনিরুজ্জামানের নির্দেশে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবুল হাসনাতকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির রিপোর্টের আলোকে পরবর্তীতে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এদিকে, থানা হাজতে মারা যাওয়া জৈন্তাপুরের কহাইগড় গ্রামের আব্দুল জলিলের ছেলে নজরুল ইসলাম বাবু ছিলেন দ্বিতীয় স্ত্রী নাসরিন ফাতেমার দায়ের করা মামলার আসামি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা নাসরিন ফাতেমার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন বাবু। এরপর তিনি শিক্ষিকা নাসরিনকে বিয়েও করেন। কিন্তু ঘরে আরেক স্ত্রী থাকায় তিনি নাসরিনকে ঘরে তুলতে পারেননি। এসব বিষয় নিয়ে নাসরিনের সঙ্গে বিরোধ চলছিল বাবুর। শেষে নাসরিন বাবুর বিরুদ্ধে ১৬ই নভেম্বর জৈন্তাপুর থানায় নির্যাতন মামলা দায়ের করেন। এ ঘটনায় পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। এই মৃত্যুকে কোনোভাবে মেনে নিতে পারছেন না বাবুর পরিবার। তারা গতকালও দাবি করেছেন থানা হাজতে বাবুকে খুন করা হয়েছে। এর আগে পুলিশ তার ওপর অকথ্য নির্যাতন চালিয়েছে বলে দাবি করেন তারা। লাশ উদ্ধারের পর বাবুর শরীরে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে বলে তারা জানান। তার শরীরে আঘাত ছাড়াও নিম্নাঙ্গ দিয়ে রক্ত ঝরছিল। এ কারণে তারা হত্যা বলেই ধারণা করছেন। ইতিমধ্যে ঘটনাটি পর্যালোচনা করে তারা আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তবে নিহতের চাচা মদরিছ আলী ও বোনজামাই লুদু মিয়া দাবি করেছেন, বাবুকে নির্যাতন করে মেরে ফেলে আত্মহত্যার নাটক সাজানো হতে পারে। পুলিশ পাহারায় থানা হাজতে আসামি আত্মহত্যা করে কিভাবে- এমন প্রশ্ন তোলেন তারা।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn