ইব্রাহিম খলিল-আজম খান, নাজিম খান ও এরশাদ খান। আপন তিনভাই ওরা। চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি পৌরসভার কেরিমুহুরী বাড়ির মাহবুবুল আলমের ছেলে তারা। এদের মধ্যে আজম খান গত জুলাই মাসে সিআইডির হাতে ধরা পড়ে বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন। দুবাই পুলিশের দেয়া তথ্যমতে সিআইডি ঢাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে। এরপর ফাঁস হয় দুবাইয়ে তিনভাইয়ের মধুচক্রের কথা। দেশ থেকে কিভাবে তারা দুবাই, ওমানসহ মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে তরুণী পাচার করে ডান্সবার ও যৌনব্যবসা চালাচ্ছে তার আদ্যোপান্ত ফাঁস করে সিআইডি। এ সময় আজম খানের স্বীকারোক্তি মোতাবেক এই মধুচক্রে জড়িত দেশে-বিদেশে থাকা অনেকের নাম প্রকাশ করে সিআইডি।

 

কিন্তু তাদের অনেকেই ধরাছোঁয়ার বাইরে এখনো। শুধু তাই নয়, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তরুণি পাচারে পুরোদমে সক্রিয় আজম খানের ছোট ভাই নাজিম খান ও এরশাদ খান। সম্প্রতি নবম শ্রেণিতে পড়–য়া চট্টগ্রামের এমন এক কিশোরী দুবাইয়ে আজম খানের মালিকানাধীন সিটি টাওয়ার হোটেলে নাজিম ও এরশাদের কবল থেকে উদ্ধার হয় বাংলাদেশের কনস্যুলার জেনারেল অফিসের সহায়তায়। দেশে ফিরে ওই কিশোরী এ সংক্রান্ত তথ্য দেন সিআইডিকে। ফলে সিআইডি বৃহস্পতিবার রাতে এই মধুচক্রে জড়িত জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কারপ্রাপ্ত খ্যাতিমান নৃত্যশিল্পী ও কোরিওগ্রাফার ইভান শাহরিয়ার সোহাগকে গ্রেপ্তার করে। এরপর শনিবার মানবপাচারের অভিযোগে তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট বেগম ইয়াসমিন আরা।  সিআইডির তথ্যমতে, এক প্রতিবেশীর মাধ্যমে ইভান শাহরিয়ার সঙ্গে পরিচয় হয় কিশোরীর। একপর্যায়ে দুবাইয়ের হোটেলে ভালো চাকরির প্রস্তাব দেন ইভান। টোপ গেলা মাত্রই ইভান শাহরিয়ার কিশোরীকে পরিচয় করিয়ে দেন দুবাইয়ে নারীপাচারের গডফাদার আজম খানের ভাই নাজিম খানের সঙ্গে। পরে দুবাইয়ে সিটি টাওয়ার হোটেলের একটি বদ্ধ কক্ষে জায়গা হওয়ার পর বুঝতে পারেন, কতো বড় ভুল করেছেন ওই কিশোরী।

কিশোরী বলেন, তার মতো আরও ২০ নারী ছিল জানালাবিহীন বদ্ধ ওই কক্ষে। সেখানে সবগুলো মেয়ের দিন শুরু হত রাত নয়টা থেকে। হোটেলের বলরুমে ভোর চারটা পর্যন্ত আরবি, হিন্দি ও ইংরেজি গানের সঙ্গে নাচতে হতো তাদের। বলরুমে আসা কোনো গেস্ট চাইলে তাদের সঙ্গে রাত কাটাতে হতো। এজন্য সুপারভাইজার আলমগীর ২,২০০ দিরহাম নিতেন খদ্দের থেকে। কোনো মেয়ে যেতে না চাইলে আলমগীর কোমরের বেল্ট ও শক্ত লাঠি দিয়ে পেটাত। এভাবে বাংলাদেশ থেকে পাঠানো তরুণীদের হোটেল ও ডান্সবারে যৌনকর্মে বাধ্য করা হতো। টাকার বিনিময়ে বাংলাদেশ থেকে তরুণী সংগ্রহের কাজটি করতেন জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত নৃত্যশিল্পী ইভান শাহরিয়ার সোহাগের মতো আরও অনেকেই। ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন জেলার নৃত্য সংগঠন ও ক্লাব থেকে তারা মেয়ে সংগ্রহ করতেন। গায়েহলুদসহ বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে যারা পেশাদার হিসেবে নাচেন, তারাই ছিলেন এদের মূল শিকার।

ফটিকছড়ি থানার ওসি মো. বাবুল আকতার জানান, ফটিকছড়ির বাসিন্দা আজম খান ছিঁচকে চোর হিসেবে পরিচিত ছিল। একসময় হয়ে ওঠেন থানার তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী। ফটিকছড়িসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় আজম খানের বিরুদ্ধে ছয়টি হত্যা মামলাসহ ১৫টি মামলা রয়েছে। একপর্যায়ে র‌্যাব ও পুলিশের তাড়া খেয়ে দুবাই চলে যান সে। সেখানে গিয়ে ধীরে ধীরে তার ভাগ্য খুলতে শুরু করে। বাংলাদেশ থেকে দুবাইয়ে নারী পাচার করে সেখানে যৌনব্যবসার জাল বিছিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন রাতারাতি বিত্তশালী। ওসির তথ্যমতে, গত আট বছরে দুবাইয়ে চার তারকাযুক্ত তিনটি ও তিন তারকাবিশিষ্ট একটি হোটেলের মালিক আজম খান। তার মালিকানাধীন হোটেলগুলো হলো ফরচুন পার্ল হোটেল অ্যান্ড ডান্স ক্লাব, হোটেল রয়েল ফরচুন, হোটেল ফরচুন গ্র্যান্ড ও হোটেল সিটি টাওয়ার। বছর পাঁচেক আগে দুবাইয়ে আজম খানের হোটেল থেকে লাফিয়ে পড়ে এক নারীর আত্মহত্যার ঘটনায় তাকে আমিরাত থেকে বের করে দেওয়া হয়। এরপর তিনি চলে যান ওমানে। সেখানেও আগে থেকেই তার নারীপাচারের নেটওয়ার্ক বিস্তৃত ছিল।

নারীপাচার ও যৌনকর্মে বাধ্য করার এই নেটওয়ার্কে শুরু থেকেই সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন আজম খানের দুই আপন ভাই নাজিম খান ও এরশাদ খান। ঢাকার আদালতে আজম খান স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেছেন, চট্টগ্রামের মাহফুজ, লালবাগের স্বপন, আলামিন ওরফে ডায়মন্ড, বংশালের ময়না ও ময়মনসিংহের অনীক তাকে মেয়ে সংগ্রহের কাজে সাহায্য করেছেন। অন্যদিকে আজমের সঙ্গে গ্রেপ্তার হওয়া তার ভাই নাজিমের বন্ধু মো. ইয়াছিন ও নির্মল ডান্স একাডেমির নির্মল সরকার তাদের দেওয়া জবানবন্দিতে আরও দুই গডফাদারের নাম জানিয়েছেন। এরা হলেন ঢাকার বাড্ডার সজীব ও ময়মনসিংহের অনীক। দুবাইতে এ দুজনেরও ডান্স বার আছে। আজম খানের ডান্স বার ছাড়াও তারা সজীব ও অনীকের ডান্স বারের জন্যও নারী সরবরাহ করেছেন। এ কাজে তাদের মাধ্যম ছিলেন নৃত্যশিল্পী ও কোরিওগ্রাফার ইভান শাহরিয়ার সোহাগসহ বেশ কয়েকজন নৃত্যসংগঠক এবং দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা আরও কিছু এজেন্ট।

ইভান শাহরিয়ার সোহাগ ধ্যাততেরিকি সিনেমায় নৃত্য পরিচালনার জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রাপ্ত। করপোরেট অনুষ্ঠানে নাচার জন্য সোহাগ ডান্স ট্রুপ নামে তার একটি দল আছে। এছাড়া নৃত্যভূমি নামে আরও একটি নাচের দল রয়েছে তার। দেশ থেকে নারী সংগ্রহ করে পাঠানোর পাশাপাশি সোহাগ তার নাচের দল নিয়ে দুবাইয়ের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিতেন প্রায়ই। ফেরার সময় সেই দল কয়েকজন করে মেয়েকে রেখে আসতেন কৌশলে। এছাড়া সেলিম নামে ফটিকছড়ির আরও একজনের মাধ্যমে আজম খান ও তার দুই ভাই দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে নারী সংগ্রহ করতেন। চট্টগ্রাম ছাড়াও ঢাকা, রাজশাহী ও সিলেট থেকে বিভিন্ন দালালের মাধ্যমে নারী সংগ্রহের কাজটি বিশেষ করে আজম খানের পক্ষে তদারকি করতেন সেলিমই। সংগ্রহ করা নারীদের পাসপোর্ট তৈরি করে বিমানবন্দর পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বও তারই ছিল। দুবাই থেকে এসব নারীর ভিসাসহ যাবতীয় কাগজপত্র দেশে সেলিমের কাছেই পৌঁছাতেন আজম খান। সিআইডির উপপরিদর্শক কামরুজ্জামান জানান, বাংলাদেশে এই তিন ভাইয়ের প্রতিনিধিরা প্রথমে হোটেলে চাকরি দেওয়ার কথা বলে ২০-২২ বছর বয়সী তরুণীদের সামনে টোপ ফেলতো। বিশ্বাস অর্জনের জন্য বেতন হিসেবে ২০-৩০ হাজার টাকা নগদ পরিশোধও করা হতো। এমনকি দুবাইয়ে যাওয়া-আসা বাবদ সব ধরনের খরচও দিত ওই দালালচক্র। এভাবে গত আট বছরে চাকরির লোভ দেখিয়ে বাংলাদেশের কয়েকশত তরুণী-কিশোরীকে দুবাই ও ওমানে পাচার করা হয়েছে। পাচারচক্রের জড়িত অন্যদের গ্রেপ্তারে সচেষ্ট রয়েছে সিআইডি।সূত্র-মানব জমিন

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn