পীর হাবিবুর রহমান-

কোথা থেকে শুরু করব, কোথায় গিয়ে শেষ, কিছুই বুঝতে পারছি না। গত দুই সপ্তাহে রাজনীতিতে গুমোট হাওয়া বইলেও ক্যালেন্ডারের দিনগুলো কেটেছে নানা ঘটনায়। ঘটনাবহুল দুই সপ্তাহের দিকে তাকালে দৃশ্যমান হয়, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের আবগারি শুল্কনির্ভর, ভ্যাটনির্ভর বিশাল বাজেট ঘিরে নাগরিক জীবনে ঘটে যাওয়া প্রতিক্রিয়া ও তার ঝড় থামতে না থামতেই তার নিজের রাজনীতি থেকে অবসরে যাওয়ার ঘোষণা থেকে সরে এসে সিলেট সদর আসনে আবারও আওয়ামী লীগের প্রার্থী হওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করায় আলোচনা সরগরম।   এরই মধ্যে ঝড় বইছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট সুলতানা কামালের টিভি টকশোর বক্তব্য হেফাজতের অনুরোধে সুপ্রিম কোর্টের মানচিত্র ঢেকে দিয়ে গ্রিক দেবী থেমিসের শাড়ি পরানো বিকৃত ভাস্কর্য সরানোর বিতর্ক। একপক্ষ বলছেন, নান্দনিক ভাস্কর্য আরেকপক্ষ বলছেন মূর্তি। ধর্মের জিগির উঠেছে আলেম-ওলামাদের মধ্যে। তাদের আবেগ-অনুভূতি ঘিরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে সেটি সরানো হয়েছে। একটি অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়নি দেশ ও মানুষকে। কিন্তু শান্তিপূর্ণ সমাধান সবার ভালো লাগে না। সরকারের খেয়ে পরে, সরকারি প্রটেকশনে থাকা একদল গণবিচ্ছিন্ন অংশ বলতে থাকলেন সরকারের এই আপসকামিতা যেন দেশ ও জাতির জন্য সর্বনাশ ডেকে এনেছে।

শাপলা চত্বর ঘিরে যেদিন হেফাজত মহাপ্রলয় ঘটিয়েছিল সেদিন প্রতিরোধ দূরে থাক বুদ্ধি পরামর্শ দেওয়ার শক্তি নিয়ে হাজির হতেও এদের দেখা যায়নি। সরকারের দুধকলায় পোষা গণজাগরণ মঞ্চের একাংশের নেতা ইমরান এইচ সরকারও প্রতিবাদ মিছিল করলেন। সেই মিছিল থেকে প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে স্লোগানও উঠল। ছাত্রলীগ তাকে কুত্তার মতো পেটাতে চাইল। দলের মহিলা নেত্রীরা তাকে প্রতিরোধ করতে অনুমতি চাইলে শেখ হাসিনা দিলেন না। তাদের নিবৃত্ত করলেন। ইতিমধ্যে বিষয়টি এমন দাঁড়িয়েছে দুধকলায় সাপ পুষেছে সরকার, এখন গাল দেয় ইমরান এইচ সরকার। গণজাগরণ মঞ্চ দীর্ঘমেয়াদি রাখার পক্ষে আমরা শুরুতেই আপত্তি করেছিলাম। কিন্তু সেকালের অতিবিপ্লবী, বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগ বিদ্বেষী যারা একালে রিক্ত নিঃস্ব হয়ে এসে শেখ হাসিনা বন্দনায় মগ্ন থাকেন তারাই টিকিয়ে রেখেছেন। ইমরান এইচ সরকারের এই যাত্রাপথে লাভই লাভ। নামও হলো, রাতারাতি নেতাও হলো, মন্ত্রীপাড়ার নাহিদকন্যাকে বিয়ে করে সরকারের জামাইও হলো। মৃণাল হকের এই ভাস্কর্য সরানোর মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে উদ্যোগ নিয়েছেন এতে করে ধর্মপ্রাণ মানুষের উত্তেজনা প্রশমিত করেছেন। আলেম-ওলামাদের শান্ত করেছেন। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের সামনে থেকে ভাস্কর্য সরানোতে কারও কারও জাত মান গেলেও শেখ হাসিনার উদ্যোগ একটি অগ্নিগর্ভ হতে যাওয়া পরিস্থিতিকে প্রশমিত করেছে। এই ভাস্কর্য সরিয়ে ছিলেনই যখন সুপ্রিম কোর্টের ভিতরে না রাখলে কিছু এসে যেত না। যারা বলছেন, এটি সরালেই সরকার আপস করেছেন, তারা ভুল বলছেন। রাষ্ট্র পরিচালনায় চাপ সৃষ্টিকারী গ্রুপসহ সব মানুষের দাবি-দাওয়াকেই আমলে নিয়ে দেশ চালাতে হয়। এটা সরকারের আপসকামিতা না কৌশল সেটি পর্যবেক্ষণের বিষয়।

’৯৬ সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ বিএনপির কাছ থেকে যে জামায়াতকে সরিয়ে যুগপৎ আন্দোলনের রাজনৈতিক পার্টনার করেছিল, বিগত ৯ বছরে তাদের ওপর স্টিমরোলারই চালায়নি; মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে তাদের নেতাদের ফাঁসিতে ঝুলিয়েছে। ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে ইসলামী ঐক্যজোটের ওপর সরকার দমন-নির্যাতন করতে গিয়ে ভোটের রাজনীতিতে যে মাশুল দিয়েছিল, তা থেকে শিক্ষা নিয়েই ২০০৬ সালের নির্বাচনের আগে মরহুম শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হকের সঙ্গে পাঁচ দফা চুক্তি করেছিল। যেমন মহাজোটে আনতে গিয়ে এইচ এম এরশাদকে ক্ষমতায় এলে রাষ্ট্রপতি করা হবে— এমন চুক্তিও করেছিল। কিন্তু সেই নির্বাচন বাতিল হয়ে গিয়ে ওয়ান-ইলেভেনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে বিজয়ীর বেশে শেখ হাসিনা যখন দলকে ২০০৮ সালের নির্বাচনে নামালেন সে সময় সেসব চুক্তি তামাদি হয়ে গেল। কারণ ভোটের রাজনীতিতে তখন নৌকার পক্ষে যে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছে, সেটি তিনি জেনে গেছেন। এবার শেখ হাসিনা বলে আসছেন, আগামী জাতীয় নির্বাচন হবে অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। হেফাজতের সেই মহাপ্রলয় তিনি রুখে দিলেও তাদের শক্তি দেখেছে বাংলাদেশ। শাহরিয়ার কবির আর ইমরান এইচ সরকারকে দিয়ে যে এদের প্রতিরোধ করা যাবে না বা কোনো ভোট ব্যাংক পাওয়া যাবে না, সেটি আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব কেন দেশের শিশুরাও জেনে গেছে। আগামী নির্বাচন সামনে রেখেই যা কিছু ঘটেছে তা কৌশলের রাজনীতিরই অংশ। এ ছাড়া বিগত ৪৬ বছরই নয়, ভারত শাসনামল থেকেই মাদ্রাসা শিক্ষার বিস্তার ঘটেছে। এটি দিনে দিনে অনেক বড় জায়গা নিয়েছে। গোটা বাংলাদেশে যেদিকেই যাওয়া যায় রাস্তার আশপাশে মাদ্রাসা আর মাদ্রাসা। মাদ্রাসা অনেক দেশেই রয়েছে। এমনকি প্রতিবেশী ভারতেও। এই মাদ্রাসা ঘিরে যে এতিম ও জনগোষ্ঠী তারা এদেশেরই সন্তান, এদেশেরই নাগরিক। কওমি মাদ্রাসাকে স্বীকৃতি দিয়ে, সিলেবাস পরিবর্তন করে আধুনিক শিক্ষার আওতায় নিয়ে আসার যে পরিকল্পনা শেখ হাসিনার তাতে কারও কারও গা জ্বলছে কেন, বুঝতে পারি না। যেন তারা ভিনগ্রহের মানুষ। গোলাম আযমকেও নাগরিকত্ব মামলায় উচ্চ আদালত এই বলে নাগরিকত্ব দিয়েছিল যে, তিনি এই দেশেই জন্মেছেন। আজকের মাদ্রাসার অভ্যন্তরে কী হয় না হয় তা যেমন রাজনীতিবিদরা খবর রাখেন না, তারা ভোটের জন্য অনুদান দিয়েই খালাস। তেমনি বাস্তবতা থেকে দূরে থাকা একদল নাস্তিক আর অতিপ্রগতিশীলদের অজানা। এদের আধুনিক শিক্ষায় তাদের আবেগ-অনুভূতি ধারণ করে যে সরকারি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে ইতিবাচকভাবেই দেখার সময়।

ইতিমধ্যে হেফাজত নেতা আল্লামা শফী অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে। একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে বলেছেন, হেফাজত একদিন আপনাকেও হিজাব পরাবে। শাহরিয়ার কবির ব্যক্তিগত জীবনে আস্তিক না নাস্তিক, মুক্তিযুদ্ধে তার ভূমিকা ছিল কি নেই; সেটি বড় বিষয় নয়। বড় বিষয় হলো বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা যে অনেক আগেই হেফাজতের কথা ছাড়াই নিজ ধর্ম বিশ্বাস থেকে হিজাব পরেছেন, অসংখ্যবার হজ করেছেন। একটি সম্ভ্রান্ত আল্লাহভীরু ধর্মপ্রাণ মুসলিম পরিবারের সন্তান হিসেবে তাহাজ্জুদের নামাজ দিয়ে কোরআন তেলাওয়াত করে দিনের কর্মকাণ্ড শুরু করেন, সেটি শাহরিয়ার কবিররা এখনো জানেন না।

তারা আরও জানেন না, বিগত ৯ বছর ধরে সমালোচকরা যেখানে বলে আসছিলেন, শেখ হাসিনার সরকারের আত্মা হচ্ছে বামশক্তি। তাদের মুখে এ ঘটনায় ছাই দিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রমাণ করেছেন তিনি অতিবাম বা নাস্তিকদের কথায় আমল দিচ্ছেন না। তিনি সব মানুষের আবেগ-অনুভূতি ধারণ করে রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের পতাকা হাতে নিয়েই পথ হাঁটছেন।

’৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ইসলাম ধর্মের নামে যে রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল, সেটি পাকিস্তান। জন্মের পরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সামন্ত শাসক গোষ্ঠীর ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বিরুদ্ধে তার দূরদর্শিতা ও প্রতিবাদী চরিত্র নিয়ে মুসলিম লীগ থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। আওয়ামী মুসলিম লীগ ’৪৯ সালে গঠনকালে তিনি ছিলেন অন্যতম কারাবন্দী প্রতিষ্ঠাতা। তার আগের বছর ’৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগের ওপর ভর করেই তিনি তার মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের রাজনীতির দুয়ারই খোলেননি; ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধিকার, স্বাধীনতার পথ ধরে একদিকে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর, অন্যদিকে বামপন্থি রাজনৈতিক শক্তির পরাজয় ঘটিয়ে নিজের ক্যারিশমা-ইমেজের ওপর ভর করে ’৭০ সালের জাতীয় নির্বাচনে নৌকার নিরঙ্কুশ বিজয় নিশ্চিত করেছিলেন। সেই বিজয়ের মধ্য দিয়েই তিনি হয়ে উঠেছিলেন স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক। তার ডাকেই গোটা জাতি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদ ও আড়াই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও বিজয় অর্জন করেছিলেন। সেই মুক্তিযুদ্ধে ঐতিহাসিক বন্ধুত্বের ভূমিকা রেখেছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ও তার দেশের জনগণ।

একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন দেশে চরমপন্থি, উগ্রপন্থি তত্পরতা আর দলের উন্ন্যাসিক একাংশের কারণেই জাতির মহান নেতা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশকে অর্থনৈতিক মুক্তি দিতে পারেনি। দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত বিশ্ব মোড়লদের নীলনকশা অনুযায়ী এদেশীয় ঘাতকদের হাতে ’৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর পরিবার-পরিজনসহ বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে শাহরিয়ার কবির ও অগ্রজ এবং সহকর্মীরা কী ভূমিকা রেখেছিলেন, কী কথা বলেছিলেন ইতিহাসের পাঠ থেকে তা মুছে যায়নি। অতি বিপ্লবী চীনাপন্থিদের হঠকারিতা, সিরাজ সিকদারের পূর্ববাংলা সর্বহারা পার্টির শ্রেণি শত্রু খতমের নামে জনপ্রতিনিধি হত্যা এবং কলকারখানায় আগুন, থানা লুট অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে তৈরি হওয়া মেধাবী তারুণ্যনির্ভর শক্তি জাসদের আবির্ভাব ও তার গণবাহিনীর নেতিবাচক উগ্রপন্থি কর্মকাণ্ড মানুষ ভুলে গেলেও ইতিহাস ভুলেনি। ’৭০-এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নামে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও জনগণের একটি বড় অংশ ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের ব্যানারে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর দোসর হয়েছিল। রক্তে লেখা ’৭২-এর সংবিধানের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করে একটি উদার গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে খুনি মোশতাক থেকে সব সেনাশাসক সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা মুছে দিয়ে বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম যুক্ত করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের কিংবদন্তি হলেও বুঝতে পেরেছিলেন এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্ম ইসলাম। তাই তিনি অনেকের আপত্তির মুখে কারও মাখা তামাক খাই না মন্তব্য করে ওআইসি সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। তিনি সব নাগরিকের অধিকার সাংবিধানিকভাবে সংরক্ষণই করেননি; একটি অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং উদ্যোগ নিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষা কার্যকরের। সেদিন বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের সঙ্গে বিভিন্ন বৈঠকে বিদেশি শরাব পানে অংশ নেয়া চীনাপন্থি বামদের সঙ্গে যে শাহরিয়ার কবিররা ছিলেন, তারা হয়েছিলেন চরম আওয়ামী লীগ ও মুজিব বিদ্বেষী।

অন্যদিকে, আজীবন মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য নির্লোভ, নিরহংকারী, সৎ রাজনীতির পথ হাঁটা বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে ধরেছিলেন মস্কোপন্থি বামরা। তাদের প্রেসক্রিপশনে বঙ্গবন্ধু তার হৃদয় কেটে একদলীয় বাকশাল গঠন করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর সব উগ্রপন্থি সামরিক শাসকদের সঙ্গে যুক্ত হয়, ডান ও বামের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছিল সেনাশাসক জিয়াউর রহমানের বিএনপি। শুধু তাই নয়; সেই সময় চীনাপন্থি বাম ও উগ্রপন্থিরা বঙ্গবন্ধুর পরিবার ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নির্লজ্জ বেহায়ার মতো কুৎসা রটিয়েছিলেন।

বঙ্গবন্ধুর পরিবার-পরিজনসহ নিহতদের বিচার না করার ইনডেমনিটি সবাই বহাল রেখেছেন। ইতিহাসের প্রতিটি মাহেন্দ্রক্ষণে জাতীয় প্রচার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর নাম নিষিদ্ধ করেছিলেন। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট প্রথমে সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন ও পরে মরহুম আবদুর রাজ্জাককে ঘিরে আওয়ামী লীগ সুসংগঠিত হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত আত্মসমালোচনা, আত্মসংযম ও আত্মশুদ্ধির পথে। সেই পথ ধরে নেতৃত্ব যখন দলীয় কোন্দলে আওয়ামী লীগকে ভাঙনের মুখে ঠেলে দেয় তখন ’৮১-এর ইডেন কাউন্সিলে ভারতে নির্বাসিত মুজিবকন্যা শেখ হাসিনাকে সারা দেশের নেতা-কর্মীদের তুমুল করতালির মধ্যে দলের ঐক্যের প্রতীক হিসেবে সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। সেই রজনীতে সেনাশাসক জিয়াউর রহমান আওয়ামী লীগের ভাঙনের প্রত্যাশা করে বঙ্গভবনে সারা রাত জেগে ছিলেন। ভোরের আলো ফোটার মধ্য দিয়ে যখন শুনলেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী হিসেবে গণতন্ত্রের বাতিঘর হয়ে শেখ হাসিনা দলের সভানেত্রী নির্বাচিত হয়েছেন তখন তার সামরিক সচিব মরহুম জেনারেল সাদেক আহমেদ চৌধুরীকে ‘দেশটা ইন্ডিয়া হয়ে গেল’ মন্তব্য করে ক্যান্টনমেন্টের বাসার অভিমুখে রওনা দিলেন।

শেখ হাসিনা দেশে আসুন, দলের হাল ধরুন— এটা যে সেনাশাসক জিয়াউর রহমান চাননি তার সব সাক্ষী মরে গেলেও বেঁচে আছেন আমির হোসেন আমু এবং শেখ ফজলুল করিম সেলিম। শেখ ফজলুল করিম সেলিমের ভাগ্যে আজও কেন মন্ত্রিত্ব জোটেনি, সেটি আমি জানি না। কিন্তু তার বাংলার বাণী থেকেই বঙ্গবন্ধুকন্যার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ও আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচিত হওয়ার সব আয়োজন চূড়ান্ত হয়েছিল। ভাবতে অবাক লাগে, ’৭৫-এর হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে যে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীসহ যারা প্রতিরোধ যুদ্ধে গিয়েছিলেন, যারা দলকে খেয়ে না খেয়ে সুসংগঠিত করেছিলেন তাদের অনেকেই আজকের আওয়ামী লীগে নেই। কিন্তু সেদিনের আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধু বিদ্বেষী অনেকেই শেখ হাসিনার সরকারের বড় বেনিফিশিয়ারিই নন, তোষামোদকারীও।

আজকের শেখ হাসিনা তার দীর্ঘ ৩৬ বছরের ঊর্মিমুখর সংগ্রামের ভিতর দিয়ে জীবনের বহু ঝুঁকি নিয়ে বিশ্ব নেতৃত্বের পাশে বাংলাদেশের মুখ হয়ে দাঁড়িয়েছেন। বাংলাদেশকে উন্নয়নের মহাসড়কে নিয়েছেন। তার অর্জন অনেক। কিন্তু একদল লুটেরা সেই উন্নয়নকে কলঙ্কিত করছে। তবুও শেখ হাসিনা সুপ্রিম কোর্টের ভাস্কর্য থেমিস সরালে শাহরিয়ার কবির কী বললেন, সরকারের খেয়ে পরে এককালের কমিউনিস্ট ও গণফোরামে হিজরত করে আসা শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের ঘরজামাই ইমরান এইচ সরকার কী মিছিল করেছেন, কী স্লোগান দিয়েছেন— তা আমলে না নিয়ে বুঝতে পেরেছেন দুধকলা দিয়ে সাপ পুষেছিলেন। তাই বলে তিনি, বামদের দিকে ঝোঁকেননি। উপলব্ধি করেছেন আজকের বাস্তবতায় জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে তার জিরো টলারেন্স থাকলেও দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলমান। সংখ্যালঘুদের নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করার লড়াইয়ে অবতীর্ণ অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির পতাকা নিয়ে পথহাঁটা শেখ হাসিনা বুঝতে পারছেন সংবিধানে এখন বিসমিল্লাহ মুছে দেওয়া সম্ভব নয়। যেমন মুছে দেওয়া যায়নি রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। আমাদের জন্মের সময় ধর্মনিরপেক্ষতা যুক্ত হলেও উদার গণতন্ত্রী বৃহত্তম ভারতের সংবিধানে যুক্ত হয়েছে জন্মের অনেক পর। সেখানে ব্রুট মেজরিটি নিয়ে হিন্দুত্ববাদের স্লোগান দিয়ে আরএসএসের শক্তির ওপর ভর করে ক্ষমতায় আসা বিজেপি ও তার নেতা নরেন্দ্র মোদি প্রতাপশালীই নন, ব্যাপক জনপ্রিয়ও। উত্তর প্রদেশের নির্বাচনে বিজেপির বিশাল বিজয় অসাম্প্রদায়িক কংগ্রেসকে আরেক দফা ঝুঁকিতে ফেলেছে। ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী কংগ্রেস না পারছে ধর্মের রাজনীতি করতে, না পারছে বিজেপিকে রুখতে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন বলেছিলেন, বাংলাদেশ মডারেট মুসলিম কান্ট্রি। তিনি বাস্তবতার নিরিখেই কথাটি বলেছিলেন। যদিও আমাদের মুক্তিযুদ্ধের লাখো শহীদের রক্তের স্বপ্ন ও চেতনার জায়গা হলো একটি অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, শোষণমুক্ত রাষ্ট্রের। সেই স্বপ্ন থেকে আমরা কী অসাম্প্রদায়িক, কী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অনেক দূরে বসবাস করছি। আজকের বাংলাদেশে দাঁড়িয়ে বলা যাবে না, যেমন এটি একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র, তেমনি বলা যাবে না একটি উদার গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে। এটা আমাদের ব্যর্থতা হলেও আমাদের শক্তির জায়গা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের সেই স্বপ্নের লড়াই থেকে সরে আসিনি। বঙ্গবন্ধু জনগণকে স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। সেই চেতনার জায়গা উদ্ধার করতে হলেও আজকের রাজনৈতিক নেতৃত্বকেও শুধু ভোটের হিসাবে পথ চললে হবে না। মুক্তিযুদ্ধের গৌরবের জায়গায় দাঁড়িয়ে জনগণকে নিয়ে তা অর্জন করতে হবে। শাহরিয়ার কবিররা কুসংস্কারমুক্ত অসাম্প্রদায়িক চেতনার মুসলিম পরিবারের নারীদের মাথায় কাপড়, বোরকা কিংবা হিজাব দেখেন। কিন্তু একবারও চিন্তা করছেন না, অনাধিকাল থেকে ধর্মপ্রাণ মানুষ যেমন যার যার ধর্ম নিজেদের মতো লালন-পালন করছেন তেমনি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পথ চলছেন। তাদের অনেকে মনে করেন, দাড়িটুকু রাখলেই জঙ্গিবাদ, মৌলবাদ বলে গালি দিচ্ছেন, সাম্প্রদায়িক ধর্মান্ধ মনে করছেন। ৪৬ বছরের ইতিহাসে কোনো নির্বাচনে জামায়াতের মতো ধর্মভিত্তিক ডানপন্থি থেকে শুরু করে বামপন্থিদের কেউ বিজয়ী হতে পারেনি। বড় দুই দলের কাঁধে ভর করে বা দুই নেত্রীর আঁচল ধরেই তাদের সংসদ ও ক্ষমতায় আসতে হয়েছে। এদেশের মানুষ বর্ষবরণে উৎসবের মহাপ্লাবনে ভাসে। ঈদের জামাত থেকে জুমার নামাজে মুসল্লিদের ঠাঁই নেই ঠাঁই নেই অবস্থা দাঁড়ায়। তেমনি হিন্দুদের দুর্গাপূজায় দেশ আলোকসজ্জিতই হয় না, উৎসবের আনন্দেই মেতে ওঠে। বড়দিন ও বুদ্ধপূর্ণিমাতেও তাই। এই সম্প্রীতি ও শান্তি আমাদের গর্ব। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের এই সম্প্রীতির কথাই বলে। কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে নাস্তিকতার ফ্যাশন নিয়ে পথ চলতে যেমন শেখায় না, তেমনি ধর্মান্ধ হয়ে আইন হাতে তুলে নিয়ে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে মানুষ হত্যার শিক্ষাও দেয় না। অতিবাম ও অতিডানের জায়গা এখানে নেই। এটি ইতিহাস স্বীকৃত। বাম ও কমিউনিস্ট নেতাদের হজে হেফাজত পাঠায়নি, স্বপ্রণোদিত হয়ে গেছেন। উচ্চবিত্ত পরিবারের রমণীরা পর্দার কারণেই হোক আর ফ্যাশনের কারণেই হোক আজ হিজাব পরছেন।   চারদিকে এত হিজাব, তা বিশ্লেষণ করার ক্ষমতাও জনবিচ্ছিন্ন উগ্রপন্থিদের নেই।

আমাদের আগামী নির্বাচন নিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বামদের উগ্র ও হঠকারী জনবিচ্ছিন্ন কথাবার্তার ফাঁদে পা দিচ্ছেন না। উন্নয়নের স্লোগান তুলে ভোট বিপ্লবে অভিষিক্ত হওয়ার কথাই ভাবছেন। অন্যদিকে প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া একাত্তরে মানবতাবিরোধী অভিযোগে অভিযুক্ত জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গ ত্যাগ না করলেও দীর্ঘ নীরবতার পর এই রমজান মাসের ইফতার রাজনীতি ঘিরে মুখ খুলেছেন, কথাবার্তা বলছেন। ঈদের পর মাঠে নামার নির্দেশ দিচ্ছেন কর্মীদের। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের বাড়ি উচ্ছেদের পরিপ্রেক্ষিতে বলছেন ক্ষোভের সঙ্গে, আওয়ামী লীগকে এক কাপড়েই বাড়ি ছাড়তে হবে। এতে প্রতিহিংসার রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসার যে ভিশন-২০৩০ বা রাষ্ট্র পরিচালনার দর্শন দিয়েছিলেন সেটি হোঁচট খেয়েছে। দৃশ্যমান হয়েছে, ওয়ান-ইলেভেন থেকে তিনি ও তার দল যে নির্যাতন ভোগ করছেন, তাতে ক্ষমার নীতি নয়; ভিতরে প্রতিহিংসার আগুনই পুষছেন।   পর্যবেক্ষকরাও বলছেন, শেখ হাসিনা একদিন ক্ষমতায় না থাকলে এই প্রতিহিংসার আগুনে রক্তাক্ত হবে দেশ। যেমন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন নেতা-কর্মীদের, ক্ষমতায় না থাকলে টাকা নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে হবে, দেশ ছেড়েও পালাতে পারবে না।   সবার প্রত্যাশা একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হলেও আগামী নির্বাচন ঘিরে শঙ্কা এখনো কাটছে না।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক। 

 

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn