বর্তমান অর্থনীতি হচ্ছে একটা লুটেরা অর্থনীতি
দেশের বর্তমান অর্থনীতি হচ্ছে একটা লুটেরা অর্থনীতি, লুম্পেন ইকোনমি। সরকার পরিকল্পিতভাবে দেশের অর্থনীতি ধবংস করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে বলে অভিযোগ করেছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।আজ শুক্রবার বিকেলে এক আলোচনা সভায় বিএনপি মহাসচিব এই অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, এখন অর্থনীতি রসাতলে যাচ্ছে। পরিসংখ্যানের মাধ্যমে একটা ধুম্রজাল সৃষ্টি করা হচ্ছে। জুয়েল আইচ ম্যাজিক দেখাতেন, একটা ফুল নিয়ে এসে এক’শ টা ফুল। আজকে সরকার সেই অর্থনীতিকে একটা ফুল দিয়ে ১০০টা ফুল দেখাতে চায়। তিনি বলেন, সরকার সুপরিকল্পিতভাবে আমাদের অর্থনীতিকে ধ্বংস করেছে। ১/১১ থেকে এই কাজ শুরু হয়েছে।
হোটেল পূর্বানীর বলরুমে এমবিএ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ম্যাব) এর উদ্যোগে ‘প্রাক বাজেট ২০১৭-১৮’ এর ওপর এই আলোচনা হয়। এতে সাবেক জ্বালানি উপদেষ্টা মাহমুদুর রহমান বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন। তার প্রবন্ধে জাতীয় প্রবৃদ্ধি, সঞ্চয়, রেমিট্যান্স, রপ্তানি আয়, শিল্পায়ন, কৃষিখাত, বেসরকারি বিনিয়োগসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে পরিসংখ্যান উপাত্তের তুলনামূলক বিশ্লেষণের মাধ্যমে দেশের সামগ্রিক চিত্র উঠে আসে।
১/১১ সেনা সমর্থিত সরকারের প্রসঙ্গ টেনে মির্জা ফখরুল, ১/১১ ‘র আগে এদেশে যারা নতুন এন্টারপ্রেনারশিপ গড়ে তুলছিলো, যেসব উদ্যোক্তা সৃষ্টি হচ্ছিল, যেসব ব্যবসায়ীরা তাদের নিজেদের পূঁজি বাংলাদেশে বিনিয়োগ চাচ্ছিল, তাদেরকে ধরে নিয়ে গিয়ে এমন পিটুনি দিয়েছে আর টাকা নিয়েছে যে ওরা আর বিনিয়োগের কথা জীবনেও ভাববে না। এটা বাস্তবতা। আপনারা যেকোনো ব্যবসায়ীকে জিজ্ঞাসা করে দেখবেন, তারা আর নতুন করে বিনিয়োগের কথা চিন্তাও করে না। একে একে এই ব্যবসায়ীদের, উদ্যোক্তাদের যে একটা আশা ছিলো, প্রত্যাশা ছিলো তারা এই দেশে পূঁজি বিনিয়োগ করে সত্যিকার অর্থে একটি মুক্ত অর্থনীতির দেশ হিসেবে গড়ে তুলবে, সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে তুলবে, সেটা আর কখনোই সম্ভব হবে না। আমার কাছে মনে হয় না। আর এই আওয়ামী লীগ যদি সরকারের থাকে।
দেশের অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক তুলে ধরে অর্থনীতির সাবেক শিক্ষক মির্জা ফখরুল বলেন, আমাদের রফতানি প্রবৃদ্ধি ক্রমান্বয়ে কমছে, আমাদের রেমিট্যান্স গ্রোথ ধস নামছে। এই অবস্থায় দেশের অর্থনীতিকে কিভাবে আবার ট্র্যাকে ফিরিয়ে আনা যাবে, এটা আমি জানি না, অর্থনীতিবিদরা বলতে পারবেন।
দুর্নীতির প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, লুটপাট কী রকম হয়েছে, পানামা স্ক্যান্ডেলের কথা শুনেছেন। আজকের পত্রিকায় একটি খবর আছে, বাংলাদেশ হচ্ছে পঞ্চম দেশ যেখানে বিএমডাব্লিউ গাড়ি (বিলাসবহুল) সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়। তার মানে এটা মনে করবেন না যে, এখানকার মানুষ সবাই বিএমডাব্লিউ গাড়ি কেনার মতো বিত্তশালী হয়ে গেছেন, তাদের সমৃদ্ধি বেড়েছে। এখানে লুটেরা অর্থনীতির মানুষের, যারা লুট করছে তারা এখন এভাবে লুট করছে যে, তারা বিএমডাব্লিউ গাড়ি বেশি কিনছে।
বিএনপির শাসনামলে ব্যাষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতার বিষয় তুলে ধরে মির্জা ফখরুল বলেন, বিএনপির সময়ে ম্যাক্রো ইকোনমি অত্যন্ত স্থিতিশীল ছিলো, শক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। সেজন্য এখানে ব্যাংকিং সিস্টেমটা অত্যন্ত ভালোভাবে কাজ করেছে। আজকে সেই ব্যাংকিং সিস্টেমকে তারা শেষ করে দিয়েছে।
তিনি বলেন, ব্যাংকিংয়ে ১৫ হাজার কোটি টাকা মূলধন ঘাটতির জন্য এখন আবার ভুতর্কী দিতে হবে। লুট করেছে তারা, দেবো আমরা জনগণ, আমাদের ট্যাক্সের টাকা থেকে। হাজার হাজার কোটি টাকা লুট করে নিয়ে গেছে। ব্যক্তিখাতে কাদেরকে ব্যাংকের লাইসেন্স দিয়েছে? দেখবেন সব আওয়ামী লীগের নেতা-মন্ত্রী যারা আছেন, তারাই পেয়েছে। এরপর হোসেন মো. এরশাদ সাহেবও বাদ যাননি, আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী ছিলেন মহীউদ্দিন খান আলমগীরও বাদ যাননি।
অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত নন, ব্যবসা করেন না এমন সব ব্যক্তিকে ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তিনি। ফখরুল বলেন, বর্তমান সরকারের বাজেট প্রণয়ন করার নৈতিক কোনো ভিত্তি নেই। এরা তো নির্বাচিত হয়েই আসেনি। জনগনের ট্যাক্স তারা নেবে, সেটা কোন অধিকারে নিচ্ছে তার কোনো ভিত্তি বা জবাব তারা দিতে পারবে না। কোথাও কোনো জবাবদিহিতা নেই। এই অবস্থার থেকে উত্তরণে সুষ্ঠু নির্বাচনে মধ্য দিয়ে একটি জবাবদিহিমূলক সরকার প্রতিষ্ঠায় সকলকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহবানও জানান তিনি।
জাতীয় প্রবৃদ্ধি সম্পর্কে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক বাণিজ্য মন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, অর্থ ও ক্ষমতার যে রাজনীতি বর্তমানে চলছে, তাতে বাংলাদেশে অর্থনীতির মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়া হয়েছে। মেগা প্রকল্পের ৬০ শতাংশ চুরি হয়ে যাচ্ছে। সুতরাং মেগা প্রজেক্টের টাকা কোথায় যাচেছ আপনারা বুঝতেই পারছেন।
তিনি বলেন, সরকার বলছে, জিডিপি না-কি সাত দশমিক ২৪ হচ্ছে। কোনো বাজেটে মানব উন্নয়ন খাতে বিনিয়োগ ছাড়া প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব নয়, এটা বুঝতে হবে। প্রবৃদ্ধি ছয় শতাংশের উপরে যেতে হয়, মানবউন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা আছে। বাংলাদেশ সরকার যেখানে বিনিয়োগ করছে জিডিপির দুই শতাংশের মতো। বিনিয়োগ ছাড়া মানবউন্নয়ন সম্ভব নয় এবং মানবউন্নয়ন আমরা করতে পারি নাই বলে আমরা বিশ্বের ১৩৯ নম্বরে। যেখানে সব অর্থনৈতিক সূচক নিম্নগামী তাহলে কীভাবে প্রবৃদ্ধি বাড়লো?
তিনি বলেন, যে দেশের সাত শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়, সেই দেশের মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ইউরোপে পাড়ি দেবে, যেদেশের সাত শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়, সেদেশে বাইরের থেকে লোক আসে- এটা সহজ উদাহরণ। সরকারের প্রতিটি তথ্য মেন্যুফেকচার করা।
ম্যাব সভাপতি সৈয়দ আলমগীর হোসেনের সভাপতিত্বে ও মহাসচিব শাকিল ওয়াহেদের পরিচালনায় আলোচনায় অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মাহবুবউল্লাহ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক খন্দকার মুস্তাহিদুর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবু আহমেদ, কবি ও কলামস্টি ফরহাদ মজহার, বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বক্তব্য রাখেন।