বাটারফ্লাই বাজেট ও দিনদুপুরে ডাকাতি-হাসান হামিদ
ছোটবেলায় শুনেছি কেউ লাখপতি হলে নাকি তার বাড়িতে লাল নিশান উড়ানো হতো। তবে এটা কোথাও কখনো দেখিনি। আমার বয়স ও অভিজ্ঞতা নিতান্ত কম, সে কারণেই না দেখা হতে পারে। তবে লাখপতি মানেই সম্পদশালী এটা অনেক আগে আর্থসামাজিক ধারণা থাকলেও বর্তমান বাজারে কোটিপতি তার চেয়ে ঢের বেশি। আর ছোট ব্যবসা বা চাকরি করে যারা লাখপতি বনেছেন, তারা কতোটা সম্পদশালী তা ভাবনার বিষয়। কষ্ট করে জমানো সে টাকায় সরকারের চোখ পড়া দেখে আমরা সাধারণেরা খুব অস্বস্তিতে পড়েছি। পেনশনের জমানো বাবার টাকায় যখন সম্পদশালী হওয়ার অপরাধে সরকার হাত দিতে চাইছে, তখন মেয়ের বিয়ে কিংবা ছেলের জন্য তুলে রাখা টাকা ক্ষয়ে যাওয়ার চিন্তায় সাধারণ লাখপতি বাবা কি বাঁচবেন? সুতরাংআমাদের অভিজ্ঞতাপূর্ণ অর্থমন্ত্রী মহোদয় লাখপতিদের সম্পদশালী আখ্যা দিয়ে যে বিবৃতি দিয়েছেন, তা হাস্যকর। অর্থমন্ত্রীর যদি জমির আইল ধরে হাঁটার অভিজ্ঞতা থাকে তাহলে তার জানার কথা অনেক কৃষক তার ফসল বিক্রির কানা-কড়ি কিভাবে জমিয়ে রাখেন কন্যাকে পাত্রস্থ করার জন্য। অর্থমন্ত্রী যদি এই শ্রেণিকে বিত্তশালী বলে জেনে থাকেন, বা আখ্যা দিতে চান-তাহলে তাদের জীবনের সঙ্গে রসিকতাই করা হবে। এই মানুষগুলো ব্যাংকে টাকা রাখতে চান, সেখানে কিছু মুনাফা পাবেন বলে। এখন যদি আসল টাকাতেই টান পড়ে তাহলে উপায়? সেই পুরনো দিনের মতো মাটির নিচে হাঁড়িতে টাকা লুকিয়ে রাখার দিনে ফিরে যেতে হবে তাদের? দশ টাকায় কৃষকের জন্য ব্যাংক হিসেব করার সুযোগ দেয় যেই সরকার, যেই সরকারের সময়ে মোবাইল ব্যাংকিং’র কৃষি বিপণনে বিপ্লব এনে দিয়েছে, সেই সময়ে এই ভাবনা বা নির্দেশনে রসিকতা ছাড়া আর কী!
আগের দিনে আমাদের আশেপাশের গ্রামে দিন দুপুরে ডাকাতি হতো; এমনকি চিঠি দিয়ে দিন তারিখ ঠিক করে ডাকাত দল আসতো। এই বাজেট ঘোষণার পর আমার সেসব মনে পড়ছে খুব। বলে কয়ে অযৌক্তিক কিছুকে যুক্তির বলে টাকা নিয়ে নেওয়া তো দিন দুপুরে ডাকাতির মতোই! উন্নয়নের মহাসড়কে বাংলাদেশ: সময় এখন আমাদের’ নাম দিয়ে ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেছে সরকার; যা চলতি অর্থ বছরের মূল বাজেট থেকে ২৬ শতাংশ বেশি। ‘উন্নয়নের মহাসড়কে বাংলাদেশ’ যতখানি হোক না কেনো; ‘সময় এখন আমাদের’ কথাটি কিন্তু ঠিক। এত দীর্ঘ নজিরবিহীন সুসময় বাংলাদেশের মাটিতে এর আগে কোনও সরকার ভোগ করেছে বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় না।
বাংলাদেশের সংবিধানে অবশ্য বাজেট শব্দটি ব্যবহার করা হয়নি। এর পরিবর্তে সমরূপ শব্দ ‘বার্ষিক আর্থিক বিবরণী’ ব্যবহার করা হয়েছে, যেখানে একটি নির্দিষ্ট অর্থবৎসরের জন্য প্রাক্কলিত সরকারের প্রাপ্তি ও ব্যয়সমূহ দেখানো হয়। আমাদের দেশের সরকারি বাজেটের দুটি অংশ: রাজস্ব ও উন্নয়ন। বাজেট হলো রাষ্ট্রের আয় ব্যয়ের হিসাব। আমরা যারা সাধারণ মানুষ, বাজেট আমাদের কাছে আতঙ্ক ছাড়া তেমন কোনও বিশেষ অর্থ বহন করে না। বাজেট আসলেই আমরা ভয়ে থাকি ; নিত্য প্রয়োজনীয় কী কী জিনিসের দাম বাড়লো, কতটা বাড়লো, ভ্যাট, ট্যাক্স সব মিলিয়ে কী পরিমাণ অর্থ দিতে হবে সেই চিন্তায়। রাষ্ট্রকে দেওয়া অর্থ যদি সত্যিকার অর্থেই আমাদের কল্যাণে ব্যয় হতো তাহলে হয়তো এত আতঙ্ক তৈরি হতো না। আর প্রতিবছর বাজেটে যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়, তার কাছাকাছিও বাস্তবায়ন না হওয়া আমাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার বড় গলদ হলেও তিনি উত্তরণের পথ বাতলাতে পারেননি। বিগত আটটি বাজেটের মতো এবারও অর্থমন্ত্রী বিশাল অঙ্কের ঘাটতি বাজেট ঘোষণা করেছেন। কিন্তু সেই ঘাটতি কীভাবে পূরণ হবে, তার দিকনির্দেশনা বাজেটে নেই। তিনি এবারের বাজেটকে উন্নয়নের মহাসড়কে পৌঁছানোর কথা বললেও বাধাগুলো অতিক্রম করার কোনো উপায় নির্দেশ করেননি। সরকারি হিসাবে কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে যাওয়ার কথা বলা হলেও বাজেটে কর্মসংস্থান বাড়ানোর দিকনির্দেশনা না থাকা দুর্ভাগ্যজনক। অর্থ পাচার ও ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতা অর্থনীতির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হলেও অর্থমন্ত্রী বিষয়টি উল্লেখ করারই প্রয়োজন বোধ করেননি। সমস্যা স্বীকার না করলে সমাধান মিলবে কীভাবে?
অর্থমন্ত্রী পণ্যের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট বা মূল্য সংযোজন করই বহাল রেখেছেন। শেষ পর্যন্ত এর দায়টা চাপবে সাধারণ ভোক্তার ওপর। এর সঙ্গে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধিও জনজীবনে বিরূপ প্রভাব ফেলবে। বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ না থাকা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, জনশৃঙ্খলাসহ মানবসম্পদের বিভিন্ন খাতে বরাদ্দ কমানো এবং অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় বাড়ানোর প্রবণতা বাজেটের বড় দুর্বলতা হিসেবেই চিহ্নিত হবে। যেখানে বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ নেই, সেখানে ব্যাংকে রাখা অর্থের ওপর মাত্রাতিরিক্ত করারোপ আত্মঘাতী। এর মাধ্যমে অর্থমন্ত্রী বিদেশে অর্থ পাচারকেই উৎসাহিত করতে চান কি না, সেই প্রশ্ন এসে পড়ে। ব্যাংকে সাধারণত আমানত রাখে কারা? মধ্যবিত্ত পরিবারের অতি কষ্টে জমান কিছু টাকা থাকে ব্যাংকে আমানত হিসাবে। পরিবারের অতি আদরের মেয়েটির বিয়ের খরচ, পরিবারের কেউ হঠাৎ অসুস্থ হলে তার চিকিৎসা, সন্তানের উচ্চশিক্ষা এই সব ভেবেই তিল তিল করে জমানো টাকা আমানত হিসাবে রাখে মানুষ। শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারির পর মধ্যবিত্ত এবং স্বল্প আয়ের মানুষের বিনিয়োগের ক্ষেত্র আরও সংকুচিত হয়ে এসেছে। ব্যাংকলুটের হাজার কোটি, শেয়ার বাজারের দরবেশ বাবার টাকা কিংবা ইয়াবা সম্রাটের লক্ষ কোটি টাকা দেশের আমজনতার ব্যাংকে আমানত হিসাবে ঢোকে না। ব্যাংকে আমানতের ওপর সুদের হার কমছে বহুদিন ধরে। সুদের হার কমার একটি বড় কারণ হলো সরকারি ব্যাংকগুলোতে হরির লুট। বর্তমানে দেশে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ৭৩ হাজার কোটি টাকা। এর বাইরে প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ অবলোপন করা হয়েছে। যার মাধ্যমে এসব মন্দ ঋণ আর্থিক প্রতিবেদন থেকে মুছে ফেলা হয়েছে। এ ঋণ হিসাবে এলে খেলাপি ঋণ হতো ১ লক্ষ ১৮ হাজার কোটি টাকা। হিসাবটি আঁতকে ওঠার মতো। লুটপাটের মহোৎসবে সরকারি ব্যাংকগুলোতে মূলধন ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। জনগণের করের টাকায় মেটানোর চেষ্টা চলছে এই মূলধন ঘাটতি।
বাজেট বক্তৃতায় বুদ্ধিমান অর্থমন্ত্রী অবশ্য বিষয়টি চেপে গেছেন। সাধারণ মানুষের রক্ত পানি করা টাকা শুষে নিয়ে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা চলছে ব্যাংকগুলো। কিন্তু খেলাপি ঋণ গ্রহীতারা রয়ে গেছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে। অর্থমন্ত্রী তাদের চোখে দেখেন না। তার চোখ আটকে যায় পাতি মধ্যবিত্তের তিলতিল করে জমানো ১ লক্ষ টাকার ওপর। এর ফলে মানুষের মধ্যে সঞ্চয়ের প্রবণতা কমে যাবে। আবার ব্যাংকে সঞ্চয়ের ওপর সুদের হার এমনকি মূল্যস্ফীতির হারের চেয়েও কম। তার অর্থ হচ্ছে, কেউ যদি সঞ্চয় করে তার টাকার পরিমাণ দিন দিন আরো কমে যাবে। সরকারি ব্যাংকগুলোতে যে লুটতরাজ হয়েছে এবং হচ্ছে জনমনে সে সম্পর্কে যে ধারণা তৈরি হয়েছে তার প্রতিবিধান করার জন্য কী করা হবে নাকি বরাবরের মতো আগামী দিনেও জনগণের করের টাকা দিয়ে তাতে ভর্তুকি অব্যাহত রাখা হবে সে সম্পর্কে কোনও পরিকল্পনার কথা এই বাজেটে নেই। সরকারের উন্নয়ন বাজেটের চেয়ে রাজস্ব বাজেট অনেক বড়। সরকার ১৬ হাজার কোটি টাকা সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি করলেন, তাতে তাদের কর্মতৎপরতা কত শতাংশ বেড়েছে এবং দুর্নীতি কত শতাংশ কমেছে তার কোনও হিসাব তিনি উল্লেখ করেননি।
হঠাৎ চালের দাম বৃদ্ধি গরিব মানুষদের এমনিতে অসন্তুষ্টি বাড়িয়ে দিয়েছে। তার ওপর বিদ্যুৎ এবং গ্যাসের দাম বৃদ্ধি নিম্নআয়ের মানুষকেও ক্ষুব্ধ করেছে। বেকারদের জন্য বাজেটে খুশী হওয়ার মতো কিছু নেই। এর সাথে বর্তমান বাজেট মধ্যবিত্ত এবং ব্যবসায়ী শ্রেণিকে অসন্তুষ্ট করেছে। তাহলে প্রশ্ন- কোন শ্রেণিকে সন্তুষ্ট করার জন্য এটি করা হয়েছে? মাননীয় অর্থমন্ত্রীই সেটি ভালো জানেন। সকলের সাথে আলোচনা করে একটি গ্রহণযোগ্য বাজেট তৈরি করা কি এতটাই অসম্ভব ছিল? বর্তমান বাজেট আগামী নির্বাচনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
মাননীয় অর্থমন্ত্রীর এই ত্রুটিপূর্ণ ‘বেস্ট বাজেট’ (!) নিয়ে জনগণের মধ্যে তেমন কোনও ইতিবাচক মনোভাব দেখা যাচ্ছে না। সাধারণ জনগণের মতামত যতটা বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে দেখা গেছে; তাতে তারা তেমন ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেননি। প্রতি বছর ব্যবসায়ীরা যেটিকে মোটামুটি স্বাগত জানান এ বছর তাও তেমন দেখা যাচ্ছে না। সবশেষ কথা হলো, দিন দুপুরে ডাকাতির এ ত্রুটিপূর্ণ বাজেট জনগণ ভালো ভাবে নেবে না। এর দ্রুত সংশোধন না করলে, প্রজাপতি সরকার হিসেবে বর্তমান সরকার আখ্যা পাবে মানুষের কাছে; এবং বদলে যাবে অনেক হিসেব, সত্যি হবে কিছু আশংখা!
লেখক-হাসান হামিদ। গবেষক ও কবি।