ভাস্কর্য শিল্প একটি দেশের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। নানা সময়ে আবিষ্কৃত নানা ভাস্কর্য থেকে বোঝা যায়, সুদূর অতীতকাল থেকেই পৃথিবীতে ভাস্কর্য শিল্পের বিকাশ ঘটেছিলো। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে ভাস্কর্য পৃথিবীর ইতিহাস ও সংস্কৃতির গৌরব বহন করে চলেছে। আজো দেশে দেশে ভাস্কর্য তৈরি হচ্ছে নিপুণ সৃষ্টিশীলতায়। এর মাধ্যমে ফুটে উঠছে নিজ দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, কৃষ্টি-সংস্কৃতি। মুসলিম বিশ্বও ভাস্কর্য শিল্প থেকে পৃথক নয়। খোদ সৌদি আরব, ইন্দোনেশিয়া, মিশর, ইরান, ইরাকসহ প্রায় সকল মুসলিম দেশেই রয়েছে ভাস্কর্য।ইন্দোনেশিয়ায় নানা নিদর্শনইন্দোনেশিয়া মুসলিমের সংখ্যা অনুযায়ী বিশ্বে প্রথম। বিশ্বের মোট ইসলাম ধর্মাবলম্বীর শতকরা ১২.৯ ভাগ বাস করে ইন্দোনেশিয়ায়। সংখ্যার বিচারে এর পরই রয়েছে যথাক্রমে পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশ। ইন্দোনেশিয়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি দ্বীপ রাষ্ট্র। প্রায় ৫ হাজার দ্বীপের সমন্বয়ে গঠিত এ দেশটি পৃথিবীর বৃহত্তম মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র। এর রাজধানী জাকার্তা। দ্বাদশ শতকের দিকে ইন্দোনেশিয়ায় ইসলামের আগমন ঘটে এবং ১৬শ’ শতক নাগাদ জাভা ও সুমাত্রার লোকেরা ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়ে যায়।ইন্দোনেশিয়ায় প্রায় সাড়ে ১৭ হাজার দ্বীপ রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ৬ হাজার দ্বীপে মানুষ বসতি স্থাপন করেছে। সুমাত্রা, জাভা, সুলাওয়েসি, বোর্নিও ও নিউ গিনি পাঁচটি প্রধান দ্বীপ। চিত্রের ভাস্কর্যটি বালির ডেনপাসার এলাকার মূল সড়কে অবস্থিত। প্রচুর ভাস্কর্য রয়েছে গোটা দেশজুড়েই। এর মধ্যে বালিতে ভাস্কর্যের সংখ্যা বেশি।আধুনিক মালয়েশিয়ামালয়েশিয়ার রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। মুসলিম জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত মালয়েশিয়ার অবস্থান মুসলিম বিশ্বে ১৩তম। দুই কোটি ৮০ লাখের অধিক জনসংখ্যার দেশটির ৬০.৪ শতাংশ মানুষ মুসলিম। এখানেও রয়েছে অনেক দৃষ্টিনন্দন ভাস্কর্য। মালয়েশিয়ার সবচেয়ে বিখ্যাত ভাস্কর্য হলো ওয়াশিংটন মনুমেন্টের আদলে গড়া ন্যাশনাল মনুমেন্ট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে শহীদ হওয়া বীরদের স্মরণে ১৫ মিটারের এই ভাস্কর্যটি উন্মুক্ত করা হয় ১৬৬৩ সালে। প্রতীকীভাবে সাতজন বীরের প্রতিমূর্তির মাধ্যমে বিশ্বস্ততা, আত্মত্যাগ আর বন্ধুত্বের বিষয়টি এই ভাস্কর্যের মধ্য দিয়ে বোঝানো হয়েছে। মালয়েশিয়ার ভাস্কর্যশিল্প সনাতন ও আধুনিক ধারার এক স্বতন্ত্র মেলবন্ধন।মালয়েশিয়ার অন্যান্য উল্লেখযোগ্য ভাস্কর্যগুলো হলো বাতু কেভসের বিখ্যাত মুরুগান মূর্তি, কুচিং হলিডে ইন হোটেলের সামনে মার্জার মূর্তি এবং কনফুসিয়াসের মূর্তি। এখানে এসব ভাস্কর্য পরিদর্শনে পর্যটকরা নিয়মিত এসে থাকেন। ন্যাশনাল মনুমেন্টই সবচেয়ে বেশি বিখ্যাত।দৃষ্টিনন্দন কাতারপারস্য উপসাগরের একটি দেশ কাতার। দক্ষিণ আরবীয় অঞ্চলে ইসলাম প্রসারে আলা আল হাদরামি এখানে এসেছিলেন ৬২৮ সালে। তখন কাতার অঞ্চলে শাসন করছিল স্থানীয় বনু তামিম গোত্র। বনু তামিমের গোত্রপ্রধান মুনযির বিন সাওয়া আল তামিমি ইসলাম গ্রহণে সম্মত হন এবং পরে অন্যান্য গোত্রে ইসলাম প্রসারে ভূমিকা রাখেন।বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশগুলোর একটি কাতার। মোট জনসংখ্যার ৭৭.৫ শতাংশ মুসলিম। কাতারেও দেখা যায় ব্যয়বহুল ও দৃষ্টিনন্দন সব ভাস্কর্য ও স্থাপত্য। কাতারের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ভাস্কর্য হলো ‘হারনেসিং দ্য ওয়ার্ল্ড’, মানে হচ্ছে বিশ্বের সঙ্গে সংযোগ। কাতারের রাজধানী দোহায় কাতার সংস্কৃতি কেন্দ্রে কাতারা আম্পি থিয়েটারের সামনে স্থাপিত হয় পুরো পৃথিবীকে সংযোগ স্থাপন করা নারী প্রতিমূর্তির অবয়বের এই ভাস্কর্য। বিশ্বের নানা প্রান্তের পর্যটকদের জন্য এটি আকর্ষণীয় স্থান।সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিস্ময়১৯৭১ সালে ১৪ দিনের ব্যবধানে স্বাধীন হয়েছিলো বাংলাদেশ আর সংযুক্ত আরব আমিরাত। একই বছর স্বাধীন হয়ে আজ আমিরাত বিশ্বের উন্নত দেশের কাতারে শামিল। পরিকল্পনা ও কর্মদক্ষতার মধ্য দিয়ে আমিরাত বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে।সংযুক্ত আরব আমিরাত মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে আরব উপদ্বীপের দক্ষিণ-পূর্ব কোনায় অবস্থিত সাতটি স্বাধীন রাষ্ট্রের একটি ফেডারেশন। এগুলো একসময় ট্রুসিয়াল স্টেটস নামে পরিচিত ছিল। সংযুক্ত আরব আমিরাতে তলোয়ার নৃত্য জনপ্রিয়। অন্যান্য আরব দেশের মতো এখানে তলোয়ার নৃত্য প্রচলিত। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘সোর্ড ড্যান্স’। সংযুক্ত আরব আমিরাতের উল্লেখযোগ্য ভাস্কর্য হলো আরবীয় যুগলের মূর্তি, দুবাইয়ের ওয়াফি অঞ্চলের প্রবেশপথে পাহারাদারের প্রতিমূর্তি হিসেবে সংস্থাপিত কুকুরের মূর্তি, দুবাইয়ের ইবনে বতুতা মার্কেটে স্থাপিত মূর্তি।তুরস্কজুড়েই কামাল আতাতুর্কতুরস্কের প্রথম প্রেসিডেন্ট মোস্তফা কামাল তুর্কি প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ছিলেন একাধারে সামরিক ব্যক্তিত্ব, লেখক, বিপ্লবী ও জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রনেতা। তার নেতৃত্বে খেলাফত শাসনের অবসান ঘটিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ এক আধুনিক তুরস্কের যাত্রা। তিনি আধুনিক তুরস্কের জনক। তুর্কি ভাষায় ‘আতা’ মানে জনক। ‘তুর্ক’ তো তুরস্ক। তাই তিনি আতাতুর্ক। স্বাভাবিকভাবেই তুরস্কজুড়ে রয়েছে কামাল আতাতুর্কের মূর্তি।এককালের সারা মুসলিম জাহানের খলিফার দেশ তুরস্ক সাংবিধানিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হলেও জনসংখ্যার বেশিরভাগই মুসলিম। সারা তুরস্কের বিভিন্ন স্থানে রয়েছে প্রেসিডেন্ট কামাল আতাতুর্কের অগণিত মূর্তি। একেকটি দৃষ্টিনন্দন ভাস্কর্যে একেক রকমভাবে আতাতুর্ক এবং তুরস্কের ইতিহাস, ঐতিহ্য বিবৃত করা হয়েছে। কামাল আতাতুর্কের ভাস্কর্য ছাড়াও তুরস্কের উল্লেখযোগ্য ভাস্কর্য হলো মর্মর সাগর তীরে পোতাশ্রয়ে অপূর্ব মর্মর মূর্তি, আঙ্কারাতে ইন্ডিপেনডেন্স টাওয়ারের পাদদেশে তুরস্কের জাতীয় সংস্কৃতির ধারক তিন নারী মূর্তি ও আন্তালিয়ায় এডুকেশন অ্যাক্টিভিস্ট তুরকান সায়লানের মূর্তি। তুরস্ক ভ্রমণে এসব মূর্তি ভ্রমণপিপাসুদের নজর কাড়ে।ইরাকজুড়ে এখনো নানা কীর্তিইসলামের ইতিহাসের স্বর্ণযুগের প্রতিভূ ইরাক। জনসংখ্যার ৯৭ শতাংশ মুসলিম। ইরাকেও আছে অনেক ভাস্কর্য। বাগদাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সামনে ডানার ভাস্কর্যটি সবার নজর কাড়ে। বাগদাদের পাশে আল-মনসুর শহরে আছে মনসুরের একটি বিশাল ভাস্কর্য। আছে অনেক সাধারণ সৈনিকের ভাস্কর্য। সাদ্দাম হোসেনের বিশাল আকারের ভাস্কর্য ছিলো যেটি আর এখন নেই। মার্কিন আগ্রাসনের পর ভেঙে ফেলা হয় সেটি।৭ হাজার বছরের পুরোনো সংস্কৃতির সন্ধান পাওয়া গেছে এই দেশে। প্রয়াত প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন ১৯৭৯ সাল থেকে ২০০৩ সাল নাগাদ ২৪ বছর ইরাকের রাষ্ট্র-ক্ষমতায় ছিলেন। তখন ইরাকের আনাচে-কানাচে ছিলো সাদ্দাম হোসেনের নানান মূর্তি। ৯ এপ্রিল, ২০০৩ মার্কিন নেতৃত্বাধীন যৌথবাহিনীর হাতে সাদ্দাম সরকারের পতন ঘটে। ক্ষমতার পালাবদলে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় সাদ্দাম হোসেনের সব মূর্তি। তাই বলে ভাস্কর্যহীন হয়নি ইরাক। প্রচুর ঐতিহাসিক ও দৃষ্টিনন্দন ভাস্কর্যের মালিক দেশটি। রাজধানী বাগদাদেও বেশ কিছু বিখ্যাত মূর্তি রয়েছে। যেমন ইন্টারন্যাশনাল জোনে হাম্মুরাবির মূর্তি। আরব্য উপন্যাসের প্রধান চরিত্র শাহেরজাদি এবং রাজা শাহরিয়ারের মূর্তি রয়েছে এখানে।সৌদি আরবে বর্ণিল উটইসলামের পুণ্যময় ভূমি বলা হয়ে থাকে সৌদি আরবকে। ইসলাম ধর্মের পবিত্র নগরী মক্কা ও মদিনা এই দেশে অবস্থিত। প্রতি বছর অগণিত মুসলমান এখানে আসে গোটা বিশ্ব থেকে। এখান থেকে ইসলামের আলো বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। শতভাগ মুসলিম দেশ সৌদি আরব মধ্যপ্রাচ্যের বৃহত্তম রাষ্ট্র। সৌদি আরবের বাণিজ্যিক রাজধানী জেদ্দা নগরীতে আছে উটের দৃষ্টিনন্দন ভাস্কর্য।রাজধানী জেদ্দার উল্লেখযোগ্য ভাস্কর্যের মধ্যে রয়েছে নগরীতে মুষ্টিবদ্ধ হাত, হাংরি হর্স, মানব চোখ, মরুর বুকে উটের ভাস্কর্য। আফগানিস্তানের জঙ্গিরাও হাত দেয়নি অষ্টম শতকের সমরনায়ক আবু মুসলিম খোরাসানির ভাস্কর্যের গায়ে। গজনীতে এখনো স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে সেই ভাস্কর্য। সৌদি আরব নামকরণটি হয়েছে এ দেশের শাসনকারী রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা আবদুল আজিজ আল সউদের নামানুসারে। সভ্যতার শুরু থেকে এখানেও শিল্পকর্মের প্রতি মানুষের আলাদা একটা ঝোঁক লক্ষণীয়।ইরানের পথে পথে মনীষীইসলামী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ইরান অন্যতম। প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় পারস্যের ইতিহাসের সূচনা প্রায় এক লাখ বছর আগে থেকে। ইরানে আছে একটি বিশাল স্বাধীনতাস্তম্ভ, যার নাম ‘আজাদি’। এ স্থাপত্যটির ডিজাইনার হোসেন আমানত একজন মুসলমান। কবি ফেরদৌসী, ওমর খৈয়াম, পারস্যের নেপোলিয়ন বলে খ্যাত নাদির শাহর মতো খ্যাতিমান ব্যক্তিদের ভাস্কর্য রয়েছে ইরানে।মাশহাদ নগরীতে ভাস্কর্যসংবলিত নাদির শাহর সমাধিসৌধটি পর্যটকদের কাছে খুবই আকর্ষণীয়। বেশির ভাগই ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বদের স্মরণে নির্মিত। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- তেহরানের ফেরদৌসী স্কয়ারে স্থাপিত মহাকবি ফেরদৌসীর মূর্তি, ইরানের হামাদানে ইবনে সিনার মূর্তি, তেহরানের লালেহ পার্কে রয়েছে ওমর খৈয়ামের ভাস্কর্য, কবি হাফিজের ভাস্কর্য। ইরানের ইসলামী বিপ্লবের নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনি বা ইমাম খোমেনির একাধিক ভাস্কর্য ও ম্যুরাল রয়েছে ইরানে। এর মাধ্যমে ইতিহাস, ঐতিহ্য ও বিপ্ল­বের আদর্শ তুলে ধরা হয়েছে।সম্প্রতি বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য স্থাপন নিয়ে দেশে সম্প্রতি বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। অরাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে দাবিকারী হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক প্রকাশ্যে এই বিতর্ক উস্কে দেওয়ার পর সংগঠনটির নবনির্বাচিত আমির জুনায়েদ বাবুনগরীও শুক্রবার (২৭ নভেম্বর) চট্টগ্রামের এক সমাবেশে ভাস্কর্য-বিরোধী অবস্থান ব্যক্ত করেছেন। এর ঢেউ এখন সংক্রমিত করছে অন্য ইসলামি দলগুলোকেও। এর বিপরীতে কঠোর অবস্থান নিয়েছে সরকারের ছাত্র ও যুব অঙ্গ ও ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠনগুলোসহ বাম ও প্রগতিশীল ধর্মভিত্তিক কয়েকটি রাজনৈতিক দল ও তাদের ছাত্র সংগঠন। তবে এই বিতর্ক ওঠায় সঙ্গতকারণে প্রশ্ন জাগে, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যই কি দেশে প্রথম? খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশে ভাস্কর্য নির্মাণের আছে দীর্ঘ ইতিহাস। দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বদের প্রতিকৃতি নির্ভর ভাস্কর্যগুলোর সংখ্যাও কম নয়।-পূর্বপশ্চিমবিডি

 

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn