মহান মুক্তিযুদ্ধে আমার আত্মপক্ষ
নজির হোসেন(মুক্তিযোদ্ধা)-
আমার মুক্তিযুদ্ধের অভিযাত্রা শুরু হয় গোপন রাজনীতি দিয়ে। গোপন কমিউনিস্ট পার্টির সিলেট জেলা কমিটির সদস্য হিসেবে সুনামগঞ্জ মহকুমা পার্টির দায়িত্ব নিয়ে আমি সুনামগঞ্জ আসি ১৯৬৯ সালে। ছাত্রইউনিয়ন, ন্যাপ ও কৃষক সমিতির সাংগঠনিক রাজনৈতিক নেতৃত্বের দায়িত্ব আমাদেরকে পালন করতে হয়।দ একটি সমাজবিল্পব সংগঠনের লক্ষ্যে আমি নিজেকে উৎসর্গিত করি। এই রাজনৈতিক দায়িত্ব পালন কালে মুক্তিযুদ্ধটা আমাদের সামনে চলে আসে । ৬৯,৭০,৭১ সাল জুড়ে স্বায়ত্ত্বশাসন গণতন্ত্র এবং মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ে শ্রেণি সংগ্রাম কমিউনিস্ট পার্টির তিনজনের সেলটি অক্লান্তভাবে পরিচালনা করি। একাত্তর সাল শুরু হয় নূতন শপথে। পার্টির ভিতরে স্বশস্ত্র লড়াইয়ের প্রস্ত্তুতি চলতে থাকে।
ছাত্রইউনিয়নের কর্মীদের যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হওয়ার জন্য আমি মটিভেশন শুরু করি। সুনামগঞ্জের যুদ্ধের সাংগঠনিক দায়িত্বটা এসে পড়ে আকস্মিকভাবে। ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ ৫০জনের যুদ্ধাদল গঠনে নেতৃত্বের ভূমিকা আমি এবং হোসেনবখত সাহেব পালন করি। ২৮শে মার্চ কার্ফু ভংগ করার সিদ্ধান্ত আমি এককভাবে গ্রহন করি। এবং যুদ্ধ শুরুর সিদ্ধান্তটাও আমি গ্রহন করি।
কার্ফু ভংগ করন এবং যুদ্ধ সংগঠনের জন্য ইপিআর ক্যাম্পে গিয়ে মিছিলে পটেকশন দিতে রাজী করানো এবং পুলিশকে পক্ষ ত্যাগ করাতে রাজী হওয়ার কাজটি এককভাবে আমি করি। মনোয়ার বখত নেক কে আমাদের যুদ্ধাবাহিনীকে ২৮শে মার্চে সার্কিট হাউসের চার দিকে জড় করতে নদী ওপাড়ে পাঠাই। সে সময়মত তাদের নিয়ে যথাস্থানে হাজির হয়।
মালেক পীরকে পাঠাই হুমায়ূন কবীর চৌধুরীর কাছে ছাত্রদের একটি সভা বড়পাড়ার বাগানবাড়ীতে ডাকার জন্য। আমি সকাল ৭টায় এই মিটিং এ হাজির হয়ে কার্ফু ভংগের সিদ্ধান্ত করি। কার্ফু ভংগের মিছিলটা শুরু হয় হাছননগর কলেজ পয়েন্ট থেকে। মিছিল শুরুর সিদ্ধান্তটা আমাকেই নিতে হয়। যুদ্ধটা জনযুদ্ধে পরিণত হয়।
১৯৭১ সালের ১০ ই মে পর্যন্ত সুনামগঞ্জের প্রশাসন এবং মুক্তিযুদ্ধাদের পরিচালনায় আমার ছিল অগ্রগামী ভূমিকা। ১৯৭১ সালের ৯ই জুন ভারতীয় পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের সর্বাধীনায়ক গিলভার সিং গিল এর সাথে বৈঠক এবং টেকেরঘাটে ন্যাপ কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব একটি গেরিলা জোন গড়ে তোলার প্রস্তাবনা ছিল আমার।
৯ইজুন ১৯৭১ সালে গিলভার সিং গিল বাবু সুরঞ্জিত সেন গুপ্তকে সেক্টর কমান্ডার এবং আমাকে তার টুআইসি নিয়োগ দিয়ে ১০ই মে ১৯৭১ সালে টেকেরঘাট পাঠিয়ে দেন। আমরা ১৯৭১ সালের ২৭ অক্টোবর পর্যন্ত টেকেরঘাট গেরিলা জোনের কমান্ডিং এর দায়িত্বে ছিলাম। কমরেড বরুনরায় আমাকে কমিউনিষ্ট গেরিলা সংগঠনের দায়িত্ব দেন।
কিন্তু আমি সুনামগঞ্জে পার্টি লাইনের বাইরে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠনের মধ্যদিয়ে সংগ্রামের নূতনমাত্রা অর্জন করতে পারার কারনে আমি সর্বদলীয় ধারায় থেকেই যুদ্ধ করার পক্ষপাতি ছিলাম। তবু ১৯৭১ সালের ১১ই জুন টেকেরঘাট গেরিলা জোনের কমান্ড টীম আমাকে টুআইসির বাইরে গেরিলা জোনে গোয়েন্দা নেট ওয়ার্ক গড়ে তোলার দায়িত্ব প্রদান করে ৷ফলে কমান্ডের বাইরে আমার একটা স্বাধীন অস্থিত্ব তৈরী হয়।
আমি সারা গেরিলা জোনে একটি গোয়েন্দা নেট ওয়ার্ক দাড় করিয়ে ফেলি মেজর বাট ও ক্যাপ্টেন বার্মা আমার প্রতি একান্ত নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। আমি সুযোগ বুঝে কমিউনিস্ট গেরিলাদের জন্য অস্ত্র এবং রসদ সরবরাহ করতে মেজর বাটকে রাজী করিয়ে ফেলি। এবং বালিজুরীর জনাব শামছুল হকের নেতৃত্বে প্রথম ন্যাপ কমিউনিস্ট গেরিলা যুদ্ধা দল গঠন করে ফেলি।
কিছু দিনের মধ্যে অপারেশন শুরু হলে অভিজ্ঞ ও সাহসী গাইডের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। সেনদা আমাকে ডেকে যুদ্ধা দলের গাইড এর দায়িত্ব দিতে থাকেন। মূলতঃ গাইড হলো অস্ত্রবিহীন যুদ্ধা। আমি দ্রুতই অস্ত্র প্রশিক্ষণ শেষ করলাম ।এবং আমার নামে একটি এসএমজি বরাদ্ধ করে নিলাম।
১৯৭১ সালে ২৭শে অক্টোবর মেজর মুসলিম উদ্দিনকে টেকেরঘাট সাব সেক্টরের জন্য বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে কমান্ডার নিয়োগ করেন। ক্ষমতা হস্তান্তরে কিছুটা ভুল বুঝাবুঝি হয়ে যায়। ৩০শে অক্টোবর জনাব আব্দুল হাইয়ের মাধ্যমে মেজর দীনকে সব কিছু বুঝিয়ে দেই। এতেই মেজর দীন আমার প্রতি রুষ্ট হয়ে পড়েন। কয়েকদিন পড়ে আমাকে কমান্ডার এবং মনোয়ারকে ডেপুটি করে একটি গেরিলা দল গঠন করেন। আমি একজন কমান্ডার হিসেবে যুদ্ধে আত্ম নিয়োগ করি।
মুক্তিযুদ্ধা সর্টিফিকেট নেওয়া থেকে বিরত সবাই পিটিআই এ স্থাপিত মুক্তি যুদ্ধা ক্যাম্প থেকে সার্টিফিকেট নিয়ে যাচ্ছিল মুক্তিযুদ্ধারা। আমাকে অনেকে মুক্তিযুদ্ধা সার্টিটিফিকেট নিয়ে আসতে বললো। আমর চোখে মুখে হৃদয়ে আরো একটি বিপ্লবের আখাংকা। বাংলাদেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হবে। গরীব মেহনতি মানুষের রাষ্ট্র ক্ষমতা হবে। সে বিপ্লবে জিতে গিয়ে সার্টিফিকেট নেব। এই সমস্ত ভাবনাগুলি জট পাকিয়ে ছিল হৃদয়ে আর মস্তিষ্কে।
এছাড়াও মেজর মুসলিম উদ্দিনের কাছ থেকে একটা সার্টিফিকেট নেওয়ার মানসিকতা আমি হারিয়ে ফেলেছিলাম। মেজর বাথ বিদায়ের আগে আমার জন্য একটি উচছসিত প্রশংসাপত্র রেখে যান। আমি এটা জামালগঞ্জে নিয়ে এসেছিলাম। আমি সংগ্রাম পরিষদের ফাইলটি রেখে এসেছিলাম জনাব আমান রেজা সাহেবের বাংলো ঘরের ছাদের শিলিং এ। সুনামগঞ্জ থেকে এই ফাইলটিও নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু এক্সিডেন্টলী আমার সাচনা বাজার অফিসের কাগজপত্র পুড়ে যায়। দুইটি মূল্যবান ঐতিহাসিক দলিল হারিয়ে যায়। নজির হোসেনের বয়ানে তিনিই সুনামগনজে মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেন।
লেখক: সংগঠক, টুআইসি, গাইড, গোয়েন্দা প্রধান,কমিউনিস্ট গেরিলা সংগঠক,মুক্তিযুদ্ধা কমান্ডার ও সাবেক সাংসদ