রুশনারা আলী |

বুধবার সকালে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক অফিস মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিমদের দুর্ভোগ নিয়ে সর্বশেষ রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। এক্ষেত্রে তারা ব্যক্তি ও গ্রুপ   পর্যায়ে ৬৫ জনের  সাক্ষাৎকার নিয়েছে। মিয়ানমারের রাখাইন থেকে সম্প্রতি সীমান্ত পালিয়ে তারা বাংলাদেশের কক্সবাজারে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। তাদের সাক্ষাৎকারের ওপর ভিত্তি করে ওই রিপোর্ট তৈরি করা হয়েছে। ওই রিপোর্টটি পড়তে গিয়ে অস্বস্তিতে পড়তে হয়।  এতে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নৃশংস হামলা ছিল সুপরিকল্পিত, সুসমন্বিত ও সিস্টেমেটিক। জাতিসংঘ টিমের মতামত অনুযায়ী, এসব সহিংসতা ঘটিয়েছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। তাদের উদ্দেশ্য শুধু মিয়ানমারের জনগণকে তাড়িয়ে দেয়া নয়, একই সঙ্গে তাদের বাড়িঘরে ফেরা প্রতিরোধ করা।
২৫শে আগস্ট সরকারি বাহিনীর ওপর হামলা চালায় আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি (আরসা)। তারপর থেকে কমপক্ষে পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে পালিয়েছে। রিপোর্ট অনুযায়ী, সেনাবাহিনী আরসার হামলার জবাবে যে ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন্স’ চালিয়েছে তা তো অনেক আগে থেকেই চালিয়ে আসছিল সেনাবাহিনী। মিয়ানমারের সাম্প্রতিক ইতিহাসে মানবাধিকারের এমন ভয়াবহ লঙ্ঘন ও মানবিক সংকট অপ্রত্যাশিত। এর ফলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে জরুরি পদক্ষেপ নিতে উদ্বুদ্ধ করছে।  রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান অনেক দিনের ও বৈষম্যমূলক। যখন এক বছর আগে সহিংসতা সৃষ্টির পর ২০১৩ সালে আমি ওই দেশটি সফরে যাই সেখানে আমি দেখেছি ভয়াবহতা, যার জন্য এ সম্প্রদায়কে দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় পালিয়ে যেতে বাধ্য করা হয়েছে। নৌকাযোগে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাই কমিশন পরিচালিত একটি ক্যাম্প পাকটাওয়া পরিদর্শন করেছি আমি। সেখানে দেখতে পেয়েছি ওই ক্যাম্পের কয়েক গজ দূরেই মলমূত্র। তার কয়েক গজ দূরে শিশুরা গোসল করে। নারীদের ধর্ষণের, পরিবারের শিশু ও পুরুষ সদস্যদের হত্যার গা শিউরে ওঠার মতো কাহিনী শুনেছি।
২০১২ সালে ওই সহিংসতা সৃষ্টির পর রাখাইনে বসবাসকারী রোহিঙ্গা মুসলিমদের অবস্থা নাটকীয়ভাবে আরো খারাপ থেকে খারাপ হতে থাকে। গত বছর অক্টোবরে ৯ জন সীমান্তরক্ষীকে হত্যা করার পর ওই রাজ্যের সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায় আবারো ভয়াবহ নৃশংস হামলার শিকারে পরিণত হয়েছে। এরই মধ্যে তাদেরকে সেখান থেকে প্রায় উৎখাত করা হয়েছে। এ সম্প্রদায়টি রয়েছে বঞ্চিত ও নির্যাতিত অবস্থায়। যারা পালিয়ে এসেছেন তাদের মধ্য থেকে প্রত্যক্ষদর্শীরা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালকে বলেছেন, সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে মিয়ানমারের নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা শত শত বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে। তখন প্রায় এক লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে চলে আসেন। এ বছর আবার যখন আমি রাখাইন সফরে গেলাম, এবারও সেই একই দুর্বিষহ পরিস্থিতি প্রত্যক্ষ করলাম। প্রত্যক্ষ করলাম তাদের বাস্তুচ্যুত হওয়ার কারণ কি।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনারের অফিস থেকে ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত এক রিপোর্টে গত বছর রোহিঙ্গারা কি ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকারে পরিণত হয়েছিলেন তার বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। এই রিপোর্টে জাতিসংঘ প্রামাণ্য হিসেবে অনেক তথ্য তুলে ধরেছে। তাতে বলা হয়েছে, গণধর্ষণ করা হয়েছে। হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছে। এমন শিকারে পরিণত হয়েছে শিশু ও কিশোর-কিশোরীরা। নৃশংসভাবে প্রহার করা হয়েছে। গুম করা হয়েছে।  মিয়ানমারের ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইনের অধীনে রোহিঙ্গা মুসলিমরা সাংবিধানিক অধিকার বঞ্চিত। এই আইনের অধীনে যেসব মানুষ জাতীয়ভাবে স্বীকৃত কোনো জাতিগোষ্ঠীর হবেন তিনিই মিয়ানমারের পূর্ণ নাগরিকত্ব পাবেন। এর আওতায় ওইসব মানুষকে স্বীকৃতি দেয়ার কথা বলা হয়েছে যারা ১৮২৪ সালে মিয়ানমারে বসতি স্থাপন করেছেন। ওই সময়টা হলো বৃটেনের প্রথম দখলদারিত্বের।  কয়েক মাস আগে রাখাইনে আরেক দফা হামলা হয় রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে। তখন বৃটিশ এমপিরা ও হাউজ অব লর্ডসের সদস্যরা আগস্টে আরো সহিংসতার বিষয়ে মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠনগুলোর রিপোর্টের বিষয়ে দ্রুততার সঙ্গে সাড়া দেয়।
৬ই সেপ্টেম্বর পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসনকে কমপক্ষে ১৭০ জন পার্লামেন্টারিয়ানের স্বাক্ষর করা একটি চিঠি দেয়া হয়। ওই চিঠিতে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ভয়াবহ সহিংসতার নিন্দা জানানো হয় এবং বৃটিশ সরকারের জরুরি ভিত্তিতে দুটি করণীয় জোর দিয়ে তুলে ধরা হয়। এর প্রথমটি ছিল, রোহিঙ্গা সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক সামরিক হামলা বন্ধে যতটা সম্ভব তা করবেন বৃটেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এটা করতে আমরা সরকারের কাছে আহ্বান জানিয়েছিলাম মিয়ানমারের সেনা নেতাদের বিরুদ্ধে আরো চাপ সৃষ্টি করতে। অং সান সুচি রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সহিংসতার নিন্দা জানাতে ব্যর্থ হয়েছেন এবং তিনি রোহিঙ্গাদের অধিকারের পক্ষে দাঁড়াতে ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি দাঁড়িয়েছেন সেনাবাহিনীর পক্ষে। এটা গভীর এক হতাশাজনক অবস্থা। দেশটির নিরাপত্তা পরিচালনার ক্ষমতা সাংবিধানিকভাবে চলে গেছে সেনাবাহিনীর হাতে। তাই সেনাবাহিনীর হামলা বন্ধে সুচির ক্ষমতা সীমিত। তাই অবশ্যই তিনি রোহিঙ্গাদের অধিকারের পক্ষে কথা বলতে সমর্থ নন।
মিয়ানমারে ক্ষমতাধর সেনাবাহিনীর নেতাদের ওপর তাই অধিকার চাপ সৃষ্টি করতে হবে ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন্স’ বন্ধ করতে। সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘে প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মে ঘোষণা দিয়েছেন মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে বৃটিশ সেনাবাহিনী যে প্রশিক্ষণ দেয় তা অবিলম্বে স্থগিত হবে। তিনি যথার্থই এ ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু এটাই যথেষ্ট নয়। রোহিঙ্গাদের ওপর হত্যাযজ্ঞ, নিষ্পেষণ বন্ধে মিয়ানমারের বেসামরিক ও সামরিক সরকারের ওপর তাই সমন্বিতভাবে আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করতেই হবে। চাপ সৃষ্টি করতে হবে যেন মিয়ানমারের ভেতরে থাকা রোহিঙ্গাদের ও পালিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গাদের দেশে ফেরার ক্ষেত্রে তাদেরকে নিরাপত্তা দিতে। যেসব রোহিঙ্গা পালিয়ে এসেছেন তাদের জরুরি মানবিক চাহিদার দিকে জরুরি ভিত্তিতে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এক সঙ্গে এত অল্প সময়ে এত বিশাল সংখ্যক মানুষের বাস্তুচ্যুত হওয়া ও দেশত্যাগ, জরুরি ভিত্তিতে মানবিক ত্রাণের দাবি রাখে। এটা জেনে স্বাগত জানাই যে, ডিপার্টমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট মিয়ানমারে মানবিক সহায়তা বৃদ্ধি করছে আড়াই কোটি পাউন্ড।
এরই মধ্যে রোহিঙ্গাদের জন্য, যারা এরই মধ্যে সহিংসতার কারণে দেশ ছেড়েছেন তাদের জন্য জরুরি ভিত্তিতে খাদ্য, পানি, আশ্রয় ও চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহে বৃটেনের জরুরি দুর্যোগ বিষয়ক কমিটি অর্থ সংগ্রহ করছে।  রোহিঙ্গাদের সহায়তা করতে মিয়ানমার সরকারকে অব্যাহতভাবে চাপে রাখতে হবে বৃটিশ পার্লামেন্ট থেকে। মঙ্গলবার রোহিঙ্গাদের নিষ্পেষণের বিষয়ে আলোচনার জন্য তিন ঘণ্টা সময় আলাদা করে রাখবে।  কয়েক সপ্তাহ আগে জাতিসংঘ বলেছে, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী জাতি নিধন অভিযান চালাচ্ছে। জাতিসংঘের এমন রিপোর্টের পক্ষে দাঁড়াতে হবে পার্লামেন্টারিয়ানদের।  এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো এই হতাশাজনক মানবাধিকার লঙ্ঘন ও মানবিক সংকট সমাধানে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও অং সান সুচির ওপর অব্যাহতভাবে চাপ সৃষ্টি করতে হবে।  রুশনারা আলী, বৃটেনের বেথনাল গ্রিন অ্যান্ড বো’র এমপি। তিনি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিষয়ক সাবেক ছায়ামন্ত্রী।  (অনলাইন লেবার লিস্ট-এ প্রকাশিত তার লেখার অনুবাদ)
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn