বার্তা ডেস্ক :: কুমিল্লায় আট বছর বয়সী এক শিশু হত্যার মামলায় মৃত্যুদণ্ড পাওয়া একমাত্র আসামি ১৬ বছর ধরে কারাভোগ করার পর সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে নির্দোষ সাব্যস্ত হয়েছেন। ফাঁসির আসামি হুমায়ুন কবিরের জেল আপিল গ্রহণ করে মঙ্গলবার প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন চার বিচারকের ভার্চুয়াল আপিল বেঞ্চ এ রায় দেয়। আদালতে জেল আাপিলের পক্ষে শুনানি করেন রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী এ বি এম বায়েজিদ; রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিশ্বজিৎ দেবনাথ। রায়ের ফলে ১৬ বছরেরও বেশি সময় ধরে কারাগারে থাকা হুমায়ুন কবিরের মুক্তিতে কোনো বাধা নেই বলে জানান রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী। রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী এ বি এম বায়েজিদ সাংবাদিকদের বলেন, মামলাটিতে শিশুটির বাবাসহ ১২ জন স্বাক্ষ্য দিয়েছেন। কিন্তু কোনো স্বাক্ষীই বস্তুনিষ্ঠ স্বাক্ষ্য দেয়নি। শিশুটির লাশ উদ্ধারের সময় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সেখানে ছিলেন বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ থাকলেও বিচারের সময় তাকে জেরা করা হয়নি।

তিনি বলেন, ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে আসামিকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, শিশুটি তার খালাত বোনের মেয়ে। অথচ শিশুটির বাবা সাক্ষ্যে বলেছেন, আসামিকে তিনি চেনেন না। আবার শিশুটির মাকেও মামলায় সাক্ষী করা হয়নি। তাহলে সংশয়টা দূর হতো।“ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শিশুটির মাথার খুলি ভাঙা ছিল। অথচ আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জানবন্দিতে উল্লেখ আছে, শিশুটিকে তিনি মুখ চেপে ধরে হত্যা করেছেন। তাই হত্যাকাণ্ডের বর্ণনার ক্ষেত্রেও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন ও আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে অমিল আছে।”তাছাড়া প্রত্যক্ষদর্শী যে দুই শিশুকে মামলাটিতে স্বাক্ষী করা হয়েছে, তাদের স্বাক্ষ্যেও আদালত যথেষ্ট অসামঞ্জস্য পেয়েছে বলে এ আইনজীবী জানান। বায়েজিদের দাবি, সাক্ষ্যে বস্তুনিষ্ঠতার অভাব, অসামঞ্জস্যতা ও নানা ত্রুটির কারণেই মামলার একমাত্র আসামি হুমায়ুন কবিরকে খালাস দিয়ে রায় দিয়েছে সর্বোচ্চ আদালত। মামলার এজাহারের তথ্য অনুযায়ী, লাকসামের কনকশ্রী গ্রামের সাকেরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণির ছাত্রীটি ২০০৪ সালের ৩০ জুন বেলা সোয়া ১০টার দিকে স্কুলে যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বের হয়। ছুটির পরও বাড়ি ফিরে না আসায় অভিভাবকরা খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, শিশুটি স্কুলে যায়নি। এরপর আত্মীয়-স্বজনদের বাড়ি ও সম্ভাব্য স্থানে তাকে খুঁজে না পেয়ে ওই দিনই থানায় সাধারণ ডায়রি (জিডি) করেন শিশুটির চাচা জসীম উদ্দিন।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে সাকেরা উচ্চ বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির দুই শিক্ষার্থীর বরাত দিয়ে এজাহারে বলা হয়, স্কুলে যাওয়ার পথে মাথা ব্যথা নিয়ে শিশুটিকে ওই গ্রামের মাস্টার বাড়ির পাশে কালভার্টের উপর শুয়ে পড়তে দেখে তারা। তখন আরও ৫ থেকে ৬ জন ছিল সেখানে। তাদের বর্ণনা অনুযায়ী, হুমায়ুন কবির তখন সেখানে এসে সবাইকে তাড়িয়ে দিতে থাকেন। তিনি শিশুটির মামা পরিচয় দিয়ে তাকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার কথা বলেন। শিশুটিও বলে, সে তার মামার সাথে যাবে। মামলার বাদী জসীমের বরাত দিয়ে এজাহারে বলা হয়, “হুমায়ুন কবির আমার ভাতিজিকে বাড়ি পৌঁছে না দিয়ে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে কোনো নারী ও শিশু পাচারকারীর কাছে বিক্রি করে দেয় অথবা আটকে রাখে।” এঘটনায় আইনগত ব্যবস্থার আরজি জানিয়ে লাকসাম থানায় এজাহার দায়েরের পর ওই বছরের ২ জুলাই নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করে পুলিশ। ৪ জুলাই পেশায় ট্রাক ড্রাইভার হুমায়ুন গ্রেফতারের পর সে দিনই কালভার্টের পাশে জঙ্গলের ভেতর থেকে শিশুটির লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। পরে এটিকে হত্যা মামলায় রূপান্তর করে ওই বছর ২৯ সেপ্টেম্বর আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। বিচার শেষে ২০০৬ সালের ৫ এপ্রিল চট্টগ্রামের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক এ এইচ এম মোস্তাক আহমেদ হত্যার জন্য দোষী সাব্যস্ত করে হুমায়ুন কবিরকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন। রায়ের পর পরই মামলার ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে অনুমতি চেয়ে আবেদন) হাই কোর্টে আসে। ওই বছরই জেল আপিল করেন আসামি। শুনানি শেষে ২০১২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি উচ্চ আদালত মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে। এই রায়ের বিরুদ্ধে ওই বছরের ১৫ এপ্রিল জেল থেকে আবেদন (জেল পিটিশন) করেন হুমায়ুন কবির। ২০১৪ সালের ১৭ এপ্রিল আবেদনটি আপিল হিসেবে গ্রহণ করেছিল সর্বোচ্চ আদালত। তার শুনানি শেষে খালাসের রায় দিল আপিল বিভাগ।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn