যানজটপ্রবণ এলাকা থেকে অফিস ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরানোর সুপারিশ
জেসমিন মলি ও শামীম রাহমান||যানজটের কারণে রাজধানীতে যানবাহনের গড় গতি ঘণ্টায় সাত কিলোমিটারে নেমে এসেছে; যেখানে হেঁটে চলার গড় গতি ঘণ্টায় পাঁচ কিলোমিটার। বিশ্বব্যাংকের গবেষণা বলছে, শুধু যানজটের কারণেই দৈনিক ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে রাজধানীবাসীর। এ যানজট আরো বাড়িয়ে তুলেছে নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় অফিস-রেস্তোরাঁ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আধিক্য। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে যানজটপ্রবণ এলাকা থেকে অফিস, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও রেস্তোরাঁ সরিয়ে নেয়ার সুপারিশ করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি।
রাজধানীর সবচেয়ে ব্যস্ত ও গুরুত্বপূর্ণ বিমানবন্দর-মতিঝিল সড়ক। সড়কটির বিমানবন্দর, মহাখালী ও ফার্মগেট পয়েন্ট থেকেই পুরো শহরে ছড়িয়ে পড়ে যানজট। এছাড়া গুলশান, বনানী, ধানমন্ডিসহ বিভিন্ন এলাকায় গড়ে ওঠা অফিস, রেস্তোরাঁ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও যানজট বাড়াতে ভূমিকা রাখে। এ অবস্থায় গুলশান, বনানী, মহাখালী এলাকার আবাসিক ভবন থেকে বিভিন্ন অফিস, রেস্তোরাঁ, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার সুপারিশ করেছে সংসদীয় কমিটি। এতে বলা হয়েছে, এসব এলাকার বাণিজ্যিক অফিসগুলো বারিধারা থেকে জলসিঁড়িমুখী নতুন রাস্তা এবং পূর্বাচল ৩০০ ফুট রাস্তার মধ্যবর্তী সুবিধাজনক স্থানে সরিয়ে নিতে হবে। এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ভূমি অধিগ্রহণ করে একটি বিশেষায়িত বাণিজ্যিক ব্লক তৈরির কথাও বলা হয়েছে। মাটিকাটা এলাকায় এ বাণিজ্যিক ব্লক তৈরি করে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে অফিসগুলো স্থানান্তর করতে পারলে তা যানজট নিরসনে সহায়তা করবে বলে মনে করছে সংসদীয় কমিটি।
এছাড়া ঢাকার ধানমন্ডি, গুলশান, বনানী, লালমাটিয়া, উত্তরায় অবস্থিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের আনা-নেয়ার জন্য নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলার সুপারিশও করেছে কমিটি। এসব এলাকায় বেশকিছু ইংরেজি ও বাংলা মাধ্যমের স্কুল, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও কোচিং সেন্টার গড়ে উঠেছে। যানজট নিরসনে মিরপুর রোড, বিমানবন্দর রোড, সাতরাস্তা, প্রগতি সরণি, সাতমসজিদ রোডসহ গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোয় সকাল ৭টা থেকে ১০টা এবং বিকাল ৫টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত ‘বাস বে’ পদ্ধতি চালুর উদ্যোগ নেয়ার কথাও বলেছে সংসদীয় কমিটি। এ সময় নির্ধারিত লেনে বাস ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচল বন্ধ রাখার সুপারিশ করা হয়েছে।
রাজধানীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সড়ক হলো মতিঝিল থেকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত। অন্য রাস্তাগুলো এর সংযোগ সড়ক হিসেবে রয়েছে। মূল সড়কে যান চলাচলের চাপ পরবর্তী সময়ে অন্যান্য সড়কেও ছড়িয়ে পড়ে। আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল গ্রোথ সেন্টারের (আইজিসি) এক গবেষণা বলছে, রাজধানীজুড়ে ছড়িয়ে পড়া যানজটের জন্য দায়ী মূলত তিনটি স্থানে যানবাহনের চাপ—এয়ারপোর্ট, মহাখালী ও ফার্মগেট। এছাড়া যানবাহনের চাপ তুলনামূলকভাবে বেশি এমন স্থানগুলোর মধ্যে রয়েছে গাবতলী, সায়েন্স ল্যাব, এয়ারপোর্ট রোড, কুড়িল বিশ্বরোড, গুলশান ২ নম্বর, কারওয়ান বাজার, কাকরাইল, জিরো পয়েন্ট, বুড়িগঙ্গা ব্রিজ ও পোস্তগোলা ব্রিজ। এসব স্থানের মধ্যে যানবাহনের চাপ সবচেয়ে বেশি এয়ারপোর্ট রোড, মহাখালী ও ফার্মগেটে। গুলশান ও বনানী এলাকায় চলাচল করা যানবাহনের সিংহভাগই এ সড়ক ব্যবহার করে।
এমন পরিস্থিতিতে গুলশান, বনানী, মহাখালী এলাকা থেকে অফিস, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও রেস্তোরাঁ সরিয়ে দেয়া হলে তা যানজট নিরসনে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. মিজানুর রহমান। তবে এটি বাস্তবায়ন করা কঠিন বলেও মন্তব্য করেন তিনি। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু হলে সেখানে যানবাহনের চলাচল বাড়ে। মানুষের চলাচল বাড়ে। নানা অব্যবস্থাপনায়ও সড়ক অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এটি ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় বিরূপ প্রভাব ফেলে। এমন অবস্থায় যে সুপারিশ করা হয়েছে, সেটি বাস্তবায়ন করা হলে কিছুটা হয়তো সুফল মিলবে।
যানজটপ্রবণ এলাকা থেকে অফিস, রেস্তোরাঁ, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সরিয়ে নেয়াসহ ঢাকার যানজট নিরসনে ১৯টি সুপারিশ করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে মেট্রোরেলের নকশায় পরিবর্তন, সড়ক বৃদ্ধি, ইউলুপ নির্মাণ, ফুটপাত দখলমুক্ত রাখা, কোম্পানিভিত্তিক বাস সেবা প্রবর্তন, বাস বে চালু, টার্মিনাল সম্প্রসারণ, চালকদের প্রশিক্ষণ, ভূগর্ভস্থ পার্কিং গড়ে তোলা ও ট্রাফিক পুলিশের সংখ্যা বৃদ্ধি।
এসব সুপারিশ বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ২০টি সংস্থা, বিভাগ ও মন্ত্রণালয়কে। এগুলো হচ্ছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আইন মন্ত্রণালয়, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, জননিরাপত্তা বিভাগ, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি), ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি), ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ), বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ), রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), ঢাকা ওয়াসা, বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশনস কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল), ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড (ডেসকো), ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) ও বিভাগীয় কমিশনারকে (ঢাকা)।
তবে সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বিভিন্ন সময়। সমন্বয়ে ঘাটতির কারণে ক্ষেত্রবিশেষে যানজট পরিস্থিতির উন্নতির বদলে প্রকট হয়েছে। দেখা গেছে, সিগনাল বাতি বসায় সিটি করপোরেশন, পরিচালনা করে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। সিটি করপোরেশনের বানানো রাস্তা খুঁড়ে নষ্ট করে ওয়াসা। ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ডিপিডিসি) ভূগর্ভস্থ লাইন সরিয়ে দেয় সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ। ফ্লাইওভার বানাতে গিয়ে সড়ক নষ্ট করে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ। লক্কড়-ঝক্কড় যানবাহনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় পুলিশ-প্রশাসন। সেসব যানবাহনকেই চলাচলের অনুমতি দেয় বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)।
যানজটসহ ঢাকার নানা অব্যবস্থাপনার জন্য উন্নয়ন সংস্থাগুলোর মধ্যকার সমন্বয়হীনতাকে দায়ী করেছে বিশ্বব্যাংকও। এমন অবস্থায় পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যানজটের বিষয়টি যেহেতু অনেক বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত, সেহেতু এখানে অনেক সংস্থার জড়িয়ে পড়াটা অস্বাভাবিক নয়। তবে এসব সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের জন্য একটি স্বতন্ত্র ও শক্তিশালী কর্তৃপক্ষ গঠনের ওপর জোর দিচ্ছেন তারা। বুয়েটের অধ্যাপক ড. সামছুল হক এ প্রসঙ্গে বলেন, আমাদের এখানে স্টাডির কমতি নেই। সুপারিশের কমতি নেই। বাস্তবায়নকারী সংস্থারও কমতি নেই, কমতি শুধু বাস্তবায়নে। বাস্তবায়নের পর যারা রক্ষণাবেক্ষণ করবেন, সেটারও ঘাটতি আছে। সবচেয়ে বড় ঘাটতি হয় সমন্বিতভাবে কাজ করার ক্ষেত্রে। এসবের ঘাটতির মধ্যে সত্যিকার অর্থে আমাদের যেসব দুর্বলতা আছে, সেগুলো কিন্তু না কমে উল্টো বাড়ছে। যানজট নিরসনে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর, জাতীয় সংসদ, সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলসহ নানা জায়গা থেকে প্রচুর সুপারিশ আসছে; কিন্তু কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না। কারণ সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন না হওয়ার দায়টা কেউ নিচ্ছে না। সংস্থাগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য একটা উচ্চ ক্ষমতার কর্তৃপক্ষ দরকার ছিল।
রাজধানীর যানজটের একটি বড় কারণ ফিটনেসবিহীন মোটরযান। বিআরটিএর তথ্যমতে, চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত সারা দেশে ফিটনেস সনদ না থাকা মোটরযানের সংখ্যা ছিল ৭১ হাজার ৫৮৪। এর মধ্যে বাস ও মিনিবাস ৬ হাজার ৫০০টি। যানজট নিরসনে এসব পুরনো, লক্কড়-ঝক্কড় বাস রাস্তা থেকে তুলে দিয়ে নতুন বাস নামানোর সুপারিশ করেছে সংসদীয় কমিটি। একই সঙ্গে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে বহুতল বাস টার্মিনাল নির্মাণের সুপারিশ করা হয়েছে। এসব বিষয়ে নগর গবেষণা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, এ ধরনের উদ্যোগ যাচাই-বাছাই ও সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে হবে। যানজটের কেন্দ্রগুলোয় স্থাপনা নির্মাণের বিষয়টিতেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের প্রয়োজন রয়েছে। ডিটিসিএর দায়িত্বই হলো সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয় করা।